বিশ্ব নাট্য দিবস ২০১৬ – কেন্দ্রীয় উদ্‌যাপন

এ কলকাতার সঙ্গে সে ক্যান্টনের মেলবন্ধন আজও অটুট

লিংনান থিয়েটারের দর্শকাসনে বসে আছেন দেশ-বিদেশের শত শত নাট্যবিদ ও নাট্যসংগঠক। চিনের ঘড়িতে তখন পৌনে ৮টা। ঢং ঢং করে বেজে উঠল কাঁসার ঘণ্টা। সঙ্গে দুম করে আওয়াজ। ইস্পাতের নল থেকে বেরিয়ে আসা সোনালি কাগজের কুচিতে ছেয়ে গেল প্রেক্ষাগৃহ।

Advertisement

অংশুমান ভৌমিক

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৬ ১৫:২৩
Share:

একটি চাইনিজ অপেরার পারফরমেন্স।

লিংনান থিয়েটারের দর্শকাসনে বসে আছেন দেশ-বিদেশের শত শত নাট্যবিদ ও নাট্যসংগঠক। চিনের ঘড়িতে তখন পৌনে ৮টা। ঢং ঢং করে বেজে উঠল কাঁসার ঘণ্টা। সঙ্গে দুম করে আওয়াজ। ইস্পাতের নল থেকে বেরিয়ে আসা সোনালি কাগজের কুচিতে ছেয়ে গেল প্রেক্ষাগৃহ। আইটিআই-এর সদস্য দেশগুলির নামের ফলক হাতে একে একে মঞ্চে উঠে এলেন চিনা দুহিতার দল। মঞ্চে ডেকে নেওয়া হল প্রবাদপ্রতিম রুশ নাট্যকার আনাতোলি ভ্যাসিলিয়েভ-কে। বিশ্বনাট্য দিবসের বাণী আনুষ্ঠানিক ভাবে পাঠ করার জন্য।

Advertisement

শুরু হয়ে গেল বিশ্ব নাট্য দিবস উদ্‌যাপনের মূল অনুষ্ঠান। চিনের তৃতীয় বৃহত্তম নগর গুয়াংজোতে।

গুয়াংজো তো চিনে নাম। আমরা এই নগরটিকে তো কবে থেকে চিনেছি ‘ক্যান্টন’ নামে। দুশো বছর আগে থেকে আমাদের কলকাতা থেকে জাহাজ-বোঝাই হয়ে আফিং চালান হয়েছে চিনের মাটিতে। সব পার্ল নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই ক্যান্টন বন্দরের ভেতর দিয়ে। নেশায় বুঁদ হয়ে থেকেছে চিন। সম্বিৎ ফেরায় লড়াই করে সাহেব তাড়িয়েছে দেশ থেকে। এক দিন ক্যান্টনও ফিরে গেছে পুরনো চিনে নামে। গুয়াংজো। ২০১০ সালে এই গুয়াংজোতেই বসেছে এশিয়ান গেমসের আসর। এ বার বসল বিশ্বনাট্যের সবচেয়ে কুলীন সংস্থা আইটিআই-এর বিশেষ অধিবেশন।

Advertisement

ফুটবলে যেমন ফিফা, ক্রিকেটে আইসিসি, থিয়েটারে তেমনই আইটিআই ওরফে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট। ইউনেস্কো-র কোলেকাঁখে বড় হওয়া এই আন্তর্জাতিক সংস্থার সদর দফতর এই সে দিন পর্যন্তও প্যারিসেই ছিল। গত বছরই উঠে এসেছে সাংহাইতে। এই উঠে আসার পেছনে বেজিং-এর চায়না থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাব্যক্তিদের তোড়জোড় তো ছিলই। আইটিআই-এর কার্যকরী সমিতির মাথারাও বুঝেছিলেন যে এই সংস্থার কলজের জোর বাড়াতে হলে ঝিমিয়ে পড়া ইউরোপ নয়, চিনের মতো জোরালো অর্থনীতির হাত ধরাই শ্রেয়। কয়েক মাস ধরে সাংঘাই নগরপালিকার উপহার দেওয়া একটা চমৎকার বাড়িতে হইহই করে চলছে নয়া আন্দাজের আইটিআই-এর কাজকর্ম। বেজিং-এর চায়না থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি জি গুয়োপিং অতীব করিৎকর্মা লোক। পদাধিকার বলে তিনি আইটিআই-এরও সহ-সভাপতি। তাঁরই নেতৃত্বে এই মহাসম্মেলনের আসর বসাল চায়না থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন। পাশে পেল আইটিআই আর গুয়াংজো নগরপালিকাকে।


মঞ্চে চলছে একটি চাইনিজ রূপকথা ‘বাটারফ্লাই লাভার্স’-এর উপস্থাপনা।

২৭ মার্চ মূল অনুষ্ঠানের আগে সারা দিন ধরে এশিয়ান ট্র্যাডিশনাল থিয়েটার ফোরাম বসল খানদানি হোটেলের কনফারেন্স রুমে। নিজেদের দেশের সনাতন নাট্যশৈলী কী ভাবে হাল আমলে বেঁচেবর্তে বা রয়েসয়ে আছে, তার বিশদ বিবরণ দিলেন ইরান, আর্মেনিয়া, রাশিয়া, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং আয়োজক চিন থেকে আসা নাট্যবিদেরা। মহাসম্মেলনের প্রতিটি খুঁটিনাটির দিকে নজর ছিল আয়োজকদের। সকলের বক্তৃতা অন্যান্য ভাষাতে চটজলদি তর্জমা করে ওয়্যারলেস ইয়ারফোনে শোনানোর বন্দোবস্ত ছিল। চিনে ভাষার বক্তৃতা ইংরিজিতে শুনতে পেলেন অ্যাংলোফোন দুনিয়ার প্রতিনিধিরা। জাপানি বক্তৃতা চিনেরা শুনলেন নিজের মাতৃভাষায়, ভারতীয় প্রতিনিধি শুনলেন চোস্ত ইংরেজিতে। গ্রিস, সাইপ্রাস, ইতালি থেকে আসা পর্যবেক্ষকরাও কানে ইয়ারপ্লাগ গুঁজবার অবকাশ পেলেন। আদ্যন্ত পেশাদারি দক্ষতায় সম্পন্ন হল এই পর্ব।

সন্ধেয় আনাতোলি ভ্যাসিলিয়েভের ভাষণেও দেশজ নাট্যধারার মধ্যে আধুনিকতার সন্ধানের আহ্বান ছিল। এশিয়ান ট্র্যাডিশনাল থিয়েটার ফোরামের দেড় ডজন উপস্থাপনেও সেই সুর শোনা গেল। বলার কথা, এই পুরো ব্যাপারটির মধ্যে চিনের মধ্যস্থতা ইতিহাস সিদ্ধ হল।

মাও সে তুং-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দিন ফুরিয়েছে কবে! দেং জিয়াওপেং-এর চিনে মান্ধাতার আমলের নাট্যশৈলীকে পার্টির ছেনে দেওয়া ছাঁচে না ঢেলে পুরনো আন্দাজে আমজনতার সামনে পেশ করার নীতি চালু হয়েছিল। আমরা যাকে আজকাল পিকিং অপেরা আর ক্যান্টন অপেরা বলে চিনি, তাকে আরও জনমোহিনী করার জন্য ইদানীংকালে উঠে পড়ে লেগেছে চিন। সংস্কৃতি মন্ত্রক তো আছেই, কাঁড়ি কাঁড়ি ইউয়ান নিয়ে এই সব পারম্পরিক নাট্যের পিঠ চাপড়াতে এসে পড়েছে বেজিং, গুয়াংজো-র মতো সিটি কর্পোরেশন। নগরপালিকার দেদার দানে ফুলেফেঁপে উঠেছে ষোলো আনা পেশাদার অসংখ্য অপেরা কোম্পানি। তাদের অঢেল মানবসম্পদ তো আছেই, অনেকের আবার নিজস্ব নাটমঞ্চও আছে। আমাদের দেশে সংগীত নাটক অকাদেমি কতক এমন কাজই করে চলেছে। কিন্তু মিনিস্ট্রি অফ কালচারের অত বদান্যতা তারা পায় না।

বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব অ্যান্টনি ভাসিলিভ।

আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাও ঘটল। বেশ কয়েক বছর বাদে আইটিআই-এর এশিয়া-প্যাসিফিক রিজিওনাল মিটিং হল। পৌরোহিত্যে সেই জি গুয়োপিং। আইটিআই-এর মহানির্দেশক টোবিয়াস বিয়ানকোনে, দুই সাম্মানিক সভাপতি রামেন্দু মজুমদার এবং জিয়ং ওক কিম এবং ইতালি-সাইপ্রাস থেকে আসা আইটিআই কার্যকরী সমিতির সদস্যদের উপস্থিতিতে বেশ কয়েকটি সাধু প্রস্তাব পাশ করিয়ে নিলেন জি গুয়োপিং। প্রথমত, আইটিআই-এর বড় ছাতার তলায় প্রোটেকশন অফ ট্র্যাডিশনাল থিয়েটার ফোরাম গঠন। এশিয়া-প্যাসিফিকের দেশগুলিতে সনাতন নাট্যশৈলী কমবেশি অটুট আছে। এ ধরনের ফোরাম এই অঞ্চলের দেশগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান বাড়াতে সহায়ক হবে। দশের লাঠি একের বোঝা হবে না। দ্বিতীয়ত, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলির মধ্যে নাট্যসমন্বয় বাড়ানোর জন্য একটি সচিবালয় চাই। চিন চাইল সেই সচিবালয় গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে। উপস্থিত সবাই হাত তুলে সেই প্রস্তাব সমর্থন করলেন। রামেন্দু আর টোবিয়াস শুধু মনে করিয়ে দিলেন যে প্রস্তাবগুলি আগামী জুন মাসে ব্রেজিলের মানাউসে আইটিআই-এর সর্বোচ্চ সভায় আলোচিত হবে। আলোচনার পর সেগুলি গৃহীত হওয়া যে কেবল নিয়মরক্ষার ব্যাপার তা অবিশ্যি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেল।

২৯ মার্চ সারা দিন অভ্যাগত বিদেশিদের নিয়ে অপেরার সে কাল আর এ কাল চেনালেন আয়োজেকরা। পুরনো শহরের পুরনো পাড়ার মধ্যে এক ফালি গলির মধ্যে ক্যান্টন অপেরা মিউজিয়াম গড়ে উঠছে সাবেক অপেরার স্থাপত্যশৈলীতে ভর করে। আর পার্ল নদীর ধারে বছর ছয়েক আগে চালু হয়েছে গুয়াংজো অপেরা হাউস। আকারে-বহরে সিডনি অপেরা হাউসকে তো ছাপিয়ে গিয়েইছে সে, “ইউরোপেও এত আধুনিক অপেরা হাউস একটিও নেই,” বললেন ইতালির প্রতিনিধি তথা নাট্যকার ফ্যাবিও তোলেদি। শত্তুরের মুখে ছাই ফেলে সেখানে ইতিমধ্যেই পারফর্ম করে গিয়েছে ইয়োরোপের হরেক নামী অপেরা কোম্পানি। সুরের জাল বুনে গেছে লন্ডন ফিলাহার্মনিকের মতো নামী অর্কেস্ট্রা। ব্যাটন ঘুরিয়ে গেছেন জুবিন মেহতার মতো বিশ্বমান্য কন্ডাকটর। এখন চলছে স্টিফেন স্পিলবার্গের ‘ওয়রহর্স’-এর চিনে অপেরা সংস্করণ। আগামী মে মাসে আসছে ব্রডওয়ে থিয়েটার ট্রুপ, ‘মাই ফেয়ার লেডি’ মঞ্চস্থ করতে। যাঁদের ব্রডওয়ে যাওয়ার মুরোদ নেই, বা থাকলেও টিকিট কেনার জোর নেই, বা থাকলেও টিকিট মেলার উপায় নেই, ইচ্ছে হলে তাঁরা অক্লেশে গুয়াংজো অপেরা হাউসে চলে যেতে পারেন। ৮০ ইউয়ান থেকে টিকিটের দাম শুরু, ৭৬০ ইওয়ানে শেষ। অর্থাৎ, চাইলে মাথা পিছু ৭৫০ টাকা থেকে ৭০০০ টাকার মধ্যেই ব্রডওয়ে থিয়েটারের স্বাদ পাবেন। ঘর থেকে ঠিক ৫ ঘণ্টা উড়ে গিয়েই।

আর পাশ দিয়ে বাদশাহি চালে বয়ে চলা পার্ল নদীর জল ঘাটের কাছে ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল কী গল্প বলছে সে দিকে কান তো পাতবেনই। এ নিয়ে কুণাল বসু লিখেছেন, লিখেছেন অমিতাভ ঘোষ।

এ কলকাতার সঙ্গে সে ক্যান্টনের যুগলবন্দি আজও চলেছে। জলে জলে না হোক, পাতায় পাতায়!

ছবি: প্রতিবেদক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন