কেয়াতলায় ক্যায়া বাত

ত্রুটিহীন সবার অভিনয়। তবু ডিটেলের ব্যাপারে পরিচালক আর একটু সচেতন হতে পারতেন। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য।ত্রুটিহীন সবার অভিনয়। তবু ডিটেলের ব্যাপারে পরিচালক আর একটু সচেতন হতে পারতেন। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০০
Share:

অঞ্জন দত্তকে ধন্যবাদ, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে অবলম্বন করে বাঙালি জীবনে গোয়েন্দা ছবিকে ফিরিয়ে আনার জন্য। ‘বেণীসংহার’ গল্প অবলম্বনে ‘ব্যোমকেশ ফিরে এল’ দিয়ে অঞ্জনের এটা তৃতীয় ব্যোমকেশ সফর। হলে ভিড় দেখে ঠাহর হয় ওঁর সত্যান্বেষীতে মন দিয়েছে দর্শক।

Advertisement

যার সংহার নিয়ে গল্প, সেই বেণীমাধব চক্রবর্তী খুন হতে সামান্য ক’মিনিট লাগে ছবির শুরুতে। বাকি ছবি কেবলই গোয়েন্দাগিরি, থুড়ি সত্যান্বেষণ। যাঁরা শরদিন্দুর ব্যোমকেশ কাহিনিমালার সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা জানেন ‘বেণীসংহার’ ব্যোমকেশের নিজের কলমে লেখা, বন্ধু ও সহচর অজিতের বয়ানে নয়।

যার অর্থ দাঁড়ায়, শার্লক হোমস বা অ্যার্কিউল পোয়ারো নিজেরাই শোনাচ্ছেন নিজেদের তদন্তকথা। ফলত অজিতহীন (কিছু ঘরোয়া দৃশ্য ছাড়া) ব্যোমকেশ এখানে সর্বত্রচারী। ছবিটি অবিরাম নয়। সে প্রসঙ্গ পরে...

Advertisement

‘বেণীসংহার’ শরদিন্দুর শেষ জীবনে লেখা। এর সময়কাল গত শতাব্দীর ষাটের দশকের একেবারে শেষ দিক, যখন চরম বামপন্থী আন্দোলন ছড়াচ্ছে শহরে। হ্যারিসন রোডের বাসা ছেড়ে ব্যোমকেশ, অজিত ও সত্যবতী তখন দক্ষিণ কলকাতার কেয়াতলা রোডের বাসিন্দা। যেখান থেকে ৫ মিনিট দূরত্বে বেণীমাধবের প্রকাণ্ড তিন তলা বাড়ি। যার তেতলায় এক রাতে খুন হলেন বৃদ্ধ। খুন হল তাঁর খাস চাকর মেঘরাজ। দু’জনেরই গলা ধারালো কোনও অস্ত্র দিয়ে কাটা।

খুন হওয়ার আগে পরিবার নিয়ে রুষ্ট বেণীমাধব তার সম্পত্তির উইল বদলানোয় মন দিয়েছিল। সে উইল কার্যকর হলে পরিবারের সকলের সমূহ সর্বনাশ। ফলে ‘বেণীসংহার’য়ে লিপ্ত হওয়ায় কারও স্বার্থই কিছু কম নয়। বেণীমাধব খুনই হলেন।

চিত্রনাট্যকার অঞ্জন খুনটিকে গোড়ায় এনে তদন্তের সঙ্গে সঙ্গে তাদের গতিবিধি ও অভিপ্রায় দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সাদা-কালো ফুটেজের রঙিন ছবিতে অতীত বৃত্তান্ত দেখানোর সুযোগ নিয়েছেন। প্রথম কিছু ক্ষণের কেটে কেটে ধরানো কথনে একটা আধুনিক ছবির মেজাজ হয়তো এসেছে। কিন্তু সবটাই বড় বেশি দ্রুততার সঙ্গে ঘটে বলে রহস্য দানা বাঁধার অবকাশটাই থাকে না। পরেও যে চরিত্রদের সবাইকেই বেশ মেলে ধরা গিয়েছে— তা-ও বলা যায় না। দর্শক নিজের মনে খুনি, খুনের কারণ ইত্যাদি নিয়ে ভাবনা শুরু করার আগেই সব কিছুর মধ্যে ঢুকে পড়েছে ব্যোমকেশ। শুধুই খুনি ধরা নয়, অপরাধের অন্ধকার জগত্‌টা তলিয়ে দেখার আবেগ যে সব গোয়েন্দার মধ্যে আছে, তারাই বেশি টানে অঞ্জনকে। জানিয়েছেন চিত্রনাট্যকার পরিচালক নিজেই। তাই হোমস বা পোয়ারোর চেয়ে রেমন্ড চান্ডলারের সত্যান্বেষী ফিলিপ মার্লোকে তাঁর বেশি পছন্দ। যে মার্লোকে রুপোলি পর্দায় অমর করে রেখেছেন হামফ্রি বোগার্ট।

অথচ ‘ব্যোমকেশ ফিরে এল’-র চলন কিন্তু ততটা মার্লোকে মনে করায় না যতটা পোয়ারোকে। কথা বলে বলেই কাজ সারতে হয়েছে আলোচ্য ছবির ব্যোমকেশকে। একটুআধটু পিছু নিতে হয়েছে সন্দেহভাজনকে, একবার ছুরির কোপ থেকে বাঁচাতে হয়েছে নিজেকে। তবে তার বেশির ভাগ আত্মরক্ষার চেষ্টা স্ত্রী সত্যবতীর (উষসী চক্রবর্তী) তীব্র বাক্যবাণ থেকে। কারণ বারবার বলা সত্ত্বেও নিজের অসুস্থ শিশুপুত্রটির ডাক্তার দেখানো তার দ্বারা হয় না।

‘ব্যোমকেশ ফিরে এল’র প্রায় সবটাই ঘটে যায় বেণীমাধব ও ব্যোমকেশের দুই বাড়ির ভিতরে। কিন্তু তবুও দর্শক আমোদের সঙ্গে ব্যোমকেশ দেখে যাচ্ছেন। তার কারণ রসালো সংলাপ। গেরস্থালির সীমিত ক্ষেত্রের মধ্যে হলেও ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরার কাজ প্রায় নিখুঁত। সূক্ষ্ম সম্পাদনা (অর্ঘ্যকমল মিত্র) ও আবহ সংযোজনা (নীল দত্ত) নিটোল করেছে দৃশ্য ও পরিবেশ।

মুখ্য ভূমিকায় আবিরের কথায় পরে আসছি। আগে বলি কৌশিক সেনের গঙ্গাধর চরিত্রটি চমত্‌কার। চন্দন সেনের অজয়, বিশ্বজিত্‌ চক্রবর্তীর বেণীমাধব, সনতের ভূমিকায় রাহুল, লকেট চট্টোপাধ্যায়ের গায়ত্রী, অঞ্জনা বসুর আরতি, উষসী চক্রবর্তীর সত্যবতী এবং মেঘনার মেদিনী প্রায় ত্রুটিহীন। অজিত হিসেবে শাশ্বতর কাজ খুবই কম। ওইটুকুও চোখে পড়ার মতো।

অতঃপর নামভূমিকায় আবির। ব্যোমকেশ হয়ে ওঠার চেষ্টায় খামতি নেই তবে কতগুলো সমস্যা ছিল যা ওঁর ওপর প্রায় আরোপিত। যেগুলো ওঁর দায়িত্ব বা দোষের মধ্যে পড়ে না। ষাটের দশকের নায়কের চোখে হালফিলের চশমার ফ্রেম কেন? ব্যোমকেশের চিন্তাচর্চা মানেই কি মুহুর্মুহু সিগারেট ধরানো? সে কি সকালে বিছানা ছাড়ে চকচকে শেভ করা গাল নিয়ে? ষাটের দশকে পঞ্চাশ সিগারেটের টিন বলতে তো টিনই ছিল। প্লাস্টিকের কৌটো কি? আর মেদিনী বাংলা উপন্যাস পড়ে বলে যে বইটা দেখাল, সেটা তো কবিতার বই। গোয়েন্দা ছবির পরিচালকের এই সব ব্যাপারে দৃষ্টি থাকা খুবই দরকার।

আসলে ফাইন মিলের ধুতি আর সোনার বোতাম পরানো চিকন পাঞ্জাবিতে আবির একটু বেশিই নায়ক-নায়ক। না ভেবেই প্রায় তৈরি প্রশ্ন-তৈরি জবাব তাঁর। আবিরের অভিনয়ের ভাল দিক এটাই যে তাঁর ফিজিকাল অ্যাক্টিং বেশ চকচকে। একবার চোখে এলে চোখ থেকে সরে না। গোয়েন্দা যদি নায়ক হন, তাঁকেও তো শেষ বিচারে নায়ক হতে হবে।

শেষে ফের বলি, অপরাধী ধরা যদি গোয়েন্দার সাফল্য হয়ে থাকে তো দর্শক ধরা তো পরিচালকের সেরা সাফল্য। অঞ্জন দত্ত দিব্যি সে সাফল্য অর্জন করেছেন। আমরা অত্যন্ত সুখী সে জন্য। তবে ফিলিপ মার্লো,

স্যাম স্পেড ও ভিক মালয়-ভক্ত অঞ্জন খুশি তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন