পুরো ফুটবলবিশ্ব জুড়ে তাঁরা চিহ্নিত ‘পর্দার আড়ালের নায়ক’ হিসাবে। যাঁরা মাঠে নামেন না। মাঠে নেমে তাঁদের দৌড়োদৌড়ি করতে হয় না। গোল বাঁচাতে হয় না। গোল করতেও হয় না। কিন্তু মাঠের বাইরে তাঁদের মগজাস্ত্রই ঘুরিয়ে দিতে পারে কোনও ম্যাচের ছবি। তাঁদের ভোকাল টনিক কোনও ঝিমিয়ে পড়া দলকে উদ্দীপ্ত করে দিতে পারে। দলের সাফল্যও অনেকাংশে নির্ভর করে তাঁদের উপরেই। তাঁরা বিশ্বফুটবলের চাণক্য। অর্থাত্ কোচ।
দলের সাফল্যে যেমন সমর্থকরা বলেন, “ভেরি গুড কোচ।” ঠিক তেমনই দল বাজে খেললে তাঁদেরই প্রথম শুনতে হয়, “জঘন্য কোচ। একে সরিয়ে দেওয়া হোক।” কিন্তু তাঁদের ছেড়ে অসম্পূর্ণ ফুটবল।
ঠিক এক মাস বাকি বিশ্বকাপের ঘণ্টা বাজতে। কিন্তু এই বত্রিশটা দলের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কয়েক কোটি টাকার মগজ। যাঁদের এক চালেই বদলে যেতে পারে গোটা খেলার চেহারা। যাঁদের ক্ষমতা আছে দলকে উদ্বুদ্ধ করার ঐতিহাসিক সেই ট্রফিটা তুলতে।
ভিসেন্তে দেল বস্কি
(স্পেন)
শক্তি
ভিসেন্তে দেল বস্কি
• ধারাবাহিক ভাবে ট্রফি জিতেছেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। ইউরো কাপ। বিশ্বকাপ। বিশ্ব ফুটবলের প্রতিটা বড় ট্রফিই জিতেছেন তিনি।
• দলের শক্তি অনুযায়ী দল সাজাতে পারেন। রিয়াল কোচ থাকাকালীন ৪-৪-২তে দল সাজাতেন। ২০১০ বিশ্বকাপে ৪-৩-৩। আর ২০১২ ইউরোতে ৪-৬-০। যখন ফাব্রেগাসকে ফলস নাইনে খেলিয়েছিলেন দেল বস্কি।
• ফুলব্যাকদের ওভারল্যাপ করানো, মিডফিল্ডারদের পুরো মাঠ জুড়ে খেলানো, বলের পজেশন রেখে বিপক্ষ দলকে ‘ফ্রাস্ট্রেট’ করা, প্রায় সব ছকেই বিপক্ষকে মাত করতে পারেন দেল বস্কি।
• ঠিক সময় ফুটবলারদের পরিবর্তে নামাতে পারেন দেল বস্কি। ২০১০ বিশ্বকাপ ফাইনালে সেস ফাব্রেগাস, জেসুস নাভাসদের নামিয়ে হাফিয়ে ওঠা ডাচ রক্ষণ ভেঙ্গেছিলেন দেল বস্কি।
• দুর্দান্ত ম্যান ম্যানেজার। স্পেন ক্যাম্পে রিয়াল-বার্সা ফুটবলারদের দ্বন্দ্ব ভাঙতেও সফল হয়েছিলেন এই প্রবীণ কোচ।
• বড় ফুটবলারদের কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা আছে। দ্রুত সিদ্ধান্তও নিতে পারেন।
• বিপক্ষ দল নিয়ে পড়াশুনো করেন আর স্বভাব ভাল। তাই বিতর্কে জড়ান না।
দুর্বলতা
• স্পেনের পজেশন খেলায় গোল আসে না বেশি।
• তাঁর বানানো স্পেন দল ‘চেজ’ করতে পারে না খেলা। যা প্রমাণ হল কনফেডারেশন কাপ ফাইনালে।
• প্রতিআক্রমণেও তাঁর দল দুর্বল।
লুই ফিলিপ স্কোলারি
(ব্রাজিল)
শক্তি
লুই ফিলিপ স্কোলারি
• দলকে সংঘবদ্ধ করতে পারেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিজ্ঞতা আছে।
• আক্রমণাত্মক দল বানাতে পারেন। ২০০২-তে ৩-৪-১-২ ফর্মেশনে দল সাজিয়ে নাস্তানাবুদ করেছিলেন বিপক্ষদের।
• বড় টুর্নামেন্টের জন্য ভাল কোচ। ব্রাজিলকে নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছাড়াও ২০০৬-তে পর্তুগালকে চতুর্থ করেছিলেন।
• ফুলব্যাকদের ওভারল্যাপ করাতে অভ্যস্ত। গোটা দলই সব সময় জায়গা বদল করছে। তাই স্কোলারির দলের কোনও ফুটবলারকে মার্ক করা সম্ভব নয়।
• স্কোলারির ফর্মেশনে সব সময় মাঝমাঠে দুই শক্তিশালী পিভটকে রাখেন। যার ফলে রক্ষণকে বাঁচিয়ে রাখা যায়।
• ‘হাই প্রেসিং’ খেলা। কনফেডারেশন কাপ ফাইনালে স্পেনকে বলে সময় না দেওয়া। ইনিয়েস্তা, বুস্কেতসের মতো ফুটবলারদের পিছনে অস্কার, দাভিদ লুইজদের ছায়া করে দেওয়া। ফ্রেডকে ‘হোল্ড আপ প্লে’ করতে বলে নেইমার, হাল্কদের আরও আক্রমণ করার সুযোগ দিয়ে ৩-০ জিতেছিলেন স্কোলারি।
দুর্বলতা
• বদমেজাজি। ইউরোর যোগ্যতা অর্জন পর্বে সার্বিয়ার এক ফুটবলার দ্রাগুতিনভকে ঘুষি মেরেছিলেন স্কোলারি।
• মাঝে মাঝে তাঁর প্রথম দল বাঁছা নিয়ে দেখা দিয়েছে বিতর্ক।
• হাই ডিফেন্সিভ লাইন নিয়ে দলকে খেলানোয় মাঝে মাঝে সমস্যা হয় রক্ষণের।
• দুর্বল দলের বিপক্ষে খেলে হারের প্রবণতা আছে। ইউরো ২০০৪ ফাইনালে পর্তুগালের কোচ থাকাকালীন গ্রিসের কাছে হারতে হয়েছিল। দলে রোনাল্ডো, ফিগোর মতো তারকা ফুটবলার থাকা সত্বেও।
ফাবিও কাপেলো
(রাশিয়া)
শক্তি
ফাবিও কাপেলো
• জয়ের খিদে অসীম। ট্রফিও জিততে জানেন।
• ইতালীয় মনোভাব থাকায় কাপেলোর প্রতিটা দলের রক্ষণ সব সময় আঁটোসাঁটো থেকেছে। বর্তমান রাশিয়া দলও যোগ্যতা অর্জন পর্বে মোটে পাঁচ গোল খেয়েছে।
• তরুণ ফুটবলারদের সুযোগ দিতে দ্বিধাবোধ করেননা। পাওলো মালদিনি, আলেসান্দ্রো কোস্তাকুর্তার মতো ফুটবলারদের প্রথম সুযোগ দিয়েছিলেন।
• ‘ম্যাচডে কোচ’ বলা হয়। অর্থাত্ প্রতিটা ম্যাচ অনুযায়ী দলের ছক সাজাতে অভ্যস্ত তিনি। কোনও ম্যাচে ৪-৪-২ তো কোনও ম্যাচে ৪-৩-৩।
• দরকার পড়লে ফুটবলার রোটেট ক
• বিপক্ষ দলের খেলার ধরন অনুযায়ী ছক সাজাতে পারেন। বিপক্ষের দুর্বলতার সুযোগ নিতে পারেন।
• দলে শৃঙ্খলা রাখতে পারেন। কোনও তারকা ফুটবলার খারাপ খেললে তাঁকে প্রথম দল থেকে বাদ দিতেও দ্বিধাবোধ করেননা।
দুর্বলতা
• তারকা ফুটবলারদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যান। যেমন রোমায় তোত্তি বা রিয়াল মাদ্রিদে বেকহ্যাম।
• বিশ্বকাপে অভিজ্ঞতা কম। মাঝে মাঝে ‘প্ল্যান বি’ থাকেনা তাঁর কাছে।
লুই ফান গাল
(নেদারল্যান্ডস)
শক্তি
লুই ফান গাল
• আক্রমণাত্মক দল বানাতে পারেন। ১৯৭০ সালের ‘টোটাল ফুটবল’ মানসিকতা নিয়েই দল সাজান ফান গাল। ধারাবাহিক ভাবে ট্রফিও জিতেছেন।
• বল দখলের উপরে জোর দিলেও ডিরেক্ট ফুটবল খেলতে পারে তাঁর দল।
• দেল বস্কির মতোই ফুটবলারদের শক্তি অনুযায়ী দল সাজান ফান গাল। ২-৩-২-৩ থেকে ৪-৩-৩ প্রতিটা ফর্মেশনেই দল সাজিয়ে এসছেন।
• উইঙ্গারদের শক্তি প্রয়োগ করে আক্রমণ সাজান ফান গাল। যেমন বায়ার্নে রবেন-রিবেরি জুটি।
• ‘টোটালিটেরিয়ান’ মানসিকতায় বিশ্বাসী। অর্থাত্ কোনও ব্যক্তিগত ফুটবলারের থেকে দলকে প্রাধান্য দেন।
দুর্বলতা
• স্পষ্টবক্তা হওয়ার জন্য অনেক সময় ক্লাব কর্তা ও ফুটবলারদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়েছেন
• এর আগেও নেদারল্যান্ডসের কোচ হয়েছেন। কিন্তু ২০০২ যোগ্যতা অর্জন পর্ব কাটিয়ে দলকে বিশ্বকাপে তুলতে পারেননি
• আয়াখসের পরে কোনও জায়গায় স্থায়ী ছিলেন না। তাই ভবিষ্যতের দল বানাতে পারেননা।
জোয়াকিম লো
(জার্মানি)
শক্তি
জোয়াকিম লো
• হাই ডিফেন্সিভ লাইন নিয়ে খেললেও দলের রক্ষণ আঁটোসাঁটো রাখেন
• লাম, সোয়েনস্টাইগারদের মতো অভিজ্ঞ ফুটবলারদের সঙ্গে রয়েস, গোটজের মতো তরুণ ফুটবলারদের নিয়ে সফল দল গড়েছেন
• বড় টুর্নামেন্টে ধারাবাহিকতা। ইউরো ২০০৮-এ রানার্স আপ। ২০১০ বিশ্বকাপে তৃতীয় ও ২০১২ ইউরো কাপে সেমিফাইনালিস্ট।
• আক্রমণাত্মক ফুটবলারদের সর্বদা জায়গা বদল করান। মাঝমাঠে ডাবল পিভটের উপরে দায়িত্ব চাপান পুরো খেলাটা প্রভাবিত করার জন্য।
• দল বেশি বদলান না। প্রতিআক্রমণেও ভয়ঙ্কর তাঁর দল। উইঙ্গাররা ট্র্যাক ব্যাক করে রক্ষণকে সাহায্য করে।
দুর্বলতা
• খুব বেশি ট্রফি জেতেননি। ১৯৯৪ সাল থেকে কোচিং করালেও তিনটে ট্রফি জিতেছেন।
• জার্মানিকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে শেষ চারে উঠলেও ট্রফি জিততে পারছেন না।
• রক্ষণাত্মক দলের বিরুদ্ধে তাঁর ফুটবল কার্যকরী নয়