দেশের নাম পৃথিবী

সীমানা আবার কী? আমরা পৃথিবীর নাগরিক। এই মর্মে আমেরিকার দুই মানুষের ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড’ আন্দোলন, আর বহু দিন আগে এক বাঙালির সেই গোত্রের চিঠি। অনুনয় চট্টোপাধ্যায়কেউ বলেছিল অবাস্তব, কেউ বলেছিল দেশদ্রোহী, কেউ বলেছিল পাগল। আর তিনি কী বলেছিলেন? ‘আমি পৃথিবীর সন্তান। পৃথিবীর নাগরিক। আমার কাছে পৃথিবী পদার্থমাত্র নয়, তা এক জীবন্ত আইডিয়া। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিভেদের এই সীমারেখা আমি মানব কেন?’ সোল গ্যারেথ ডেভিস। আধুনিক পৃথিবীর রাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিভাজনের প্রায় স্বতঃসিদ্ধ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানানো এই মানুষটি গ্যারি ডেভিস নামেই পরিচিত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৫
Share:

কেউ বলেছিল অবাস্তব, কেউ বলেছিল দেশদ্রোহী, কেউ বলেছিল পাগল। আর তিনি কী বলেছিলেন? ‘আমি পৃথিবীর সন্তান। পৃথিবীর নাগরিক। আমার কাছে পৃথিবী পদার্থমাত্র নয়, তা এক জীবন্ত আইডিয়া। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিভেদের এই সীমারেখা আমি মানব কেন?’

Advertisement

সোল গ্যারেথ ডেভিস। আধুনিক পৃথিবীর রাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিভাজনের প্রায় স্বতঃসিদ্ধ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানানো এই মানুষটি গ্যারি ডেভিস নামেই পরিচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেইন প্রদেশের বার হারবারে জন্ম। সাল ১৯২১। ব্রডওয়ে থিয়েটারে কিছু দিন অভিনয় করার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্যারি মার্কিন বোমারু বিমানের চালক নিযুক্ত হন। নৌবাহিনীর সেনা হিসেবে যুদ্ধে প্রাণ হারান গ্যারির দাদা বাড। দাদার শোকে বিধ্বস্ত গ্যারি উপলব্ধি করেন, তাঁর বোমার আঘাতেও তো প্রাণ গিয়েছে কত জনের! কে রেখেছে সেই হিসেব? এই তীব্র গ্লানিতে গ্যারি মার্কিন নাগরিকত্ব বিসর্জন দেন। ১৯৪৮-এ প্যারিসে গিয়ে নিজেকে ‘পৃথিবীর নাগরিক’ হিসেবে ঘোষণা করেন। বিশ্বশান্তির জন্য শুরু হয় তাঁর ‘ওয়ান গভর্নমেন্ট ফর ওয়ান ওয়ার্ল্ড’ আন্দোলন।

অবশ্য এই আন্দোলনের কয়েক বছর আগে ১৯৪৩-এ ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড’ নামেই একটি বই লিখে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন আর এক মার্কিন নাগরিক ওয়েন্ডেল উইল্কি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১-৪২ নাগাদ পশ্চিম এশিয়া, সোভিয়েত রাশিয়া ও চিন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা এই বই সে সময় বেস্টসেলারও হয়। ওই দেশগুলোর রাষ্ট্রনেতা বা সেনাবাহিনীর লোকজনের সঙ্গে শুধু নয়, সাধারণ মানুষের সঙ্গেও দীর্ঘ দিন কথা বলে তিনি যুদ্ধের ভয়ংকর পরিণতি উপলব্ধি করেন ও বিশ্বশান্তির পক্ষে সওয়াল করে, যাবতীয় ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে মুক্ত একক পৃথিবীর দাবিতে লিখে ফেলেন বইটি। রুজভেল্ট প্রশাসন ও নিজের রিপাবলিকান দলে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করলেও, আমেরিকাসহ পৃথিবীর বহু দেশে সাধারণ মানুষকে বিশ্বমানবতা ও আন্তর্জাতিকতাবাদে উদ্বুদ্ধ করে এই বই।

Advertisement

১৯৪৪-এ মাত্র ৫২ বছর বয়সে উইল্কি মারা যান। তার বছর চারেকের মধ্যেই যে তাঁর দেশেরই গ্যারি প্যারিসে রাষ্ট্রপুঞ্জের সামনে কুড়ি হাজার অনুগামীকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ব জুড়ে মানবাধিকার রক্ষার জোরালো দাবি তুলবেন, কে জানত! পরের বছরেই গ্যারি তৈরি করলেন ওয়ার্ল্ড সিটিজেন বা বিশ্বনাগরিকদের জন্যে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। দু’বছরের মধ্যে ১৫০টিরও বেশি দেশ থেকে প্রায় সাত লক্ষ মানুষ সদস্য হিসেবে নাম নথিভুক্ত করালেন। ’৫৩-য় ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্টের কথা ঘোষিত হয়। পরের বছর থেকেই এই সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড পাসপোর্ট’ দিতে শুরু করে। এ ছাড়াও, আবেদনকারীদের বার্থ সার্টিফিকেট, বিয়ের প্রমাণপত্র ও অন্যান্য পরিচয়পত্রও দিতে শুরু করে। একশোরও বেশি দেশে এই প্রমাণপত্র গৃহীত হয়। ওয়ার্ল্ড পাসপোর্ট নিয়ে ১৯৫৬-য় বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে প্রথমে ভারতেই আসেন গ্যারি। প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে সাম্মানিক পাসপোর্ট উপহার দেন। কাম্যু, সার্ত্র, আইনস্টাইন এই আন্দোলনকে কুর্নিশ জানান। প্রাক্তন মার্কিন ফার্স্ট লেডি ইলিনর রুজভেল্ট গ্যারিকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘বিশ্ব শাসন করার জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ তৈরি হয়নি। মিস্টার ডেভিস যদি পৃথিবী জুড়ে আন্তর্জাতিক সরকার তৈরি করতে পারেন, তা হলে ভাল হয়।’ ১৯৬০-এ প্রকাশিত হয় গ্যারির প্রথম বই ‘মাই কান্ট্রি ইজ দ্য ওয়ার্ল্ড’।

অবশ্যই, প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে পড়তে হয় গ্যারিকে। ফ্রান্সে গ্রেফতার হন। কয়েক বছর পর বাকিংহাম প্যালেসের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ করায় ব্রিটেনে তাঁকে আটক করা হয়। ফ্রান্সে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয় এক সময়। আমেরিকাতেও প্রশাসনিক মহলে বিরোধিতার ঝড় ওঠে। ১৯৭৭-এ আমেরিকা ফিরতে গেলে তাঁকে বাধা দেওয়া হয়। ১৯৭৯-তে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট গ্যারিকে ভিন্গ্রহের প্রাণী বলে উল্লেখ করে তাঁর ওয়ার্ল্ড পাসপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু ‘দেশহীন’ অবস্থাতেও তিনি মার্কিন মুলুকেই বেশ কয়েক বছর কাটিয়ে দেন। ‘বৈধ’ ছাড়পত্র ছাড়া দেশে ঢোকার অভিযোগে ’৮২-তে সুইট্জারল্যান্ডে ফের জেলে যেতে হয় গ্যারিকে। ১৯৮৪-তে জাপান তাঁর প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। তাঁর বিরুদ্ধে এমন বলাও আরম্ভ হয় যে, গ্যারির দেওয়া ওই পাসপোর্ট আসলে ভুয়ো। তিনি টাকা নিয়ে লোক ঠকাচ্ছেন। এই ‘বেআইনি’ কার্যকলাপের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের প্রশাসন কড়া পদক্ষেপ করতে শুরু করে।

যাবতীয় বাধা সত্ত্বেও গ্যারি ও তাঁর অনুগামীরা দমে যাননি। কৃত্রিম আন্তর্জাতিক ভাষা এসপেরান্তো সহ মোট সাতটি ভাষায় পাসপোর্ট দেওয়া শুরু হয়। নথিভুক্ত বিশ্বনাগরিকের সংখ্যা আজ দশ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। ইকুয়েডর, তানজানিয়া সহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ এই পাসপোর্টকে সম্পূর্ণ স্বীকৃতি দিয়েছে। শতাধিক দেশে ক্ষেত্র-বিশেষে ও শর্ত-সাপেক্ষে তা ব্যবহারের অনুমতিও মিলেছে। বিশ্বনাগরিকদের জন্য আলাদা পতাকা তৈরির পাশাপাশি, সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে দূষণ-প্রতিরোধকারী আলাদা মুদ্রাও তিনি চালু করেন। মৃত্যুর আগে জুলিয়ান আসাঞ্জ এবং এডওর্য়াড স্নোডেনকে গ্যারি পাসপোর্ট পাঠিয়ে দেন। গত বছর গ্যারি মারা গিয়েছেন। শেষ দিন পর্যন্ত জারি ছিল তাঁর লড়াই। সব কিছুর পেছনে গ্যারির একটাই সহজ সরল যুক্তি ছিল রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিভেদের এই প্রাচীর ভেঙেই একমাত্র বিশ্ব জুড়ে অনবরত ঘটে চলা যুদ্ধ থামানো সম্ভব।

এই আন্দোলনের সূত্রে এক বাঙালির কথাও বলা দরকার। ১৮৩২। রামমোহন রায়কে ইংল্যান্ড থেকে যেতে হবে ফ্রান্সে। তিনি জানতে পারলেন, তাঁকে ফরাসি দূতাবাসে গিয়ে নিজের পরিচয়পত্র ও অন্যান্য প্রমাণ দাখিল করে আগাম আবেদন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফ্রান্সের বিদেশমন্ত্রীকে পাঠিয়ে দিলেন প্রতিবাদপত্র। প্রগতি ও সভ্যতার শিখরে পৌঁছে যাওয়া একটি দেশেও কী ভাবে অযৌক্তিক ও ভেদাভেদভিত্তিক এই নিয়ম বহাল থাকতে পারে, তা নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন সে চিঠিতে। সেই চিঠি পৌঁছয় সম্রাট লুই ফিলিপ-এর কাছে। সম্রাট তাঁকে ফ্রান্সে সাদর আমন্ত্রণ জানান ও বলেন, তাঁর ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনও পরিচয়পত্রের দরকার নেই।

বহু দিন আগের সেই ঘটনা আর এখনও চলতে থাকা সহস্র গ্যারি-অনুগামীর প্রাণপণ লড়াই একটা কথাই প্রমাণ করে: মানুষ জাতটা আদতে জন্মেছে পাঁচিল ভাঙার জন্য, গড়ার জন্য নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন