ধুলো থেকে সোনা

বাঙালি। উচ্চতা মেরেকেটে পাঁচ-পাঁচ। পরিপাটি সিঁথি। পেটপাতলা। বিশ্বে হেন বিষয় নেই যাতে ব্যুৎপত্তি নেই। কোহলির ক্রিকেটীয় কর্তব্য থেকে করিনার কোমরের মাপ, পুতিনের ক্রাইমিয়া-প্রীতি থেকে মোদীর মধ্যাহ্নভোজনের মেনু— সব কণ্ঠস্থ। বাঙালি বাজিমাত কণ্ঠেই— গলাবাজিতে জুড়িহীন। এটুকু পড়েই যে বাঙালিরা ভাবছেন এ জাতির কেবল ‘মুখেন মারিতং জগৎ’— ভুল ভাবছেন। বাঙালির আছে আইডিয়া। বাঙালি বেচে প্রতিভা।

Advertisement

সুমন দে

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:০৭
Share:

ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

বাঙালি। উচ্চতা মেরেকেটে পাঁচ-পাঁচ। পরিপাটি সিঁথি। পেটপাতলা। বিশ্বে হেন বিষয় নেই যাতে ব্যুৎপত্তি নেই। কোহলির ক্রিকেটীয় কর্তব্য থেকে করিনার কোমরের মাপ, পুতিনের ক্রাইমিয়া-প্রীতি থেকে মোদীর মধ্যাহ্নভোজনের মেনু— সব কণ্ঠস্থ। বাঙালি বাজিমাত কণ্ঠেই— গলাবাজিতে জুড়িহীন।

Advertisement

এটুকু পড়েই যে বাঙালিরা ভাবছেন এ জাতির কেবল ‘মুখেন মারিতং জগৎ’— ভুল ভাবছেন। বাঙালির আছে আইডিয়া। বাঙালি বেচে প্রতিভা। পরিশ্রমের ক্ষমতা কম, কিন্তু প্রতিভার ক্ষমতা বেশি। স্রেফ ট্যালেন্টের দৌলতে এক-একটি বঙ্গসন্তান যেন সাক্ষাৎ এক-একটি পরশপাথর। ছুঁইয়ে দিন, ব্যস, পলক ফেলতেই চব্বিশ ক্যারাট।

ধুলো থেকে সোনা। করতে জানে একমাত্র বাঙালিই।

Advertisement

টমাস মেকলে সাহেব শরীরের গঠন দেখে ‘Bengalee’-কে ভেবেছিলেন বেজায় দুর্বল, বোঝেননি বাঙালির যাবতীয় পেশি তার মস্তিষ্কে। পরশুরামের প্রফেসর ননী-র কথাই ধরুন। পৃথিবীর যাবতীয় অন্নাভাব দূর করতে বাড়ির মধ্যেই স্রেফ একটি উনুন, ডেকচি আর রবারের নল গোঁজা একটি হারমোনিয়াম দিয়ে প্রায় প্রোটিন সিন্থেসিস করে ফেলেছিলেন আর কী! গল্পের বিজ্ঞানীদের থেকে বাস্তবের বাঙালি বিজ্ঞানীদের ধুলো থেকে সোনা তৈরির ক্ষমতা বিশেষ কম না। প্রেসিডেন্সি কলেজে তখন পদার্থবিদ্যার ঠিকঠাক ল্যাবরেটরি ছিল না। নিত্যদিন বর্ণবৈষম্যের শিকার হওয়া এক তরুণ অধ্যাপক স্নানাগার করার জন্য নির্দিষ্ট একটি চব্বিশ বর্গফুটের ঘরকেই নিজের ল্যাব বানিয়ে শুরু করে দিলেন গবেষণার কাজ। ভারতে তখন পরীক্ষানিরীক্ষার যন্ত্রপাতি মাথা খুঁড়লেও পাওয়া যেত না। তাতে কী, এখানকার সাধারণ মিস্ত্রিদের দিয়েও গোদা লেদ মেশিনে কাটাকাটি করে তৈরি হল যন্ত্র। এক পয়সা অনুদান নেই। তাতেও দমলেন না তিনি। নিজের বেতনের প্রায় পুরোটাই ঢেলে দিলেন গবেষণায়। ১৮৯৪-৯৫ সালে কলকাতার টাউন হল-এ রেডিয়ো ওয়েভের প্রমাণ দিলেন এই উদ্যমী তরুণ, জগদীশচন্দ্র বসু। রেডিয়ো ওয়েভের ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ে তিনি কাজ করেছিলেন, তা থেকেই পরবর্তী কালে বাণিজ্যিক ভাবে রেডিয়ো নির্মাণ সম্ভব হয়। গল্প কিন্তু এখানেই শেষ নয়, স্বর্ণপ্রসবী বাঙালি মস্তিষ্ক সোনার কারবারির বিষয়বুদ্ধিকে বরাবর মাড়িয়েই যেতে অভ্যস্ত। দেশের একটি রেডিয়ো ওয়েভ প্রস্তুতকারী সংস্থা জগদীশ বোসকে উপদেষ্টা হিসেবে মোটা টাকা অফার করল। লোভনীয় সে প্রস্তাব বিজ্ঞান গবেষণার স্বার্থে সবিনয় প্রত্যাখ্যান করলেন জগদীশচন্দ্র! তিনি বঙ্গসন্তান, সোনালোভী স্প্যানিশ নন। বাঙালি এল-ডোরাডো খোঁজে না, তৈরি করে।

ধুলো থেকে সোনা তৈরির ইতিহাসে প্রেসিডেন্সি কলেজের দুই ক্লাসমেটের কথা বলতেই হয়। এক জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের সেই অধ্যাপক, কোয়ান্টাম স্ট্যাটিসটিক্সে যাঁর থিয়োরির সূত্র ধরেই এত বছর পরে সার্ন গবেষণাগারে ‘ঈশ্বরকণা’ তোলপাড় ফেলেছে গোটা বিশ্বে। উত্তর কলকাতায় বসে বিন্দুমাত্র পরিকাঠামোর পরোয়া না করে সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর পেপার ‘প্ল্যাঙ্কস ল অ্যান্ড হাইপোথিসিস অব লাইট কোয়ান্টা’ পাঠিয়েছিলেন জার্মানিতে আইনস্টাইনের কাছে পদার্থবিদ্যার জার্নাল ‘সাইটক্রিফট ব্যুর ফিজিক’-এ ছাপানোর জন্য। বাকিটা ইতিহাস। ধুলোকণা থেকে সোনা বলি কেন, ঈশ্বরকণার ইতিহাস।

তাঁর ক্লাসমেট আর এক স্বর্ণপ্রসবী বঙ্গসন্তান মেঘনাদ সাহার জীবনটাই তো শূন্য থেকে শুরু করে উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছনোর ইতিহাস। পূর্ববঙ্গে দারিদ্রের তাড়নায় তাঁর বাবা চেয়েছিলেন মেঘনাদ পড়াশোনা ছেড়ে পরিবারের ছোট দোকানটার দায়িত্ব নিন। কিন্তু মেঘনাদ দায়িত্ব নিলেন গ্রহ-নক্ষত্রের গঠন, তাপমাত্রা মাপার। আজও পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম মাপকাঠি এ বিষয়ে তাঁর থিয়োরি। আর এক বঙ্গসন্তান প্রফুল্লচন্দ্র রায় তো কলকাতার জীর্ণ এক ল্যাবে বসে এক অস্থায়ী যৌগই তৈরি করে ফেললেন স্থায়ী পরিকাঠামোহীনতার মধ্যে। বাঙালি ধুলো বোঝে, সোনা বোঝে, প্রফুল্লচন্দ্র দেখালেন— ব্যবসাও বোঝে।

দীর্ঘদেহী আর এক বাঙালি আবার গোটা জীবন ধরে তামাম দুনিয়াকে তাক-লাগানো ম্যাজিক দেখিয়ে গেলেন। ম্যাজিক, সেলুলয়েডে। পয়সাকড়ি নেই। কখনও সোনার গয়না বন্ধক রেখে, কখনও সরকারি আনুকূল্যে ছবি হচ্ছে। শুটিং চলছে— পয়সা ফুরোলে থামছে— পয়সা এলে ফের চালু— আবার থামা— এ ভাবেই চলল। অথচ যে শিল্পটি সৃষ্টি হল, তার একটা কণাতেও নেই কোনও মালিন্য, ক্লান্তি, অমনোযোগের আঁচড়, পুরোটাই সপ্রতিভতা ও প্রতিভায় ঝকঝক করছে! পরে, যখন বিশ্ববন্দিত হয়েছেন, কলকাতার স্টুডিয়োতেই কাজ করে গেছেন। যেখানে যখন-তখন লোডশেডিং হয়, ট্রলি গর্তে পড়ে লাফিয়ে ওঠে! আর সেখানে বানানো নিখুঁত ছবি ঝলমলিয়ে উঠেছে কান, বার্লিন, ভেনিসের পরদায়!

বঙ্গদেশে স্বাধীন রাজা থাকলে বোধহয় বাংলা ফিল্মের সোনালি এ অভ্যুত্থানের বেশ কয়েক দশক আগেই ধুলোমাখা এগারো জোড়া পা সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিতে চাইতেন। ১৯৪৮-এর লন্ডন অলিম্পিকের পর নাকি বাকিংহাম প্যালেসে এক ভোজসভায় তৎকালীন ইংল্যান্ডেশ্বরী শৈলেন মান্নার পা দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রশ্ন ছিল: খালি পায়ে ওই বঙ্গসন্তান, স্টাড লাগানো বুট-পরা ফুটবলারদের নাস্তানাবুদ করেন কী করে? রানিসাহেবার জানা ছিল কি না জানা যায় না, যে বছর ঐক্যবদ্ধ প্রবল আন্দোলনের কাছে পরাস্ত হয়েছিল প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গ, সে বছরই খালি পায়ে ফুটবল মাঠে গোরাদের পরাস্ত করেছিল এগারো জন বঙ্গবীরপুঙ্গব। বাঙালির সেই প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া। সোনার দিনের স্বপ্ন দেখা শুরু। ১৯১১। সোনার সময়।

শূন্য থেকে সোনার স্বপ্ন দেখেছিলেন আর এক প্রায়-বিস্মৃত বঙ্গসন্তান। তবে সে স্বপ্নের পরতে-পরতে মিশে ছিল জিভের জল-ঝরানো গুড়— গৌড়বঙ্গের গৌরব। উর্বর উদ্ভাবনী শক্তির রসসিক্ত রসায়নে ফেলে দেওয়া দুধ থেকে ছানা, আর সেই ছানা থেকে ‘মাখা’— সন্দেশের পূর্বসূরি। বলতে দ্বিধাহীন, এ-ও আবিষ্কার। এ-ও ধুলো থেকে সোনা। ভীমচন্দ্র নাগের বাবা পরাণচন্দ্র নাগ হুগলির জনাই গ্রামে যে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন, তার কদর আজও বাঙালির ঘরে-ঘরে। রাজা রামমোহন রায়, রানি রাসমণি হয়ে স্যর আশুতোষ— মনীষীদের রসনা-তৃপ্তির কর্তব্য কম কৃতিত্বের নাকি? ১৮২৬-এ পরাণবাবুর তৈরি বউবাজারের ছোট্ট এক দোকানঘরে শুরু হয়েছিল বাঙালির মিষ্টি-ইতিহাসের সোনালি দিন, যার উত্তরাধিকার বহন করে ১৮৬৮-তে নবীনচন্দ্র দাসের রসগোল্লা আবিষ্কার আর তাঁর একমাত্র পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র দাসের ১৯৩০-এ জোড়াসাঁকোয় ছোট একটা দোকান খোলা। আবার বাঙালির ধুলো থেকে সোনা আনার চেনা গল্প। শ্রীরামকৃষ্ণ শুনলে হয়তো বলতেন: সোনা মাটি, মাটি সোনা।

তবে বাংলার সব সোনার ছেলের মূল্যায়ন কি হয়েছে জীবদ্দশায়? বরং যন্ত্রণা পেয়ে-পেয়ে অভিমানে ধুলো হয়ে মাটিতে মিশে যাওয়ার ইতিহাসও তো রয়েছে সোনার মুদ্রার উল্টো পিঠে। প্রথম টেস্টটিউব বেবি দুর্গা-র মানসপিতা ডা. সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও তো পরিকাঠামোহীন এক শূন্যতা থেকে প্রায় পৌঁছে গিয়েছিলেন বিজ্ঞান সাধনার উৎকর্ষের চূড়ায়। তবু অন্যায়ের অভিঘাত সহ্য না করতে পেরে অভিমানে পৃথিবী ছাড়েন এই বঙ্গীয় চিকিৎসক, চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব আবিষ্কারও মানবিক শিল্প হয়েছিল যাঁর হাত ধরে।

শেষে এক শিল্পীর কথা বলি। কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় সূর্যের আলো না-ঢোকা এঁদো গলির ছোট্ট বাড়ির ঘুপচি ঘরে তার শিল্পসাধনা— বছরের পর বছর। যখন রং-তুলি-ক্যানভাসের অসাধারণ সে জগতের খোঁজ পেল বহির্বিশ্ব, তার পর শুধু মুগ্ধতা আর তারিফ! জীবনের শেষ ক’বছর ছাড়া তাঁর গোটা জীবনই আত্মমগ্ন শিল্পীর সেই গাড়ি-না-ঢোকা এঁদো গলিতেই পায়ে হেঁটে, ভেজা কাপড়-মেলা দড়ির ছোঁয়া বাঁচিয়ে মাথা নিচু করে আসতে হয়েছে কোটিপতিদের— ছবি দেখতে, ছবি কিনতে, বছরের পর বছর। গণেশ পাইন। শিল্পসৌকর্ষের মিডাস-ছোঁয়ায় ধুলো থেকে সোনা-রূপান্তরের আর এক কারিগর, অনন্য এক জীবনশিল্পী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন