নাটক রক্তে, তাই সবাই স্বজন বহরমপুরে

স্বজন-দুর্জন নেই। সকলেই নাট্যজন....নাটকের আপনজন। এই সমীকরণটাই বহরমপুরকে এখন বাংলা নাটকের আকাশে রকেটের মতো তুলে আনছে। মঙ্গলবার শহরের রবীন্দ্রসদনে ঋত্বিক নাট্যগোষ্ঠীর ১৪তম ‘দেশবিদেশের নাট্যমেলা’ প্রদীপ জ্বালিয়ে উদ্বোধন করলেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চ থেকে ঘোষক জানালেন, আমাদের শহরে নাট্যমেলার উদ্বোধনে এটি তাঁর দ্বিতীয় আগমন।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:১৫
Share:

নাট্যোৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটি মুহূর্ত। ছবি: গৌতম প্রামাণিক

স্বজন-দুর্জন নেই। সকলেই নাট্যজন....নাটকের আপনজন। এই সমীকরণটাই বহরমপুরকে এখন বাংলা নাটকের আকাশে রকেটের মতো তুলে আনছে। মঙ্গলবার শহরের রবীন্দ্রসদনে ঋত্বিক নাট্যগোষ্ঠীর ১৪তম ‘দেশবিদেশের নাট্যমেলা’ প্রদীপ জ্বালিয়ে উদ্বোধন করলেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চ থেকে ঘোষক জানালেন, আমাদের শহরে নাট্যমেলার উদ্বোধনে এটি তাঁর দ্বিতীয় আগমন। দিন কয়েক আগে বহরমপুর রেপার্টরি থিয়েটারের মুক্তমঞ্চ নাট্য উৎসবও শমীকবাবুর হাত দিয়েই প্রথম প্রদীপের ছোঁয়া ফেলেছিল। কলকাতা শহরে এক নাট্যদল কখনও আর এক দলের কথা বলে না, কে ‘নাট্যস্বজন’ আর কে দুর্জন, কে ডেট পাবে আর কে পাবে না সেই আকচাআকচিতেই অকাদেমি-রবীন্দ্রসদন বহুধাবিভক্ত। বহরমপুরে এখনও দলের আগে শহর!

Advertisement

এই স্পিরিটটাই আজকের বাংলা বাজারে ব্যতিক্রমী। ঋত্বিকের এই নাট্য উৎসবের আগে নভেম্বর-ডিসেম্বরে এ শহরে রঙ্গাশ্রম, রেপার্টরি থিয়েটারের নাট্য উৎসব হয়ে গিয়েছে। শীতের শেষে ফেব্রুয়ারিতে ‘যুগাগ্নি’ দলের উৎসব। বড় স্পন্সর, মন্ত্রী-নাট্যকার, সাংসদ-পরিচালক বা বিখ্যাত নায়কনায়িকা ছাড়াই একটা শহরে এতগুলি উৎসব হয় কী ভাবে? কেন্দ্রীয় সরকারের ফেস্টিভ্যাল গ্রান্ট, স্থানীয় সংস্থাগুলির বিজ্ঞাপন রয়েছে। সেটি সব নাট্য উৎসবেই থাকে। কিন্তু বহরমপুরে আরও একটি জিনিস রয়েছে। দর্শক-আনুকূল্য। নাট্য উৎসবের শুরুর দিনই রবীন্দ্রসদন ভিড়ে জমজমাট। পরিচালক ও অভিনেতা কৌশিক সেন কলকাতায় বসে বলছিলেন, “বহরমপুরের আসল সাফল্য কোথায় জানেন? দলগুলি দর্শক তৈরি করতে পেরেছে।”

দর্শক তৈরির একটি কারণ ইতিহাস। “নাটক আমাদের রক্তে,” বলছিলেন রেপার্টরি থিয়েটারের প্রদীপ ভট্টাচার্য। তাঁর উদ্যোগেই এ বার রেপার্টরি থিয়েটার পালন করেছে বিজন ভট্টাচার্যের শতবর্ষ। মনীশ ঘটক, ঋত্বিক ঘটক থেকে মহাশ্বেতা দেবী, বিজন ভট্টাচার্য বহরমপুরের সন্তান, সত্য। তার চেয়েও বড় সত্য, দু’ একটি উদ্যোগ ছাড়া কলকাতা নাট্যজগৎ ভুলে গিয়েছে নবান্ন নাটকের স্রষ্টার শতবর্ষ। বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র অনেক আগের ঘটনা। কিন্তু হাল আমলে অলকানন্দা রায়ের উদ্যোগে নাইজেল এবং কারাবন্দিদের নিয়ে নাটকেরও আগে ২০০৬ সালে প্রদীপবাবুই প্রথম বহরমপুর জেলের বন্দিদের নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করেন। বাংলা কেন, সারা ভারতে সেটিই প্রথম এ ধরণের উদ্যোগ। ‘মুক্তধারা’র কলকাতা খেয়াল রাখেনি।

Advertisement

নাটক কী ভাবে দর্শক তৈরি করে? প্রোডাকশনের জাঁকজমকে নয়, আঙ্গিকের কেরদানিতে নয়। মানুষের প্রতি বিশ্বস্ততায়। বহরমপুরের নাট্যদলগুলির অনেকেই স্বীকার করেন, বন্ধুবান্ধবদের সূত্রে তাঁদের কাছেও এসেছে ব্রাত্য বসু-অর্পিতা-মণীশ মিত্রদের নাট্যস্বজনে নাম লেখানোর প্রস্তাব। “কিন্তু আমরা যাইনি। স্বজন-দুর্জন নিয়ে মাতামাতি নয়, নাটকটাই মুখ্য। এখন কলকাতায় কথা বলতেও ভয় লাগে। কারও সঙ্গে এমনিই কথা বলছি, অন্য জন আড়াল থেকে দেখে ভাবল, ও তা হলে পেটে পেটে এই দল,” বলছিলেন ঋত্বিকের মোহিতবন্ধু অধিকারী। ব্রাত্য, অর্পিতা, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়রা বছর দুয়েক আগেও এখানে তাঁদের নাটক নিয়ে এসেছেন, নাট্যজগতের বন্ধুত্বসূত্রে আদানপ্রদানও রয়েছে। কিন্তু কলকাতার নাট্যদুনিয়া আমরা-ওরায় হেলে বহরমপুর আজও অটল।

রাজনীতিকদের চাপ আসে না? প্রায় প্রত্যেকে এক বাক্যে বলছেন, না। বহরমপুরে অন্তত নাট্যক্ষেত্রে রাজনীতিকদের নাক গলানোর রেওয়াজ নেই। মোহিতবন্ধুবাবুর নাট্যদল ঋত্বিক যে গৌতম রায়চৌধুরীর হাতে শুরু, তিনি বরাবরের বামপন্থী। ঋত্বিকের নাট্য উৎসব যেখানে হচ্ছে, সেই রবীন্দ্রসদনের উল্টোদিকেই বহরমপুর পুরসভার সৌজন্যে তৈরি সাংস্কৃতিক অঙ্গন। গত বছর এই অঙ্গন উদ্বোধন করেছিলেন অধীরবাবু। সেখানে ঋত্বিক ঘটক, গিরিজা শংকরের পাশাপাশি গৌতম রায়চৌধুরীরও মুখ। যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধনে সত্যজিৎ, ঋত্বিক, তপন সিংহ আউড়ে বরাবর মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদারের নাম পাশ কাটিয়ে যান, সেখানে বহরমপুর বিচ্ছিন্ন বদ্বীপই বটে!

ব-দ্বীপ? সদর কলকাতার নাট্যজগতে প্রথম আলো এসেছিল এই বহমপুরের সৌজন্যেই। পাইকপাড়ার রাজারা আদতে ছিলেন কান্দিরই বাসিন্দা। তাঁদের বাড়িতে নাট্যাভিনয়ের জন্যই বাংলা ভাষায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রথম নাটক লেখা। বাংলার নাট্য-রাজনীতিতে এই ইতিহাসটি হতেই পারে আলোকবর্তিকা। তবে কি নাটক নিয়ে বহরমপুর আজ যা ভাবে, কলকাতা আগামী কাল সেটিই করে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন