নেশার রাজ্যে পৃথিবী ফেসবুকময়

এ নেশা তো ড্রাগস বা অ্যালকোহল আসক্তদেরও লজ্জা দিতে পারে। কী ভাবে? উত্তর খুঁজলেন অদিতি ভাদুড়িঅক্টোবর ২০১৩। তার পর ফেব্রুয়ারি ২০১৪। খবরের কাগজে বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খবরগুলো দেখে নড়েচড়ে বসেছিল সবাই। দুই জেন ওয়াই মেয়ে দেশের দুই প্রান্তে আত্মহত্যা করে বসলেন। কারণ? অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহার করা নিয়ে বাড়ির সঙ্গে ঝামেলায় এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে কিছুমাত্র দেরি করেননি তাঁরা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৪ ০০:০৫
Share:

অক্টোবর ২০১৩। তার পর ফেব্রুয়ারি ২০১৪। খবরের কাগজে বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খবরগুলো দেখে নড়েচড়ে বসেছিল সবাই। দুই জেন ওয়াই মেয়ে দেশের দুই প্রান্তে আত্মহত্যা করে বসলেন। কারণ? অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহার করা নিয়ে বাড়ির সঙ্গে ঝামেলায় এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে কিছুমাত্র দেরি করেননি তাঁরা।

Advertisement

এ বড় আজব বালাই

Advertisement

পরিসংখ্যানের ঝাঁপি খুললে দেখা যাবে বিশ্বের নানা প্রান্তেই সোশ্যাল মিডিয়া এ রকম নানাবিধ আনসোশ্যাল কার্যকলাপ বেশ সশব্দে ঘটিয়ে চলেছে। এক নামজাদা পুরুষ ম্যাগাজিনের এডিটর ভদ্রলোক তাঁর অতিরিক্ত ট্যুইটার প্রীতির কারণে শুধু যে তাঁর চাকরিটাই খোয়ালেন তা নয়। তাঁর স্ত্রী-পুত্রও তাঁকে ত্যাজ্য করতে পিছপা হলেন না।

বা ভাবতেই পারেন ওয়েস্ট হ্যাম্পস্টেডের ১৫ বছরের ফুটফুটে সেই কিশোরীর কথা, যার থেকে মোবাইল, ইন্টারনেট সংযোগ কার্যত কেড়ে নেওয়ায় ট্রেনের তলায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। সে তার মাকে জানিয়েছিল অনলাইনে, বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে প্রায় ১৮০০০ লোক তাকে ভালবাসে। সেটার জন্যই তাকে অনলাইনে থাকতে হয়।

তা-ও বাবুনের জন্মদিনে তার উচ্চপদস্থ কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ বাবা আর শিক্ষিকা মা তাকে ট্যাব উপহার দেওয়ার সময় বিন্দুমাত্রও চিন্তা করেননি। “এখন নেট স্যাভি না হয়ে তো উপায়ও নেই। স্কুলের প্রজেক্ট, অনলাইন ক্লাস ছেলেমেয়েদের আর কত আটকানো যায়!” বললেন ব্রতীন মিত্র। ডিপিএস স্কুলপড়ুয়া বাবুনের বাবা।

বড় অবুঝ এ মন

‘সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাডিকশন’ নামের এই ব্যাধি তাই নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়েই চলেছে। টুয়েলভের পড়ুয়া সৃজনের মা অনসূয়া চাকরি করেন এক বহুজাতিক সংস্থায়। চুপচাপ স্বভাবের, পড়াশুনোয় ভাল ছেলে, বাড়ির বাইরে বেরোয় কম। বদসঙ্গে পড়া, নেশাভাঙ করা, এ সব না-করা নিয়ে নিশ্চিন্তই ছিলেন অনসূয়া। ছেলের নেশার মধ্যে খালি খেলা দেখা আর ইন্টারনেট করা। কথায় কথায় জানালেন, “আমার এক বন্ধু একদিন অফিসে দেখাল ফেসবুকে পরের পর ছেলের প্রোফাইল পিকচার। মিনিটে মিনিটে ছবি বদলে গিয়েছে ও। বাড়ি ফিরে দেখতাম মন দিয়ে ফেসবুক, ট্যুইটার বা ইন্সট্যাগ্রাম করছে। নিজের এক আপনভোলা জগতে থাকত সব সময়।” অনসূয়া তাঁর স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করে ছেলেকে এক বিহেভিয়ার থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছেন। ট্রিটমেন্ট চলছে ওর।

এ নেশা কী যে নেশা

ভেবে দেখুন তো, হাতে সর্বক্ষণের সঙ্গী ফোনটাকে নেড়েচেড়ে সারা দিনে কতবার লগ ইন করেন ফেসবুক-ট্যুইটারে। মিনিটে মিনিটে কত বার চেক করে নেন, আপনার পোস্টে কতগুলো ‘লাইক’ পড়ল। বা ইন্সট্যাগ্রামে পোস্ট করা ছবিগুলোর কথাও ভাবুন না। কাজেকর্মের সূত্রে সারা দিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় যাঁদের অবাধ যাতায়াত, তাঁদের সেই অভ্যেসটা কাজ ফুরোলেও থেমে থাকে না। “মোবাইল ফোন এমনিতেই আমাদের ইনডিভিজুয়ালিস্টিক করে দিয়েছে। তার মধ্যে স্মার্ট ফোন এসে প্রত্যেককে যার যার জগতে ঠেলে দিয়েছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোর কল্যাণে আমরা তো এটা ভুলতেই বসেছি আমরা সমাজবদ্ধ জীব। আর হ্যাঁ, নেশাটাও তো মারাত্মক!” বলছিলেন সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়। কথা প্রসঙ্গে আরও জানালেন এখন স্মার্টফোনের স্ক্রিন ছেড়ে তো আশেপাশে কী ঘটছে, তা দেখার কোনও সুযোগই নেই এ প্রজন্মের। অদ্ভুত একটা জগতে বাস করেন এই ‘নেশাখোরে’রা। “আমি ক্লাসে পড়াচ্ছি। তার মধ্যেই দেখি ফোনে ফেসবুক বা হোয়াটস্অ্যাপ করে চলেছে। চাইলেই কিন্তু ক্লাস থেকে বের করে দিতে পারি এদের। বলেওছি কখনও কখনও। উত্তরে বলেছে, আমি কি ক্লাসকে ডিস্টার্ব করছি? বা হোয়াটস রং ইন ডুয়িং ইট...,” আবারও বলেন প্রশান্ত বাবু।

যেন কিছু মনে কোরো না...

ঘন ঘন ফোন চেক করে স্টেটাস আপডেটে বা পোস্টে ক’টা লাইক পড়ল, সেটা দেখার অভ্যেস তো পুরনো হয়ে গিয়েছে। শুরু হয়েছে সেল্ফি কম্পিটিশন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় কে কতগুলো সেলফি পোস্ট করল আর তাতে কতগুলো লাইক পড়ল এটাই এখন ট্রেন্ড। মিডিয়া হাউসে কাজ করা পাপিয়া বলে, “আমাদের জেনারেশন এক তো যথেষ্ট সেল্ফ কনশাস। দিনের বারো-তেরো ঘণ্টা অফিসকে দেওয়ার পর ফ্যামিলি লাইফ বলে কিছু আর থাকে না। এটাও সোশ্যাল মিডিয়ায় হুকড্ হওয়ার একটা কারণ।”

পাপিয়ার কথার সমর্থন মিলল মনস্তত্ত্ববিদ ডা. জয়রঞ্জন রামের কথাতেও। “আমরা তো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোর দৌলতে অসম্ভব নার্সিসিস্টিক হয়ে পড়েছি। লক্ষ করে দেখবেন, সবাই কেমন একটা আনরিয়েলিস্টিক ওয়ার্ল্ডে বাস করি আমরা। নিকটাত্মীয়, বাড়ির মানুষগুলোর থেকে কতটা দূরে সরে গিয়েছি। হ্যাঁ, সম্পর্ক ভাঙছে। কিছু তো করার নেই।” তবে ডা. রাম আরও একটা মজার তথ্য দিলেন এ প্রসঙ্গে। “জানেন স্বামী-স্ত্রী, নিজেদের ভেতর সম্পর্ক খুব খারাপ। তা-ও ফেসবুক, ট্যুইটার এ সব নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সম্পর্ক টিকে রয়েছে এমন ব্যাপারও ঘটছে!” দুন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রিয়া বসু জানান, “আমার হাজব্যান্ড বাইরে থাকে। ফেসবুকে বা স্কাইপেই যোগাযোগ রাখি আমরা। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো তো এই কারণেই এত জনপ্রিয় হয়েছিল। যদিও এখন অ্যাডিকশন ছাড়া কিছুই নয়।”

‘নো হার্ম ইন নেটওয়ার্কিং’ বিশ্বাস এই প্রজন্মের। “আমরা তো কাজে ফাঁকি দিচ্ছি না। বরং উই আর মাল্টিটাস্কিং,” জানালেন সোফিয়া। এক নামজাদা কলেজের মাসকমিউনিকেশন প্রথম বষের্র ছাত্রী। সোফিয়া, বা যাদবপুরের নীলাঙ্কুর-অভিপর্ণারা যখন ঘুমোতে যায়, ফোনটা মাথার কাছেই রাখা থাকে। ঘুমের মধ্যে কোনও এক ‘পিং’টোনে আচমকাই ওদের ঘুম ভেঙে যায়। বা ঘুম ভেঙে উঠে চোখ ডলতে ডলতেই খুলে ফেলে ফেসবুক বা হোয়াটস্অ্যাপ। কার কী স্টেটাস আপডেট, কে কী ছবি পোস্ট করল বা বৃষ্টির সকালে প্রথম মনসুন আপডেটটা কে পোস্ট করবে, তা নিয়েও বেশ একটা ভার্চুয়াল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতে থাকে ওদের মধ্যে।

এর কি কোনও ইতি আছে? উত্তরটা দিলেন সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়। “যত দিন যাবে ততই বাড়বে ব্যাপারটা। এখন ফ্রি সোসাইটিতে থাকছি আমরা।

কেউ কোনও কমিটমেন্টে যেতে নারাজ। এই নেশাড়ুরা কিন্তু নিজেদের নিয়ে নিজেরা মেতে রয়েছে। নিজেদের লাইকস, ডিজলাইকস, কোথায় যাচ্ছি, কী পরছি। যে সময়টা এ সবের পিছনে দেওয়া হয়, সেটা একেবারেই আনপ্রোডাকটিভ। সোমালিয়ায় দুর্ভিক্ষ, পলিটিক্যাল অ্যাজেন্ডা এ সব নিয়ে কোনও মাথাব্যথাই নেই এদের,” বলেন তিনি।

এখন আর কেউ মাথা খাটাতে রাজি নয়। মিনিটে মিনিটে সবাই বোর ফিল করলেই ভাবে চলো, একটু ফেসবুক চেক করে নিই। বা ট্যুইট করি
পার্নো মিত্র

ছবি আপলোড করা, ট্যুইট করা আমার অভ্যেস। তবে হ্যাঁ, ফোনটা কাছে না থাকলে ভাবি কী যেন একটা নেই! স্পেশাল চার্জার তাই রাখতেই হয়
অঙ্কুশ

আমি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাডিক্ট কখনওই নই। ফোনটা ঘনঘন চেক করা যদিও আমার অভ্যেস। এমনও হয়েছে তিন দিন বাদে বিবিএম চেক করেছি
মিমি

নেশাড়ু যখন...

• গেট টুগেদারে দেখা বন্ধুর সঙ্গে। আপনি তাঁকে তাঁর ফেসবুক বা ট্যুইটার হ্যান্ডলের নামে সম্বোধন করলেন। তাঁর আসল নামটা দেখা গেল মনেই করতে পারছেন না।

• বাচ্চাকে ঘুম পাড়াচ্ছেন। অথচ গল্প বলার বদলে আপনার চোখ ব্যস্ত স্মার্টফোনের স্ক্রিনে। হয়তো ইন্সট্যাগ্র্যামে ট্যাগ করছিলেন কোনও এক বন্ধুকে। বাচ্চা যারপরনাই বিরক্ত।

• আপনি পোস্ট করেছিলেন কিছু একটা। চেক করতে গিয়ে দেখলেন কোনও লাইক বা কমেন্টস পড়েনি সেই পোস্টে। ডিলিট করে দিলেন সেই পোস্ট। এ রকম হয়তো অনেক সময় ঘটছে।

• হঠাৎ দেখলেন ফোনটা ধুঁকছে। চার্জ শেষ। মনে হল চোখে অন্ধকার দেখছেন।

• বাইরে বেড়াতে যাচ্ছেন। কিন্তু আপনার চিন্তা সিগন্যালটা ঠিক পাবেন তো! ইন্টারনেট কানেকশনটা ঠিকঠাক থাকবে তো! ব্যাগে কী ঢোকালেন, ওষুধগুলো নিয়েছেন কিনা, সে সব নিয়ে কিন্তু অত হুঁশ নেই আপনার।

• যে কাজই করুন না কেন, আপনার মন পড়ে থাকে নোটিফিকেশনের দিকে। নোটিফিকেশন পেলেই মনটা ভরে ওঠে আপনার। আর না পেলেই ফাঁকা ফাঁকা...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন