বাঙালির মৃত্যু হয়েছে... বাঙালি অনুকরণ করে মরেছে

হাসির গল্প লিখবেন ভেবে লেখেননি। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন জীবনের গন্ধ-মাখা লেখা। গরমের এক দুপুরে তাঁর মুখোমুখি স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়হাসির গল্প লিখবেন ভেবে লেখেননি। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন জীবনের গন্ধ-মাখা লেখা। গরমের এক দুপুরে তাঁর মুখোমুখি স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৯
Share:

আপনার বাড়িতে আসতে গিয়ে মনে হচ্ছিল বরানগরের প্রাচীন অঞ্চল, উত্তরের গঙ্গা, এই স্থান মাহাত্ম্য নিয়েই আপনি বেঁচে আছেন একটা মোবাইল পর্যন্ত সঙ্গে রাখেন না, বাড়ির ফোনেও পাওয়া যায় না। আজকের জীবনে এ ভাবে বাঁচেন কেমন করে?

Advertisement

আমি ভারতীয়তায় বাঁচি। আমি বলতে গেলে একটু ডিটেলেই কিন্তু বলব। আশা করি বোর হবেন না।

Advertisement

নাহ্ বলুন..

ভারতীয়তায় বাঁচা মানে এখানকার মাটি, জল, হাওয়া, সংস্কার, পোশাক, সঙ্গীত নিয়ে বেঁচে থাকা। ভোরের সূর্য না দেখলে, সূর্যের আলো মাখা গঙ্গার গেরুয়া রং না দেখলে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়। অথচ এখন তো যে যত দেরি করে ঘুম থেকে উঠবে সে তত বড় ইন্টেলেকচুয়াল! পোশাকের কথাই ভাবুন, সাহেবরা আমাদের দেশে এসে ঢিলেঢালা পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আমরা গরমে পুড়তে পুড়তে স্লিম ফিট প্যান্ট পরছি। আমি স্লিম ফিট প্যান্ট পরে, মোবাইল হাতে দুপুর বারোটায় সকাল শুরু করতে পারব না, তেমন করলে মনে হবে আমি নিজেকে ধ্বংস করে দিচ্ছি। প্রতিটি দিন নতুন কিছু দেখতে চাই আমি।

আজ নতুন কী দেখলেন?

লোকে যতই শীতের কথা বলুক, আমি ভয়ঙ্কর উত্তাপ ভালবাসি। গরমকালের দুপুরে আজ দেখছিলাম কেমন খস খস শব্দে ঝরা পাতারা মাটি ছুঁয়ে যাচ্ছে। দেখলাম ভোরের আলোয় স্নান করছে পশ্চিমের বেলুড় মঠ। প্রসন্নতা! পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে? এই দেখার প্রেমেই বেঁচে আছি। আমেরিকায় গেলেও মনে হয় কবে সেই বরানগরের কুঠিঘাটে যাব? চতুর্দিকে সাত্ত্বিক শান্তি। ঘণ্টাধ্বনি, জলের শব্দ...

আপনার রোজের দিন কেমন করে কাটে?

রামকৃষ্ণ মিশনের অনুষ্ঠানে আমায় প্রায়ই আজকাল বেরিয়ে পড়তে হয়। ক্যালেন্ডারে গোল গোল করে দাগ দিয়ে রাখি সেই বেরিয়ে পড়ার দিনগুলোয়। যেখানেই যাই না কেন, আমি জানি কোথাও না কোথাও খোলা জায়গা পাব, বাগান পাব আর একদল মানুষ পাব যারা সংসারের কথা বলবে না।

আর বাড়িতে থাকলে?

ঘুম ভেঙে বাড়িতে তিনতলার ওপরে ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে উঠলে একটা শিব ঠাকুরের মন্দির আছে, ওই জায়গাটায় যাই। ওটা আমার সব চেয়ে প্রিয় জায়গা, কারণ ওখানে একটা ওয়াশ বেসিন আছে সেখানে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পুবের নীল আকাশে পায়রা দেখতে পাই। ওখানেই স্নান সেরে শিবের মাথায় জল ঢালা যায়। এর পর আরেকটু নীচে নামি, তিনতলায় আমার লেখার ঘরে, সেখানে পাখা নেই কিন্তু। ওখানে একটু লিখে নিয়ে পাশে পুজোর ঘরে যাই। ওখানে ছাদে প্রচুর রেয়ার গাছ এনে রেখেছি। পশ্চিমের বারান্দাটাও আমার প্রিয়। ওখানে যে বেলগাছ আছে, তার নাম দিয়েছি হরগৌরী। ওর ফাঁক দিয়ে গঙ্গা দেখি। ওখানেই প্রচুর পাখি আর কাঠবিড়ালিকে ঝুরিভাজা খাওয়াতে হয় আমায় রোজ। ওখানেই বসে বসে রেডিয়োয় নানা খবর শুনি। এ ভাবেই কেটে যায়।

আপনার হাসির গল্পেরা ‘ঘেঁটে ঘ’ নাম নিয়ে এখন মেগা সিরিয়ালে। এই জীবনে মেগা সিরিয়াল কেমন করে চলে এল?

আমি যদি মানুষ না হয়ে একটা প্রোডাক্ট হতাম? আমি ভাবি আমি একটা মেটিরিয়াল, আমি একটা প্রসেসিংয়ের মধ্যে আছি। সেটা যে ভাবে নিয়ে যায় আমি চলি। লেখা না থাকলে পড়ি, পড়া না থাকলে লিখি, চকোলেট খাই, পাখি দেখি। একঘরে একটা বিষয় লিখতে গিয়ে মনে পড়ে অন্য ঘরে খোলা খাতায় একটা অংশ যোগ করতে হবে। ছুটে যাই। রাতে শুতে গিয়েও মনে হয় না সময় অপচয় করেছি আমি।

এই লেখা পড়ার ব্যস্ততায় সিরিয়ালটা দেখছেন?

দেখেছি, প্রথম দিকের কয়েকটা এপিসোড। অবশ্য লোকে এসে খুব বলছে আমায় যে তাদের ‘ঘেঁটে ঘ’ ভাল লাগছে।

বাংলাদেশেও তো আপনার ‘লোটা কম্বল’ নিয়ে সিরিয়াল হচ্ছে...

হ্যা।ঁ ওরা কিন্তু খুব সিনসিয়ার। এখানে ডেপথ্-টা কম।

এ রকম মনে হয়েছে কি ‘ঘেটে ঘ’ আপনার গল্প থেকে কোথাও সরে এসেছে?

নাহ। তা হয়নি। আসলে নিজের গান, বলা আমি কোনও দিন শুনতে চাই না। মনে হয় ইশ! কী বাজে! আর সন্ধেবেলা যে সময়টা ‘ঘেঁটে ঘ’ সম্প্রচার হচ্ছে, সেটা আমার পুজোর সময়। তবে লোকে খুব মজা পাচ্ছে, হাসছেও এটা শুনে মনে হচ্ছে আবার দেখি একটু।

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বললেও লোকের মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে। হাসির গল্প লিখতে কী লাগে?

আমি কোনও দিনই হাসির গল্প লিখব ভেবে কিছু লিখিনি। আমি জীবনের কথা লিখতে চেয়েছি। অঙ্গভঙ্গি, ক্যারিকেচার করে লোক হাসানো যায়। কিন্তু লিখে হাসি ফোটানো একটু শক্ত কাজ। শিব্রাম চক্কোত্তির পানিং নিয়ে অনেকেই নাক কুঁচকেছেন। দেখাক না কেউ ও রকম করে! আনন্দ পাবলিশার্স থেকে ‘শ্বেতপাথরের টেবিল’ গল্পগ্রন্থটি যখন বেরলো তখন বিজ্ঞাপনে বলা হল এটি একটি হাসির সংকলন। অথচ ওই লেখায় যেমন হিউমারাস অ্যাপ্রোচ আছে, তেমনি সিরিয়াস অ্যাপ্রোচ আছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? হাসির লেখক হয়ে ফেঁসে গেলাম আমি।

ফেঁসে গেলাম কেন মনে হচ্ছে? হাসির লেখক কি সামনের সারির লেখক বলে বিবেচিত হন না?

আমার পাঠকদের কথা আলাদা। কিন্তু আজকের গোমড়া জীবনের কেবল দু’টো শব্দ। গন্তব্য আর মন্তব্য। ভোগবাসনা, টাকাপয়সা নিয়ে শীর্ষে ওঠার জন্য আমরা একে অপরকে গুঁতোচ্ছি। তাই লোকে হয়তো বলছে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লোককে বড্ড হাসাচ্ছেন। ব্যাটা জানে না এখন হাসির গল্প লেখার দিন নয়।

আপনি কি গল্প লেখেন? নাকি জীবনের কথা বলেন?

আমার জীবন খুব উত্তেজনাপূর্ণ জীবন নয়। আমি তো কাউবয়ের জীবন কাটাইনি। আমাকে আমার গল্পের নায়ককে দিয়ে গুলি চালাতে হলে সেটা কল্পনা দিয়েই করতে হয়। যখনই দেখা যায় তা আমার জীবনের সঙ্গে মিলছে না, তখনই লোকে বলে গল্প! এই গল্প-গল্প কাহিনি কিন্তু একটা গালাগাল। আমি তো জীবন দেখে, জীবনের গন্ধ মেখে লিখতে চাই, সেটা গল্প নয়।

সেই কারণেই আপনার লেখায় পরিবার, পাড়া ফিরে ফিরে আসে?

এক সময় কারও বাড়ি গেলে মহিলারা আমায় ভিতরে ঢুকতে দিতেন না। বলতেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়কে ভিতরে যেতে দিলে অন্দরের সব কথা বেরিয়ে আসবে।

হাসির লেখকের তকমা ভাঙতেই কি আপনি পরে ধর্ম নিয়ে লিখতে শুরু করলেন?

লেখকরা যদি ধর্মের লেখা না লেখেন, তা হলে ধর্মীয় লেখা তো একপেশে হয়ে যাবে। সেই ভাবনা থেকেই আমার প্রথম লেখা ‘পরমপদকমলে’। টানা পনেরো বছর লিখে গেলাম আমি। লিখতে লিখতে দেখলাম এই রাস্তা দিয়েই আমি প্রচুর ইতিহাসের অঙ্গনে চলে যেতে পারি। নুন ছাড়া যেমন তরকারি হয় না ঠিক তেমনই ধর্ম ছাড়া জীবন চলে না।

কিন্তু মাঝের কয়েক বছর আপনাকে দেখা যায়নি কেন?

আমার স্ত্রীর ব্রেন ক্যান্সার, মৃত্যু...ভেবেছিলাম আর লিখব না। মনে আছে ‘সাধের ময়না’ লিখছি, একটা হাত ওর মাথায় তো আর এক হাতে কলম! খুব বাজে সময় গেছে তখন...আসলে প্রফেশনাল লেখক হওয়ার মতো দুঃখ আর কিছুতে নেই। সমরেশ বসু বলেছিলেন আমায়, লেখা না এলে কোনও দিনও যেন জোর করে সেক্স-এ ঢুকে পড়ো না। যদিও এখন তাই হচ্ছে। এখন বাচ্চা ছেলের সঙ্গে মায়ের কথোপকথনে মায়ের শরীরের বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে। লিখতে গিয়ে যদি সকলে এখন ভাবে বাজারে চলবে তো? তা হলে সে আর লেখা থাকে নাকি?

১৪২১ সাল আসছে। হালখাতা আর ধুতি ফতুয়ার বাঙালি কি রসাতলে যাচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?

বাঙালির মৃত্যু হয়েছে। সবজান্তা বাঙালি অনুকরণ করে মরেছে। কিন্তু বাঙালিকে কেউ আজ আর অনুকরণ করতে চায়? চায় না। আর নির্বোধ মাথামোটা বাঙালি অভিভাবকরা গর্ব করে বলছেন আমার ছেলে বাংলা বলতেই পারে না! স্বামীজি বলে গেছেন ‘সভ্যতা ধ্বংস হলে তা পুনরায় আর সৃষ্টি হয় না।’ মানববোমা আর সন্ত্রাসের পরে এখন ‘way of no return’-এ আমরা দাঁড়িয়ে।

তা হলে এখন সব বাজে? আগে সব ভাল ছিল?

নাহ্, তা নয়। এখন জীবন অনেক সহজ হয়েছে। লোকের প্রচুর টাকার মাইনে পায়। টেকনোলজি এগিয়েছে।

এখনকার রাজনীতি নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না?

দেখুন রাজনীতি নিয়ে লিখেছিলাম আমি, ‘কলকাতা আছে কলকাতাতেই’। এই লেখার জন্যেই বার বার তখন খুনের হমকি শুনে এসেছি। এখন অবস্থা আরও খারাপ। অমানুষের গণতন্ত্র। পারলে মানুষ মানুষকে কামড়ে দেবে।

অস্বস্তি হয় না? এই কারণেই কি অন্ধকারে একলা হাঁটেন আপনি?

অস্বস্তি হয়। প্রকৃতি কিন্তু যে কোনও মুহূর্তে আমাদের ধ্বংস করে দেবে। বিজ্ঞান তো তাই বলছে। আমরা তা জেনেও দিব্যি আছি। অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে দেখতে পাই আমার ভেতরটা বড্ড অসুস্থ। এখন সব কৃত্রিম হাসি...

তবে আমরা আপনার পাঠকরা কেবল ধ্বংসের অপেক্ষাতেই থাকব?

না তা নয়। মানুষকে একলাই নিজের মরুদ্যানে আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে। তার চলে যাওয়ার পরেও যেন সেই আলোয় দেশ না হোক, শহর না হোক, অন্য একজন মানুষ যাতে আলোকিত হতে পারে।

লেখালেখি ছাড়াও আপনি গান গাইতে, বাজাতে, ছবি আঁকতে, চমৎকার বক্তৃতা দিতে পারেন। এত কিছু সম্ভব হল কী করে?

লোকে পিতৃপুরুষের কাছ থেকে সোনাদানা, জমি, টাকা পায় আমি গান, বাজনা, ছবি আর কথা পেয়েছি। লিখতে না ইচ্ছে হলে এখন হারমোনিয়াম বাজাই। গান গাই। সুইচ ওভার করাটা শিখে নিয়েছি। আর জীবনে কত রং সেগুলো নিয়ে চলি...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন