ভিডিয়ো গেমসের সামনে মেসি... ড্রইংরুমে মারাদোনা

কলকাতায় মেসি এবং মারাদোনাকে আনার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল তাঁর। ভাস্বর গোস্বামী। আনন্দplus-এর জন্য কিংবদন্তি দুই আর্জেন্তেনীয় সুপারস্টারকে কাছ থেকে দেখার নানা অজানা গল্প বললেন তিনি।বাঙালি যখন কাউকে ভালবাসতে শুরু করে, সেই ভালবাসার মধ্যে অদ্ভুত এক উন্মাদনা কাজ করে। তখন কোনও প্ররোচনা বা অভিসন্ধি সেই ভালবাসাকে টলাতে পারে না। এখনও ফাইনাল বাকি। কিন্তু এই বিশ্বকাপ দেখে যা মনে হল, সাম্প্রতিক কালের কোনও ফুটবলারকে বাঙালি যদি সত্যি ভালবেসে থাকে, তিনি লিওনেল মেসি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share:

বাঙালি যখন কাউকে ভালবাসতে শুরু করে, সেই ভালবাসার মধ্যে অদ্ভুত এক উন্মাদনা কাজ করে। তখন কোনও প্ররোচনা বা অভিসন্ধি সেই ভালবাসাকে টলাতে পারে না। এখনও ফাইনাল বাকি। কিন্তু এই বিশ্বকাপ দেখে যা মনে হল, সাম্প্রতিক কালের কোনও ফুটবলারকে বাঙালি যদি সত্যি ভালবেসে থাকে, তিনি লিওনেল মেসি। এবং সত্যি বলতে কী, মেসির প্রতি এই ভালবাসার খেলায় যিনি, ‘এল এম’কে টেক্কা দিতে পারেন তিনি স্বয়ং ভগবান। দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা।

Advertisement

বিশ্বকাপ কে জিতল, কে ক’টা গোল করল বাঙালির এই ভালবাসার কাছে পুরোটাই তুচ্ছ। এই যে পাড়ার আড্ডায় বা কর্পোরেট বোর্ডরুমে মেসির সঙ্গে মারাদোনার তুলনা চলে, সেটাও কিন্তু সেই ভালবাসারই বহিঃপ্রকাশ। আমি ভাগ্যবান কারণ বাঙালির এই দুই ভালবাসার মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আনন্দ প্লাসে সেই কথাগুলো লিখতে গিয়ে তাই আজ অসম্ভব ইমোশনাল লাগছে।

Advertisement

এক্সিকিউটিভ ক্লাসে বসব না আমি

কলকাতায় আর্জেন্তিনা টিম এবং মেসিকে আনার পেছনে এই অধমের একটা বড় ভূমিকা ছিল। সেই সময় মেসিকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম। দেখেছিলাম অত বড় ফুটবলার নিজের ঘরে বসে ভিডিয়ো গেমস খেলে। দেখেছিলাম সারাদিনই ভিডিয়ো গেমসে মগ্ন থেকে তাঁর মুখে শিশুসুলভ হাসি।

দেখেছিলাম কী অসম্ভব টিমম্যান লিওনেল মেসি। মনে আছে, কলকাতায় খেলার পর সেই একই টিম নিয়ে আমরা ঢাকা গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগের দিন আমাকে সেই এয়ারলাইন্সের বড় কর্তা ফোন করে বলেন, তাঁরা এক্সিকিউটিভ ক্লাস ছেড়ে দিচ্ছেন আর্জেন্তিনার জন্য। আমি তখন আর্জেন্তিনার কোচকে বলি আমাকে যদি তাঁরা নামগুলো বলেন, কারা কারা এক্সিকিউটিভ ক্লাসে বসবেন, আমি সেটা এয়ারলাইন্সের কর্তাদের দিয়ে দেব। কিন্তু পরের দিন সকালে দেখলাম আমাকে কেউ কিছু জানাল না। আমি বাসে ওঠার আগে কোচকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম। কোচ বললেন, “না, আমরা কেউ এক্সিকিউটিভ ক্লাসে বসব না। লিওনেল তো বসবেই না। ও আমাকে বলেছে এক্সিকিউটিভ ক্লাসে নয়, বাকি টিম যেখানে বসছে সেখানেই ও বসবে।”

সে দিন বুঝেছিলাম কত বড় টিম ম্যান মেসি। সে দিন বুঝেছিলাম এই ব্যবহারের জন্যই ও সবার এত প্রিয়।

আমাকে একটা ছবি তুলে দেবেন আপনাদের সঙ্গে

মেসি মানুষটা কেমন সেটা যদি উপরের ঘটনাটায় বোঝা যায়, তা হলে মেসির ভদ্রতা বোঝা যাবে পরের ঘটনায়। সে দিন সল্ট লেকে মেসি প্র্যাকটিস করছে। স্বাভাবিক ভাবেই আমরা সবাই ভাবছি কখন একটু ছবি তোলা যাবে ওর সঙ্গে। প্র্যাকটিস শেষ করে দেখলাম, মেসি আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এগিয়ে এসে ভীষণ ধীরে ধীরে বলল, “এই প্রথম আমি ইন্ডিয়াতে খেলছি। এত কথা শুনেছি এই দেশটা সম্পর্কে। আমাকে একটা ছবি তুলে দেবেন আপনাদের সঙ্গে? আমি তা হলে ওটা আমার বার্সেলোনার বাড়িতে রাখব।”

আমি তখন স্তম্ভিত। বলছে কী লিওনেল মেসি! কোথায় আমরা ভাবছি কখন ছবি তুলব! তা নয়, মেসি নিজে ছবি তুলতে চাইছে! সেই ছবির এক কপি আমার কাছে রয়েছে। আজও ছবিটা দেখলে আমার মনে হয়, ‘ইনভ্যালুয়েবল’!

আমি সই করলেই বেশি টাকা উঠবে না

এর মধ্যেই সেই দিন টিম ডিনারের সময় আমার কাছে ফোন আসে অভিনেতা রাহুল বসুর। রাহুল নিজে একটা এনজিও চালান। সেই এনজিও-র জন্য তিনি মেসির সই করা একটা ফুটবল চাইলেন, যা নিলাম করে সেই এনজিও টাকা তুলবে। আমি মেসির বন্ধু সেবেস্টিয়ান যিনি আবার মারাদোনার ম্যানেজার, তাঁকে গিয়ে বললাম পুরো ঘটনাটা। সেবেস্টিয়ানের হাত দিয়ে আমি একটা বলও পাঠিয়ে দিয়েছিলাম মেসির কাছে।

তার পর মেসি যা করল, তা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেন না। খাবার ছেড়ে উঠে গিয়ে টিমের প্রত্যেক সদস্যর কাছ থেকে সই নিল ওই ফুটবলটায়। সব ক’টা সই নিয়ে সেবেস্টিয়ানকে এসে বলটা দিয়ে চোখ টিপে কী যেন বলল। সেবেস্টিয়ানকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী বলল মেসি আপনাকে চোখ মেরে?’ সেবেস্টিয়ান তখন হাসতে হাসতে বললেন, “লিওনেল মজা করে বলেছে, ও নিজে সই করলে তো বেশি টাকা উঠবে না। তাই পুরো টিমটার সই নিয়ে নিল।” এই হচ্ছে লিওনেল মেসি। রসবোধটাও বক্সের মাথায় রাখা একেকটা থ্রু পাসের মতোই নিখুঁত।

মেসি যদি হয় শান্ত, লাজুক, তা হলে তার সম্পূর্ণ বিপরীত হলেন দিয়েগো মারাদোনা। মারাদোনা হচ্ছেন লার্জার দ্যান লাইফ। ঘরে হাজার জন থাকলেও শুধু ওঁর ব্যক্তিত্ব, ওঁর বডি ল্যাঙ্গোয়েজ, ওঁর কথা বলা দিয়ে উনি বুঝিয়ে দেবেন উনি সুপারস্টার।

পাতায় শুধু ক্লদিয়ার ইনিশিয়াল খুঁজছেন

কলকাতায় মারাদোনাকে আনার সময় ওঁর বুয়েনস এয়ারেস-এর বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। ওই বাড়িতে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ওঁর ম্যানেজার সেবেস্টিয়ান। আমরা সে দিন কনট্রাক্ট সই করতে গিয়েছিলাম। বিরাট একটা সুইমিং পুলওয়ালা বাড়ি, এক দিকে টেনিস কোর্ট (পরে শুনেছিলাম ওখানে মাঝেমধ্যে গ্যাব্রিয়েলা বা সাবাতিনির সঙ্গে টেনিস খেলেন মারাদোনা) পেরিয়ে আমরা পৌছলাম ওঁর ড্রয়িংরুমে। মারাদোনার এক সময়ের স্ত্রী এবং তাঁর ছোটবেলার প্রেমিকা ক্লদিয়া আজকে মারাদোনার ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপার দেখাশোনা করেন। ডিভোর্স হয়ে গেলেও মারাদোনা আজও অসম্ভব ভরসা করেন ক্লদিয়াকে। কনট্রাক্ট ফর্ম নিয়ে আমরা বসে আছি, এমন সময় ক্লদিয়া ঢুকলেন ঘরে। পুরো কনট্রাক্টটা পড়ে নিজের নামের ইনিশিয়ালটা পেনসিল দিয়ে লিখলেন প্রতি পাতায়।

এর কিছুক্ষণ পরেই ঘরে ঢুকলেন তিনি। সে দিনই ঘোষণা হয়েছিল যে, মারাদোনা আর্জেন্তিনার জাতীয় টিমের কোচ হচ্ছেন। তাই দারুণ মুডে ছিলেন দিয়েগো। আমাদের পিঠে হাত দিয়ে বসতে বললেন। কনট্রাক্টটা দেখতে চাইলেন। এবং বিশ্বাসটা এতটাই যে, প্রত্যেক পাতায় ক্লদিয়ার সেই পেনসিলে করা ইনিশিয়াল খুঁজলেন। যেই দেখতেই পাচ্ছেন ইনিশিয়ালগুলো, অমনি সই করে দিচ্ছেন পাতায়। আমরা ভেবেছিলাম উনি পুরোটা পড়বেন, প্রশ্ন করবেন, কিন্তু কিছুই হল না। ক্লদিয়া পড়ে দিয়েছে মানে সব ঠিক আছে।

এর পর শুরু হল আড্ডা। কলকাতার মানুষ, মারাদোনার অসম্ভব বড় ফ্যান। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলাম ১৯৮৬-এর কথা। কেমন ছিল সেই বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা। নিজেই বললেন সেই টিমটার প্র্যাকটিসটা অন্য রকম ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেমন? বললেন, “আজও মনে আছে আমাদের কোচ কার্লোস বিলার্দো ভালদানোকে দিয়ে সেন্টার থেকে গোলের প্র্যাকটিস করাত দিনের পর দিন। পুরো টিমের প্র্যাকটিস শেষ হয়ে গেলেও ভালদানোর প্র্যাকটিস চলত। ভালদানো নিজে বিরক্ত হয়ে, কত বার আমাকে এসে কমপ্লেন করেছে। কিন্তু বিলার্দোর চিন্তাভাবনার কোনও নড়নচড়ন হত না। দিনের পর দিন এটা চলেছিল। এবং ওই বিশ্বকাপে সেন্টার থেকে ভালদানো যে কত বার যে টিমকে গোলের পাস দিয়েছে, তা শুধু আমরাই জানি। ওটা হত না, যদি সেই প্র্যাকটিসটা না করাত বিলার্দো।”

কথাবার্তার পর আমাদের সঙ্গে ছবি তুললেন। কাঁধে যখন হাত দিলেন আমি ভাবছি এটাই বোধহয় জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন, ধীরে ধীরে ওঁকে ‘থ্যাঙ্কস’ বলে বেরিয়ে এলাম। মেসি যেমন শান্ত, মারাদোনাকে দেখলেই মনে হয়েছিল ফ্ল্যামবয়েন্সের শেষ কথা তিনি। তিনি সত্যিই ঈশ্বর। যখন যা ইচ্ছে করতে পারেন। খামখেয়ালি এবং অসম্ভব আবেগপ্রবণ।

গাড়িতে উঠে সেবেস্টিয়ানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বুয়েনেস এয়ারেস থেকে প্রায় দু’ঘণ্টা দূরে কেন থাকেন মারাদোনা? যা বলে ছিল সেবেস্টিয়ান, চমকে গিয়েছিলাম শুনে। বলল, “ও যেখানে থাকে সেখানে দিনেদুপুরে রোজ মানুষ খুন হয়। চুরি-ডাকাতি তো ছেড়েই দিন। মারাদোনা ছাড়া আর্জেন্তিনার কোনও মানুষ সেখানে থাকার সাহস করে না। তার কারণ মারাদোনা ওখানে রাত ১২টার সময় পকেটে ১০০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে বেরোলেও ওকে কেউ ছোঁবে না... কারণ? বিকজ হি ইজ মারাদোনা।”

গাড়িতে ফিরতে ফিরতে সেবেস্টিয়ানের বলা কথাগুলো কানে বাজছিল। বিকজ হি ইজ মারাদোনা। বিকজ হি ইজ মারাদোনা...

এই না হলে ঈশ্বর!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন