রিবন ব্লু

বাড়তি আভিজাত্য নিয়ে আসাটাই এক সময় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল রবিন উথাপ্পার। কী করে খুঁজে পেলেন সমাধান? আনন্দplus-এর জন্য মুম্বই থেকে কলম ধরলেন তাঁর প্রথম মেন্টর মকরন্দ ওয়াঙ্গাংকর।রাতের আলোয় যাঁরা রবিন উথাপ্পার চোখ ঝলসানো পারফর্ম্যান্স দেখেছেন, তাঁরা অনেকেই জানেন না তাঁর অন্ধকার দিনগুলো। উথাপ্পার জন্ম কুর্গের সুন্তিকোপ্পায়। ২০০২ সালে আমি কেএসসিএ (কর্নাটক স্টেট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন) অ্যাকাডেমির কনসালট্যান্ট হয়ে গেলাম। সেখানে প্রায়ই সন্ধেবেলা শুনতাম, “স্যর, একটা ছেলে দারুণ ক্রিকেট খেলত।” ‘খেলত’ শব্দটা আমার বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৪ ০০:০০
Share:

রাতের আলোয় যাঁরা রবিন উথাপ্পার চোখ ঝলসানো পারফর্ম্যান্স দেখেছেন, তাঁরা অনেকেই জানেন না তাঁর অন্ধকার দিনগুলো।

Advertisement

উথাপ্পার জন্ম কুর্গের সুন্তিকোপ্পায়। ২০০২ সালে আমি কেএসসিএ (কর্নাটক স্টেট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন) অ্যাকাডেমির কনসালট্যান্ট হয়ে গেলাম। সেখানে প্রায়ই সন্ধেবেলা শুনতাম, “স্যর, একটা ছেলে দারুণ ক্রিকেট খেলত।” ‘খেলত’ শব্দটা আমার বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছিল। আমি ভাবতাম দারুণই যদি খেলবে, তবে সে গেল কোথায়! কোনও উত্তর পেতাম না। একবার সামার ক্যাম্পের জন্য ফ্র্যাঙ্ক টাইসনকে আনিয়েছিলাম। ভাবলাম সামার ক্যাম্পে যদি ছেলেটিকে পাওয়া যায়। কেএসসিএ থেকে অবিরাম ফোন করা হল। সপ্তাহখানেক পর দেখা পেলাম সেই ছেলের। বছর পনেরো বয়স। বেশ মোটাসোটা চেহারা। কিন্তু বয়সে বড় বোলারদের মুখোমুখি হতেও ভয় পায় না। তিন সপ্তাহের সেই ক্যাম্পে একটা জিনিস লক্ষ করলাম ছেলেটি বেশ দুষ্টু। ভাবলাম, সেই জন্যই হয়তো রাজ্যের জুনিয়র সিলেক্টররা ওকে পছন্দ করে না।

আসলে ওর দুষ্টুমিটা বেশ বড়সড় সমস্যাই ছিল। অনূর্ধ্ব ১৬ রাজ্য দলের প্রধান স্কোরার হলেও, ওকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হত না। তবে আমার ওকে ভীষণ ইন্টারেস্টিং চরিত্র মনে হত। রবিন টিমে থাকা মানে সময়টা কখনও ‘বোরিং’ মনে হবে না। ২০০৩-য়ে হায়দরাবাদে খেলতে গেল অনূর্ধ্ব ১৭ টিম। অধিনায়ক রবিন। আমি মনে করি তরুণ অধিনায়ক তার ভুল থেকে শিক্ষা নেয়। কোচকে বুঝিয়েছিলাম, রবিনকে দলের দায়িত্ব দিতে আর ওর প্ল্যানিং শুনতে। আমার স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, টিম মিটিং হবে ৪৫ মিনিট আর তার পর মস্তি। ব্ল্যাকবোর্ডে রবিন ওর প্ল্যান বোঝাত। এক বছরের ক্যাপ্টেন্সিতেই মনে হত, ও যেন স্ট্র্যাটেজি ম্যানেজমেন্টে অনেক দিনের অভিজ্ঞ।

Advertisement

একটা ম্যাচে টিম নিয়ে মাঠে নামল রবিন। কিন্তু হঠাত্‌ অদ্ভুত অদ্ভুত সব সিদ্ধান্ত নিতে লাগল। স্পিনার দিয়ে বোলিং শুরু করাল। ফিল্ডিংও সাজালো অদ্ভুত ভাবে। কোচ তো হতবাক। মেসেজ পাঠানো হল, যাতে রবিন ওর স্ট্র্যাটেজি পাল্টায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! রবিন নিজের সিদ্ধান্তেই অনড় থাকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিপক্ষ এক উইকেটে ১০০ তুলে দিল। রবিনই কিন্তু টসে জিতে বিপক্ষকে ব্যাটে পাঠিয়েছিল! লাঞ্চে কোনও প্লেয়ার ওর সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলল না। কোচ তো টেন্ট ছেড়েই বেরিয়ে গেল, যাতে অপ্রীতিকর অবস্থায় না পড়তে হয়।

কিছু সময় পরে, এক প্লেট আইসক্রিম নিয়ে রবিন আমার কাছে এল। বলল, “স্যর, আমি যা করেছি তার জন্য দুঃখিত। কিন্তু আমরা গতকাল মিটিংয়ে যা ঠিক করেছিলাম, সকালে কোচ আর কিছু প্লেয়ার কিন্তু সেই স্ট্র্যাটেজি পাল্টে দিয়েছে। মনে হয় না, পরের ম্যাচে আমার ক্যাপ্টেন থাকা ঠিক হবে। উইকেট নেব, রান তুলব আবার আধ ডজন লোকের কথা শুনে দলকে চালাব এটা আমায় দিয়ে হবে না।” অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিলেও কিন্তু পারফর্ম্যান্সে একচুলও অবহেলা করেনি রবিন।

ওই সিজনের শেষে রাজ্যের অনূর্ধ্ব ১৭ দলের পাঁচজনকে আমি সিসিআই অ্যাকাডেমিতে এনেছিলাম। কেউই এর আগে মুম্বই আসেনি। ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে খেলা তো ওদের কাছে স্বপ্নের মতো। নরি কনট্রাক্টর, হনুমন্ত সিংহ আর বাসু পরাঞ্জপে ছিলেন কোচ। রবিনকে দেখে ওঁদের মনে হল, ও ওপেন করলে দল আরও তাড়াতাড়ি রান করতে পারবে। কিন্তু রবিনের আগ্রহ শুধু বল তুলে মারার।

একদিন কনট্রাক্টর আমাকে সিসিআই-তে ডাকলেন। আমি ভাবলাম, রবিন হয়তো কোনও দুষ্টুমি করেছে। আসল ঘটনা ছিল, তিন জন কোচ যত রবিনকে বোঝাতে যান, ততই রবিন বেপরোয়া শট মারে। যখন সিসিআই পৌঁছলাম, দেখলাম রবিন বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। বেপরোয়া ব্যাট করার জন্য কোচরা ওর ব্যাটিং বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মুম্বইয়ের ওই গরমে চার ঘণ্টা বাউন্ডারিতে দাঁড়িয়েছিল রবিন। সন্ধেবেলা কোচরা অনেক করে রবিনকে বোঝালেন, তাঁরা ওকে ওপেনার হিসাবে তৈরি করতে চান। কথা শুনেছিল রবিন, আর ১০০ শতাংশ দিয়েছিল। ম্যাচেও ভাল খেলতে শুরু করেছিল। বেঙ্গালুরুতে রাজ্য নির্বাচকরা ওর কমিটমেন্ট দেখে চমকে গেলেন।

একদিন দিলীপ বেঙ্গসরকর এনসিএ-র নেটে এলেন। পাশের নেটেই তখন কেএসসিএ-র ছেলেরা প্র্যাকটিস করছে। সেখানে বোলারদের তুলোধোনা করছে রবিন। পরের দিনই এনসিএ-র এক টিমের হয়ে রবিনকে চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে নামালেন বেঙ্গসরকর। অসাধারণ ৭৬ করল রবিন। এনসিএ ক্যাম্পে জায়গা পেতে ওটাই যথেষ্ট ছিল।

যদিও ওর ব্যবহারে কোনও পরিবর্তন আসেনি। দুষ্টুমিটা বেশ ভালই চালাচ্ছিল। এ দিকে জাতীয় দলের সিনিয়রদের মধ্যেও তখন একটা ফিসফিসানি চলছে ওকে দলে না নেওয়া নিয়ে। নির্বাচকেদের ওরা ভালই প্রভাবিত করে ফেলেছিল। আমি কিন্তু ওর ওই দুষ্টুমিকে ভালই উস্কানি দিচ্ছিলাম। আমি চাইতাম ও ক্রিকেটটাকে উপভোগ করুক। বাড়ির নানা ব্যাপার নিয়ে বেশ বিব্রত ছিল ও। কিন্তু মাঠে ওর পারফর্ম্যান্স থেকে ও বুঝে গিয়েছিল যে একমাত্র ক্রিকেট খেলাটাই ওকে আনন্দে রাখতে পারে। নিজের পারফর্ম্যান্স নিয়ে যথেষ্ট গর্বও করত।

১৮ বছর বয়সে রঞ্জি ট্রফিতে মধ্যপ্রদেশের বিরুদ্ধে একটা দুর্দান্ত সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিল রবিন। ব্যাটসম্যান হিসেবে ওর পারফর্ম্যান্স ক্রমেই উন্নত হচ্ছিল। ধৈর্য ধরতে শিখছিল। রক্ষণাত্মক কৌশলগুলোও দারুণ রপ্ত করছিল। ‘ভি’তে খেলার গুরুত্বটা ক্রমেই বুঝতে পারছিল ও। আমরা বলতাম ওটা প্রোডাক্টিভিটি জোন। আমি কিছু ড্রিল তৈরি করেছিলাম। ও প্রতিদিনই সেই ড্রিলগুলো করত। আমি তখন এয়ার ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলাম ওকে যেন এনরোল করে নেন। যাতে আন্তর্জাতিক প্লেয়ারদের সঙ্গে খেলতে পারে, সেই কারণেই এই ব্যবস্থাটা করেছিলাম আমি। বিদেশি খেলোয়াড়দের সান্নিধ্য ভালই এনজয় করছিল রবিন।

আস্তে আস্তে রান পেতে শুরুও করে ও। কিন্তু ওর খেলার স্টাইলটা টি-টোয়েন্টি বা ওয়ান ডে-র সঙ্গে বেশ যেত। ও আক্রমণ করতে ভালবাসে। তবে জানত ওর ডিফেন্সটা একেবারে ত্রুটিমুক্ত ছিল না। আউটস্যুইঙ্গারদের বিপক্ষে ভালই স্ট্রাগল করতে হচ্ছিল ওকে। ও চাইছিল টেস্ট ক্রিকেট খেলতে। কিন্তু ক্রমেই যেন আশাভঙ্গ হচ্ছিল। এ রকমই এক সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল রবিন। ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাটিং কোচ প্রবীণ আমরের গাইডেন্স নিতে আরম্ভ করল। এয়ার ইন্ডিয়ার হয়ে খেলার সময় বোধহয় বুঝতে পেরেছিল ওর ভুলগুলো প্রবীণ আমরের মতো একজন কোচই ঠিক করতে পারবে। রবিন যেটা করেছে, তা কোনও ভারতীয় ক্রিকেটারই বোধহয় করেননি। আমরের কোচিং ছাড়াও, ফিজিও হিসেবে জন গ্লস্টার, একজন ট্রেনার আর একজন মেন্টাল কন্ডিশনারের সাহায্যও নিতে শুরু করে। শুরু করে মেডিটেশনও। মু্ম্বইতে খার জিমের উল্টো দিকেই আস্ত একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে নেয়। এমসিজি-তে ২ ঘণ্টা প্র্যাকটিস সেশনের জন্য ১৫ হাজার টাকা খরচ করাটাও তখন ওর কাছে কোনও ব্যাপার নয়। ক্রিকেটই তখন ওর এক এবং একমাত্র সাধনা।

রবিনের স্বপ্ন ছিল টেস্ট ক্রিকেটার হওয়ার। আর তার জন্য যা যা করা উচিত, তা ও করে যাচ্ছিল। মুম্বইয়ের মতো জায়গায় খুব কমই সোশ্যালাইজ করত ও। মুম্বইয়া ক্রিকেটার আমরে ওর মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ওর বেস স্ট্রং না হলে কিন্তু ক্রিকেটের কোনও ফর্মেই ও সাফল্য পাবে না। তবে বেঙ্গালুরুতে রবিনের আগের ফর্মটা যাঁরা দেখেছিলেন, তাঁরা কিন্তু ওকে এতটা বদলে দেওয়ার জন্য আমরেকে অভিসম্পাত করছিলেন ভাল মতোই। এক রঞ্জি ম্যাচের সময় অনিল কুম্বলে তো বলেই বসেন যে রবিনের ন্যাচারাল স্ট্রোকের খেলাকে এ ভাবে শেষ করে দেওয়ার জন্য আমরেই দায়ী। আমরে তা শুনে এতটাই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন যে তত্‌ক্ষণাত্‌ ফ্লাইটে মুম্বই ফিরে যান। রবিন কিন্তু তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন চালিয়ে যাওয়ার জন্য।

কেকেআর-এর কোচেরা একটা খুব বড় গোলমাল করে ফেললেন রবিনকে ফিনিশার হিসেবে নিয়ে। তাঁরা যথাযথ হোমওয়ার্ক যে করেননি, সেটা এই ঘটনায় ভালই প্রমাণিত হয়। এই কাজটা রবিন মোটেই পছন্দ করে না। স্বাভাবিক ভাবেই ভাল করে কাজটা করার আগ্রহটাও ওর নেই। ওর হল একজন ওপেনারের মানসিকতা। ৬ ওভারের পাওয়ার প্লে-র কৌশলে রবিন ধ্বংসাত্মক। এই জায়গায় ওর প্রতিটি শট নিখুঁত। নতুন যে কৌশল ও আয়ত্ত করেছে, তাতে শুধু যেটা ওকে করতে হয়, তা হল ফাঁকফোকরের মধ্যে দিয়ে বলটাকে গলিয়ে দেওয়া। বেলিস, দহিয়া, ডব্লুভিবি রমন বা ওয়াসিম আক্রমরা কি এটা খেয়াল করেননি নেটে? ব্যাটিংয়ের ফুটেজগুলো তো ওঁরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছিলেন। অবশ্যই সেটা নিয়ে কোনও অ্যাজেন্ডা ছিল ওঁদের? আমার দৃঢ ধারণা, অবশ্যই ছিল।

যে কোনও টিমের কাছেই রবিন উথাপ্পা সম্পদ। রবিন অত্যন্ত মৃদুভাষী। আর খুব রিজার্ভড। ঘুম থেকে উঠে কোচ, ফিজিও বা ট্রেনারের সঙ্গে যে মজাগুলো করত, সেগুলোও এখন অতীত। রবিন এখন অনেক বেশি আধ্যাত্মিক। খুব বাধ্য। ঈশ্বরের প্রতিও ওর যথেষ্ট সমীহ। যাঁরা ওকে নিয়ে আমার কাছে অভিযোগ করেছিলেন, তাঁরাই আবার আমার কাছে জানতে চান ওর এ হেন পরিবর্তনের কারণ। উত্তরে তাঁদের বলি, কোনও প্লেয়ারকে মাঠে বা মাঠের বাইরে তাঁর মতো করে থাকতে দাও। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতেই পারে সন্দীপ পাতিল, সহবাগ বা কাম্বলির কথা। এঁরা কোনও দিনই কোনও টেকনিকের বশবর্তী হতে চাননি। নিজেদের নিয়ম নিজেরাই বানিয়ে নিয়েছেন। রবিনও তাঁদের মতোই একজন। আর রবিনের এই যে উন্নততর ফর্ম, তা কিন্তু ইন্ডিয়ার হয়ে যে কোনও টেস্ট ওপেনারের ফর্মেরই সমান।

রবিনকে ওর নিজের জায়গাটা দিতে হবে। তাতে আখেরে লাভ ভারতীয় ক্রিকেটেরই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন