স্মৃৃতির অতলে শৌরীন্দ্রমোহন

এ দেশের সঙ্গীতে নবজাগরণ যাঁদের হাত ধরে এসেছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর। ঔপনিবেশিক যুগে তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্যকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন। বিশ্বসঙ্গীত দিবসে লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য। শুধুমাত্র আনন্দবাজার ওয়েবসাইটের জন্য।এ দেশের সঙ্গীতে নবজাগরণ যাঁদের হাত ধরে এসেছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর। ঔপনিবেশিক যুগে তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্যকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন। বিশ্বসঙ্গীত দিবসে লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য। শুধুমাত্র আনন্দবাজার ওয়েবসাইটের জন্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৪ ২০:১৫
Share:

শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর।

সপ্তম এডওয়ার্ড কলকাতায় আসবেন। প্রিন্স অফ ওয়েলস বলে কথা! চার দিকে সাজ সাজ আবহাওয়া। তাঁকে সুরের মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানাতে তৈরি হচ্ছে সঙ্গীত। ঘটনাচক্রে সেই সঙ্গীত নির্মাণের দায়িত্বে এক জন বাঙালি। শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর। ইতিমধ্যেই তিনি ইউরোপীয় আদলে গড়ে তুলেছেন বাঙালির অর্কেস্ট্রা ব্যান্ড। সেটা ১৮৭৫। প্রিন্স এডওয়ার্ড এলেন। বেলগাছিয়া ভিলায় তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে বাজল বাঙালি ব্যান্ড। এ ঘটনা আজ ইতিহাস। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে স্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছেন অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের সেই সুরস্রষ্টা। এ বছর শৌরীন্দ্রমোহনের মৃত্যুশতবর্ষ।

Advertisement

পাথুরিয়াঘাটার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে শৌরীন্দ্রমোহনের জন্ম ১৮৪০ সালে। এ দেশের সঙ্গীতে নবজাগরণ যাঁদের হাত ধরে এসেছিল তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। প্রথম বাঙালি হিসাবে তাঁকে ‘নাইটহুড’ সম্মান দেওয়া হয়। ঔপনিবেশিক যুগে তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্যকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন। সঙ্গীতচর্চার প্রায় প্রতিটি বিভাগেই তাঁর অবদান ছিল। সঙ্গীত নিয়ে বই লেখা, সঙ্গীত বিদ্যালয় স্থাপন, প্রাচীন সঙ্গীতশাস্ত্র পুনরুদ্ধার করে ছাপানোর ব্যবস্থা সবেতেই ছিল শৌরীন্দ্রমোহনের তুমুল উত্‌সাহ। এ সবের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের দুর্লভ বাদ্যযন্ত্রের অসামান্য সংগ্রহ ছিল তাঁর।

তবে মৃত্যুর একশো বছর পরে কতটা প্রাসঙ্গিক শৌরীন্দ্রমোহন? রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রসঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপক গৌতম ঘোষ বললেন, “তিনিই প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ভারতীয় সঙ্গীত নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সঙ্গীত যে গবেষণার একটি বিষয় হতে পারে সেটাও তাঁর উপলব্ধি। ওঁর লেখা বিভিন্ন বই আজও পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগে পড়ানো হয়।”

Advertisement

পরিবারের সঙ্গে শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর।

সে যুগের একাধিক কলাবন্তের কাছে যন্ত্রসঙ্গীত এবং কণ্ঠসঙ্গীত শিক্ষা নিয়েছিলেন শৌরীন্দ্রমোহন। ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, বারাণসীর লক্ষ্মীপ্রসাদ মিশ্রের পাশাপাশি সাজ্জাদ মহম্মদের কাছে সেতারের তালিম নিয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি পাশ্চাত্যসঙ্গীতের চর্চা করতেন। জার্মান এক সঙ্গীতজ্ঞের কাছে পিয়ানো শিখেছিলেন বেশ কিছু দিন। হয়তো নিজে উঁচুদরের গায়ক ছিলেন না, তবে বড় মাপের সেতার বাজিয়ে ছিলেন তিনি। হিন্দু কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি পণ্ডিত তিলকচন্দ্র ন্যায়ভূষণের কাছে বহু দিন সংস্কৃত ব্যাকরণের শিক্ষা নিয়েছিলেন শৌরীন্দ্রমোহন। তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রার নোটেশনের মতো ভারতীয় সঙ্গীতে নোটেশন পদ্ধতির উদ্ভব করেছিলেন। দুর্লভ বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র তিনি সংগ্রহ করেছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। দেশ-বিদেশের সঙ্গীতপ্রিয় রাজা-মহারাজাদের সঙ্গেও তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।

শৌরীন্দ্রমোহনের বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহের প্রতি আগ্রহের কথা শুনে জাপানের রাজা মিকাডো তাঁকে বারোটি বাদ্যযন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য টাইমবিটার্স, কাগুরাফ্লুট, মাউথঅরগ্যান, ফ্ল্যাজিওলেট ও রিড, ফ্লুট, কোমাফ্লুট এবং একটি সুদৃশ্য ড্রাম। এ ছাড়াও বর্মার রাজা থিব তাঁকে একটি বার্মিজ বেহালা উপহার দিয়েছিলেন। সংগ্রাহক মিসেস জন ক্রবি ব্রাউনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। শৌরীন্দ্রমোহনের সংগ্রহের একটি ময়ূরী বীণা এবং ঘণ্টা কোনও ভাবে মিসেস ব্রাউনের কাছে আসে। পরবর্তী কালে এই দু’টি জিনিস জায়গা পায় আমোরিকার মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্ট-এ।

১৮৮২ সালে প্যারিস থেকে পাওয়া প্রশংসাপত্র।

সপ্তম এডওয়ার্ড-এর অভ্যর্থনায় যে ব্যান্ডসঙ্গীত পরিবেশিত হয়েছিল তার বাদ্যযন্ত্রগুলি ছিল শৌরীন্দ্রমোহনের সংগ্রহের। পরে তিনি সেগুলি ভারতীয় সংগ্রহালয়ে দান করেছিলেন। ১৯১৪ সালে ভারতীয় সংগ্রহালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে তিনি দান করতে চেয়েছিলেন তাঁর বাদ্যযন্ত্রের সম্ভার। কিন্তু সে বছরেরই জুন মাসে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র শ্যামাকুমার ঠাকুর সেই সংগ্রহের একটি বড় অংশ ভারতীয় সংগ্রহালয়ে দিয়েছিলেন। সংগ্রহালয় কর্তৃপক্ষ একটি সচিত্র ক্যাটালগ প্রকাশ করেছেন ‘মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্টস ডোনেটেড বাই রাজা স্যর শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর’।

তাঁর সময়ে বাংলা গান বলতে ছিল বিভিন্ন আখড়ায় কীর্তন, কবিগানের আসর কিংবা বড় বাড়ির জলসাঘরে নাম করা উস্তাদ বা বাঈজিদের ধ্রুপদি, খেয়াল বা ঠুমরির আসর। ভারতীয় রাগসঙ্গীতকে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলতে ‘বেঙ্গল মিউজিক স্কুল’ এবং ‘বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অফ মিউজিক’ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘হারমোনিয়াম সূত্র’ বইটি। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে তিনি প্রথম বই লিখেছিলেন, ‘ভূগোল ও ইতিহাস ঘটিত বৃত্তান্ত’। ৪৬টি বই লিখেছেন, তার মধ্যে ২৬টি সঙ্গীতের উপর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ইউনিভার্সাল হিস্ট্রি অফ মিউজিক’, ‘যন্ত্রকোষ’, ‘হিন্দু মিউজিক’ প্রভৃতি।

জীবদ্দশাতেই শৌরীন্দ্রমোহন পেয়েছিলেন নানা সম্মান ও স্বীকৃতি। তাঁর অবদানের জন্য তত্‌কালীন ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তিনিই ভারতের প্রথম নাগরিক যিনি ১৮৭৫-এ ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডক্টরেট অফ মিউজিক’ সম্মান পেয়েছিলেন। ১৮৮০-তে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়, ১৮৮১-তে ইতালি এবং ১৮৮২ সালে প্যারিস থেকে স্বর্ণপদক ও প্রশংসাপত্র পেয়েছিলেন। ১৮৯৬-এ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়। শৌরীন্দ্রমোহন ছিলেন রয়্যাল অ্যাকাডেমি অফ মিউজিক (সুইডেন) স্টকহোমের সদস্যও।

কিন্তু বিশ্বসঙ্গীতের এই বাঙালি পথিকৃতকে নিয়ে তাঁর মৃত্যু শতবর্ষ যেন বড় বেশি নীরবে কাটছে!

ছবি সৌজন্যে: ভারতীয় সংগ্রহালয় এবং ’গ্লিম্পসেস অব বেঙ্গল’ বইটি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন