দুধসাদা ট্রাউজারের পকেটে একটা হাত ঢুকে, মাথাটা নড়ছে অল্প-অল্প। চোখ বন্ধ, কানে পেল্লায় একজোড়া হেডফোন। তাল একটু কাটল বোধহয়, পছন্দ হল না মরাঠির। তত্ক্ষণাত্ রেকর্ড রুম থেকে সঙ্গীত পরিচালকের উদ্দেশে, “স্যরি, স্যরি। আবার নাও।”
আচ্ছা, লাইনদুটোর মানে বুঝিয়ে দিন তো। এই যে লেখা: একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি... মানে কী এর? ডাক পড়ল স্বয়ং পরিচালকের। গভীর মনোযোগে সুর-পঙক্তির মর্মোদ্ধার, শেষে প্রশ্ন, “উচ্চারণটা ঠিক কী? কথা, না কোথা?”
ক্রিকেট যাঁরা দেখেন, কমেন্ট্রি বক্সে যাঁদের চোখ থাকে, ভদ্রলোক তাঁদের খুব পরিচিত। ১৯৮৯-’৯০-র পাকিস্তান সফর যাঁদের এখনও মনে আছে, তাঁরা নিঃসন্দেহে আজও মরাঠির ডাবল সেঞ্চুরি ভোলেননি। গানের প্রতি তাঁর একটা আলাদা টান আছে, সেটা সর্বজনবিদিত না হলেও অজানা নয়। ক্রিকেট-জীবনেই তো ‘রেস্ট ডে’ অ্যালবাম বার করে ফেলেছিলেন।
তাই বলে প্লে-ব্যাক! তা-ও বাংলায়!
গল্প হলেও সত্যি। সঞ্জয় মঞ্জরেকর প্লে-ব্যাক করছেন, বাংলায় গাইছেন, আর গাইছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত।
মৈনাক ভৌমিকের পরিচালনায় ‘চলচ্চিত্র সার্কাস’ নামক সিনেমায় একটা গান গাইতে শোনা যাবে সঞ্জয় মঞ্জরেকরকে। যে গানের রেকর্ডিংয়ে রবিবার কলকাতার ক্ষণিক অতিথি তিনি, যে সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক অনুপম রায়। কিন্তু সঞ্জয় সব ছেড়ে বাংলা গানে কেন? ডেবিউটা তো মরাঠিতেও করতে পারতেন।
“বাংলা গানের প্রতি বরাবরই একটা টান আছে। কিশোরকুমারকে পুজো করি। ওঁর হিন্দি গান অনেক শুনেছি। তার পর ওঁর বাংলা গান শুনে আরও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম,” রবিবার বিকেলে দক্ষিণ কলকাতার এক রেকর্ডিং স্টুডিওয় বসে বলছিলেন এক সময় ভারতীয় টিমের নির্ভরযোগ্য নাম্বার থ্রি। “আর মরাঠিতে কেন করলাম না? আমি কাউকে গিয়ে বলতে পারব না আমাকে দিয়ে গান করাও। কেউ ডাকলে করি। বাংলা ডাকল, চলে এলাম। তা ছাড়া আমার একটু সফ্ট গান বেশি ভাল লাগে। বাংলায়, রবীন্দ্রসঙ্গীতে যেটা পাই। রবীন্দ্রসঙ্গীত এমন একটা আবেগ, গাওয়ার সময় অন্য অনুভূতি হয়।”
সঙ্গীতের ‘শ্রুতিধর’ অনায়াসে বলা যায় সঞ্জয়কে। বাংলা বোঝেন না, বলতেও পারেন না। কিন্তু তাঁর বাংলা গান শুনে কে বলবে, অবাঙালি? নিজেই সাউন্ডট্র্যাক শুনে শুনে গান রেকর্ড করেন, তাঁর বন্ধু সেগুলো আপলোড করেন। ইউটিউবে তাঁর গাওয়া বাংলা গানও পাওয়া যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীতও শুনে তুলে ফেলেছেন।
টলিউডের অফারটা পাওয়ার পরই নিজের একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডিং পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অনুপম বলছিলেন, “প্রথমে যখন শুনি সঞ্জয় মঞ্জরেকর গান করবে, আকাশ থেকে পড়েছিলাম। ভাবতেই পারিনি, যার ক্রিকেটের এত বড় ফ্যান আমি, তার সঙ্গে একই স্টুডিওয় কাজ করব!” চ্যালেঞ্জিং মনে হয়নি? “হ্যাঁ, কিন্তু মজার চ্যালেঞ্জ। প্রথমে একটু ভেবেছিলাম। তার পর মনে হল নাহ, ঠিক হয়ে যাবে। আর উনি গান নিয়ে যথেষ্ট সিরিয়াস।”
গান ভালবেসে গান
সঙ্গীত-পাঠ
পণ্ডিত জসরাজের ছাত্র রতনমোহন শর্মার কাছে বছর দেড়েকের ‘ক্র্যাশ কোর্স’
প্রিয় সঙ্গীতশিল্পী
কিশোরকুমার, লতা মঙ্গেশকর, মেহদি হাসান, নুসরত ফতেহ আলি খান
হালফিলে ভাল লাগে
সুনিধি চহ্বন, অরিজিত্ সিংহ
গান-ভবিষ্যত্
রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে অ্যালবাম করার ইচ্ছে আছে
প্রিয় গান
নাচানাচির গান অপছন্দ।
সফ্ট গান ভাল লাগে
সঞ্জয়ের সঙ্গে যোগাযোগটা হয় ইডেনের সার্ধশতবর্ষ পূর্তি ম্যাচে। তখনই সঞ্জয়কে প্রস্তাব দেওয়া হয়, বাংলা সিনেমায় প্লে-ব্যাক করবেন কি না। পরে ফিরে গিয়ে সঞ্জয় নিজের পছন্দের রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করে পাঠান। যা শুনে টিম চলচ্চিত্র সার্কাস দ্বিতীয় বার ভাবেনি। তাঁর ‘বেডরুম’-এ ‘মায়াবন বিহারিণী’র পুনর্গঠন আছে। সেই মৈনাক ভৌমিক বলছিলেন, “এক্সপেরিমেন্ট করব না কেন? রবীন্দ্রসঙ্গীত এখন সবার সম্পত্তি, রবীন্দ্রসঙ্গীত কালজয়ী। আর সঞ্জয় নিজেই তো এই গানটা পছন্দ করেছে। সিকোয়েন্সটাও এ রকম যে, এক জন অবাঙালি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে।” আবার সিনেমার প্রযোজক রানা সরকার বললেন, “তিন-চার মাস আগে ওঁর গানের ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলাম। ওঁর পাঠানো রেকর্ডিং শোনার পরে আর ভাবিনি।”
সঞ্জয়কেও বিশেষ ভাবতে হয়নি নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার আগে। সুরের বাইশ গজে নামার আগে। কমেন্ট্রি তো আছেই। লাইভ ক্রিকেট শো সঞ্চালনা করে করে ক্যামেরার সামনে এখন এতটাই সাবলীল যে, প্লে-ব্যাক করতে হবে শুনে একটুও টেনশন হয়নি। “ক্রিকেটার না হলে তো গায়কই হতাম। গানটা আমার প্যাশন। ওটা সবার ওপরে থাকে। ক্রিকেটার হয়েছি আমার বাবার জন্য, আমার পরিবারের ক্রিকেট-সংস্কৃতির জন্য, আমার পারিপার্শ্বিকের জন্য। যেটা আমার সহজাত, সেটা নিয়ে কেন টেনশন হবে?” রেকর্ড রুমে ঢোকার আগে বলছিলেন সঞ্জয়। কিন্তু কোনটা বেশি কঠিন? পাকিস্তানের মাটিতে ওয়াসিম-ওয়াকার-ইমরানকে খেলা? কমেন্ট্রিতে টানা ক্রিকেট-বিশ্লেষণ করে যাওয়া? না কি এটা? “কমেন্ট্রি করা সবচেয়ে সহজ। লাইভ শো হোস্ট করা সবচেয়ে কঠিন।”
যাঁর ক্রিকেটের এত বড় ভক্ত আমি,
তাঁর সঙ্গে একই স্টুডিওয় কাজ করব, ভাবতেই পারিনি!
অনুপম
এক্সপেরিমেন্ট কেন করব না? গানের সিকোয়েন্সটা হল,
এক জন অবাঙালি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন
মৈনাক
এই ছবির জন্য ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে’ গানটা
গাওয়ার সময় অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছিল
সঞ্জয়
সুরের পৃথিবী অধিকতর পছন্দের হলেও বলিউড-আমন্ত্রণ একেবারেই কাম্য নয়। বাংলায় প্লে-ব্যাক মানে যে মোটেও বলিউডের কাছে তাঁর সিভি আকর্ষণীয় করা নয়, পরিষ্কার বলে দিচ্ছেন সঞ্জয়। “আমার তো বলিউড ভালই লাগে না। জগঝম্প গান, আর বেশির ভাগ সিনেমাই হয় টাকা কামানোর কথা ভেবে। আমি হিন্দি সিনেমা দেখিও না।” সঞ্জয় জানেন না, আদৌ বলিউড থেকে গান গাওয়ার ডাক এলে তিনি যাবেন কি না। একমাত্র অরিজিত্ সিংহ বাদে বলিউডি গানের নতুন প্রজন্মের বিশেষ খোঁজও রাখেন না। বরং বাংলা থেকে ডাক পেয়ে ইউটিউবে সার্চ দেন অনুপম রায় নিয়ে। শুনে ফেলেন তাঁর বিখ্যাত গানগুলো।
আসলে তিনি বরাবরই সনাতনী সঙ্গীতের গুণমুগ্ধ। যা তিনি পেয়েছেন বাংলায়, বাঙালির শ্রেষ্ঠ আদর্শের সৃষ্টিতে। উচ্চারণের সামান্য অসুবিধে তাই কানে লাগে না যখন ডুব দেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের মহাসমুদ্রে। বরং শীতের সন্ধেয় রেকর্ডিং স্টুডিও থেকে ভেসে আসা ‘রচি মম ফাল্গুনী...’ শুনে মনে হয়, ঠিকই বলছিলেন। এটাই তাঁর আসল জায়গা। ক্রিকেট নয়, কমেন্ট্রি নয়, নিজ বসন্তের রচনা অন্য মাইক্রোফোনের সামনে করছেন সঞ্জয়। সৃষ্টি করছেন অন্য বসন্ত।
সুরের বসন্ত।