Independence Day

‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র জমি অনেক দিন আগেই বলিউড তৈরি রেখেছিল

নির্মিত হল কামনামদির ‘ইন্ডিয়া’, যার প্রতিটি ফ্রেমে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান। লিখছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়নির্মিত হল কামনামদির ‘ইন্ডিয়া’, যার প্রতিটি ফ্রেমে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান। লিখছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৮ ১২:২৭
Share:

ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’র একটি দৃশ্যে মাধবী মুখোপাধ্যায় এবং অভি ভট্টাচার্য।

না, নিয়তির সঙ্গে আমাদের কোনও চুক্তি ছিল না মধ্যরাতে। অন্য কোনও রাজনৈতিক চুক্তির ফলে আমরা ফরিদপুর ও বরিশালের বাঙালরা সীমানা পার হয়ে এ দেশে আসি। আমার জন্ম স্বাধীন ভারতে ‘বাঙাল’ হিসেবে। দেশপ্রেমের উপকারিতা বোঝার আগেই আমরা যুক্ত করে ও মুক্ত কণ্ঠে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পর হেডমাস্টার মশাইয়ের নির্দেশে গাইতাম, ‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী...’। ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকার তলায় কিছু সাদা ফুল। শ্রাবণের আকাশ কালো হয়ে এল। আমরা ইসকুলের হলঘরে ফিরে গিয়ে বোঁদে ও দু’টি দানাদার পেতাম। সে ছিল শৈশবে আমাদের স্বাধীনতার স্বাদ।

Advertisement

কিন্তু তা হলেও স্বাধীনতা দিবসের কোথাও কোনও মানে ছিল। এখনকার মতো কুচকাওয়াজে পরিণত হয়নি। সত্তর বছর পরে আজ মনে হয়, স্বাধীনতা দিবস ও বিবাহবার্ষিকী, দুই-ই তো রিচুয়াল বা প্রথাপালন। প্রথমটিতে রাষ্ট্রনায়ক থাকেন, দ্বিতীয়টিতে বন্ধু সমাবেশ হয়। পতাকা উত্তোলনের পর বা কেক কাটলে হঠাৎ মনে হয় একটা দেশে এত রঙের মানুষ একসঙ্গে আছে তো! একটা পরিবার টিকে গেল তো!

কিন্তু পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে মানুষ তুলনায় বিশ্বাসী ও ধার্মিক ছিল। ১৫ই অগস্ট লোকে ভারতবর্ষই বলত, ‘ইন্ডিয়া’ কথাটা এক দিনের জন্য ঠোঁটে আসত না। সার্থক জনম আমার...গাইতে গাইতে গায়িকা কেঁদে ফেলেছেন— এ আমাদের স্বচক্ষে দেখা। ‘৪২’ (১৯৫১) ছবির মেজর ত্রিবেদী রূপী বিকাশ রায়কে তাঁর ছেলে পর্যন্ত ঘৃণা করতে শিখেছিল। বস্তুত ‘৪২’ ছবির দেশজোড়া সাফল্য, তার আগে ‘ভুলি নাই’ (১৯৪৮) ছবিতে মহানন্দের বিশ্বাসঘাতকতা বিকাশ রায়কে প্রায় ‘কাল্ট’ চরিত্র করে তোলে। আমরা মাথার চুলে, ইরেজার শব্দটা চালু হয়নি, রবার ঘসে ক্ষুদিরাম ও নেতাজির জলছবি লেপটে দিয়েছি খাতায়, কিন্তু বিকাশ রায় অনেক জ্যান্ত ভিলেন হয়ে গেলেন পাড়ায় পাড়ায়, এমনকি, খাদ্য-আন্দোলনের মধ্যেও ‘সুভাষচন্দ্র’ (১৯৬৬) দেখার জন্য আমরা স্কুল থেকে সারিবদ্ধ ভাবে ভারতী সিনেমায় ম্যাটিনি শো’তে চার জন মাস্টারমশাইয়ের তত্ত্বাবধানে গিয়েছি। সেখানে বালক সুভাষের মতো আমরাও চারণকণ্ঠে— ‘একবার বিদায় দে মা’ শুনে অশ্রুসজল হয়েছি। এই গান সিনেমায় লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে হলেও হাটে মাঠে সাধারণ মানুষই গেয়েছে। সেই সব মানুষ আন্তরিক ভাবেই বিশ্বাস করত, একটা স্বাধীনতা তাদের অন্তরে ডাক দিয়েছে। না হলে আসমুদ্র হিমাচল রাজ কপূরের ‘শ্রী ৪২০’ (১৯৫৫) ছবিতে বিশ্বলোকের সাড়া পেয়েও সগর্বে বলেছিল, ‘জুতো জাপানি হতে পারে, মাথার টুপি হতে পারে, কিন্তু দিল হিন্দুস্তানি’। পঞ্চাশ দশকের গ্রাম্য লোকেরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শহরে এসেও ভাবতে শিখেছিল, তাদের শেখানো হয়েছিল ভারত বা হিন্দুস্তান তাদের দেশ। মনোজ কুমার যখন নেহরু-উত্তর যুগে ‘ইয়ে দেশ কি ধরতি’ গেয়েছিলেন তা সমগ্র দেশেরই জনমনচিত্রকথা ছিল। ঋত্বিক ঘটকের মতো কেউ কেউ ‘সুবর্ণরেখা’য় (১৯৬২) একটু বেসুরো ভাবে প্রজাতন্ত্র দিবসকে জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস হিসেবে দেখালেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মানচিত্রে স্থান পেয়ে যেত অনায়াসে।

Advertisement

আরও পড়ুন: তারুণ্যের দীপ্তিতে উদ্দীপ্ত হোক স্বাধীনতা

কিন্তু এলো ‘উদারীকরণের যুগ’। একুশ শতকে পা রাখা মাত্র আমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল বটে— ফির ভি দিল হ্যয় হিন্দুস্তানি। কিন্তু আমাদের প্রতিশ্রুত ভূমি দেখলাম পাল্টে গিয়েছে। অনাবাসী ভারতীয় চোখ দিয়ে আমাদের শোনানো হল ‘পরদেশ’ ছবিতে ‘I love My India’।

‘ফির ভি দিল হ্যয় হিন্দুস্তানি’ ছবির একটি দৃশ্যে শাহরুখ খান এবং জুহি চাওলা।

তার দু’বছর আগে আলিশা চিনয় বাজারের বাসনা এঁকে দিলেন তাঁর ভিডিয়ো অ্যালবাম ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’-তে। আজ বুঝতে পারছি, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র জমি অনেক দিন আগেই বলিউড তৈরি রেখেছিল। ‘দিল তো পাগল হ্যয়’ (১৯৯৭)-তে নায়িকা প্রায় পুরো সময়টাই দোকানে কাটান বা নেদারল্যান্ডসের পাঁচতারা হোটেলে। তাঁর আহারে কটন ক্যান্ডি, পরনে ব্যান্ড, শ্রবণে হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া। তিনি নাচেন, কিন্তু নিজেকে দেখার জন্যই কোথাও বলা হয় না তাঁকে বেঁচে থাকার পারিশ্রমিক অর্জন করতে হবে। কর্ণ জোহর ও যশ চোপড়ারা যে চলচ্চিত্র সাম্রাজ্য বিস্তার করলেন তা আর ভারতের বাইরে রইল না, নির্মিত হল কামনামদির ‘ইন্ডিয়া’, যার প্রতিটি ফ্রেমে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান। সেখানে গ্রাম নেই। গরিব নেই। সিন্থেটিক নিসর্গে ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ায় যাঁরা জনতা তাঁরা তো ডিসপোজেবল মাস।

আরও পড়ুন: তিন প্রজন্মের স্বাধীনতা

সুতরাং যে পতাকা ওঠে তা বলদর্পী ইন্ডিয়ার। সেখানে কৃশকায় গাঁধী বা ক্ষুদিরামের ভারত পরিব্রাজনা কোথায়? চার্লি চ্যাপলিনের ‘দ্য পিলগ্রিম’ ছবির শেষ দৃশ্যে চার্লি মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রের সীমানার মাঝামাঝি তাঁর সেই বিখ্যাত হাঁটা হেঁটে চলেন। গরিবের দেশ নেই। আজ নতুন করে জনপঞ্জি তৈরি হচ্ছে। এক দিকে ভারত, অন্য দিকে ইন্ডিয়া। নতুন স্বাধীনতায় আমার ঠাঁই হবে তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন