প্রতিটা দিনই প্রতিজ্ঞার। প্রতিটা রাত ঘুমোলেই মৃত্যুর মতো। ঘুম ভাঙলে বুঝতে পারি, বেঁচে আছি। প্রতিটা দিনই পরীক্ষা। কিন্তু, প্রত্যেকটা দিন উত্সবের মতো করেই তো বেঁচে আছি। প্রতিটা মুহূর্তেই বেঁচে থাকার উদ্যাপন। বছর মাসের হিসেব রাখি না। আলাদা করে নতুন মাস, নতুন সপ্তাহ, নতুন বছরে আমার খুব একটা পুলক হয় না। নতুন কাজ এলে, নতুন বান্ধবী পেলে, নতুন একটা রাস্তা চিনতে পারলে বরঞ্চ বেশি আনন্দ হয় আমার। সেলিব্রেট করতে ইচ্ছে করে। বছর তো ঘুরবেই। অঙ্কটা বদলাবে শুধু। তাই পুরনো বছরের দুঃখ বা নতুন তারিখের জন্য আনন্দ আমাকে ছোঁয় না। আমার কাছে বছরের সমস্ত দিনই এক। অবিকল এক। শুরু শেষ কিছু বুঝি না। জার্নিটাই আমার কাছে মস্তির। গন্তব্যটা খুব একটা জরুরি নয়। না পৌঁছলেও হয়। অনর্গল, অবিরাম চলতে থাকা। যত ক্ষণ না মৃত্যু হয়। যেখানে মরব, সেটাই টার্মিনাল স্টেশন।
আর ছোটবেলা থেকে যে ভাবে বড় হয়েছি, তাতে বিলিতি নতুন বছরের উদ্যাপনের আদব-কায়দা-কেতায় কোনও দিনই খুব একটা টান অনুভব করিনি। ছোটবেলায় নতুন বছর বলতে পয়লা বৈশাখকেই বুঝতাম। স্কুলের গণ্ডি পেরবো পেরবো করার সময় থেকেই সম্ভবত মনে আছে ৩১-শের উন্মাদনা আস্তে আস্তে আমাদের মিডিয়ায় খুব গ্রহণযোগ্য একটা ব্যাপার হল। দূরদর্শন নতুন বছরের আগের রাত জাগার জন্য বিনোদনের প্যাকেজ করতে শুরু করল। সে তো খুব বেশি দিন নয়। তবে তত দিনে আমার বাংলা, হিন্দি, বিলিতি, চাইনিজ, জাপানি মতে একটা বছরে পাঁচ-দশ বার নতুন বছরের বোকা বোকা উদ্যাপনে আগ্রহ টাগ্রহ সব উবে গিয়েছিল। অন্যদের আনন্দে আমি বাগড়া দিই না। সে তারা গণেশপুজোই করুক বা রবীন্দ্রনাথের। দূর থেকে উত্সবে সামিল মানুষের আনন্দ দেখতে ভালই লাগে। কিন্তু, একটা গ্লাসের ভারে টলে মেঝেতে পড়ে ‘হামি নিউ ইয়ার’ বলে গোঙাতে গোঙাতে সেলিব্রেশনে আমি নেই।
এমনিতেই উত্সবের দিনগুলোতে আমার ভীষণ একা থাকতে ইচ্ছে করে। এগুলো যেন মওকার মতো আসে আমার জীবনে। এমনকী, পুজোর দিনগুলোতে সবাই যখন মত্ত হয়ে থাকে, নতুন জামা, নতুন জুতো, নতুন ইয়ে পরে সারা রাত ধ্বস্ত হয়ে, পুরনো হয়ে বাড়ি ফেরে, আমি তখন হয়তো একা একা আমার ঘরের দেওয়ালে নতুন রং মারি। অথবা কিছু না করে নিজের মতো অলস বসে থাকি, একা থাকার স্বাধীনতায়। উত্সবের দিনগুলো কেউ খুব একটা কাছে ঘেঁষতে চায় না আমার। কারণ সে দিনগুলোতে কলকাতার ভিড়ে আমোদের অপশন অনেক বেশি থাকে। যা আমার কাছে এলে, ভীষণ ভাবে আমাতেই লিমিটেড। সুতরাং প্রায় একাই থাকি, নিজেই নিজেকে তোয়াজ করি, আদর করি। তাও পুজোর সময়, কালীপুজো, সরস্বতী পুজোর সময় ভেতরে ভেতরে একটা ফেনার মতো উত্তেজনা বুড়বুড় করে ওঠে। কিন্তু মাইরি বলছি, বড়দিন, নিউ ইয়ার্স এগুলোকে আমি ঠিক আমার উত্সব বলে মেনে নিতে পারিনি। বিশেষ করে, মানতে পারি না অনেকের এই দিনগুলোর আগে-পরে উত্সব পালনের বাধ্যবাধকতাকে। যেন এ দিনটা না পালন করতে পারলে চাকরি চলে যাবে। বরঞ্চ পয়লা বৈশাখের দিন আমার একটু হলেও মনে হয় একটা উত্সব উত্সব ক্ষণ। যদিও বাংলা মাসের দিন ক্ষণ হিসেব রাখতে পারি না। তবুও ওই দিনটা মনে থাকে।
সমস্যা একটাই, সাহেবরা বুদ্ধি করে বছরটা শীতেই শুরু করাতে আবহাওয়া একটা ফুর্তি করার লাইসেন্স দেয়। কিন্তু, আমাদের বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি বুদ্ধি গ্রীষ্মে বছর শুরু করায় বাঙালির নতুন বছর ঘাম প্যাচপ্যাচে।
আমরা বাঙালিরা ভীষণ লিবারাল, পরশ্রীকাতর। অন্যকে গ্রহণ করি ফটাফট। আর কেন জানি না নিজেদের মালের প্রতি বিশ্বাসের থেকে অন্যের মালের প্রতি নজর দেওয়া এবং মনে মনে হাপিত্যেশ করা, আর যদি পেয়ে যাই হাতে তা হলে একটু কেতা করার ইচ্ছে আমাদের মধ্যে টনটনে।
তেরো পার্বণেও সন্তুষ্ট নই আমরা। কৃষ্ণ ছেড়ে যিশু ভজনাতে আমাদের একটু লোভ বেশি। নিজের বাপের জন্মদিন মনে রাখতে পারি না, কৃষ্ণর বার্থডে তো ছেড়েই দিলাম। কিন্তু যিশুর জন্মদিন, ভ্যালেন্টাইনের মায়ের প্রসব যন্ত্রণার লগ্ন আমরা মনে রাখি। কেষ্টর মতো একটা চরিত্র যা একান্তই আমাদের সে কল্পনা হলেও আমাদের বাপ ঠাকুরদাদের নিজস্ব কল্পনা। ঢপ হলেও পুরোপুরি দেশি ঢপ। আর যদি ঢপও হয়, তা হলেও এমন ইন্টারেস্টিং ঢপ তো পৃথিবীতে বিরল। তাকে ছেড়ে বাঙালিরা ভ্যালেন্টাইন ভ্যালেন্টাইন করে মিছিল করে ফেলে প্রায়। কী বেঢপ যে লাগে!
যাক গে কেঁচো খুড়তে গিয়ে অ্যানাকোন্ডার সাক্ষাতের ইচ্ছে আমার নেই। আর দিন ক্ষণ দেখে ইচ্ছে বা প্রতিজ্ঞা করব, এ সবের অভ্যেস আমি করতে পারিনি। আমার রোজের জীবন, রোজের ইচ্ছে। তবে দূরের একটা ইচ্ছে তো থেকে যায়। যে ইচ্ছেটা আমার পরিষ্কার। গড়গড়িয়াতে একটা জায়গা কিনেছি। যেখানে আমার কবরখানা হবে। ধীকে বলে দিয়েছি। ফলকের ওপর বাপ চোদ্দপুরুষের নাম। আর আমার জন্মদিন আর মৃত্যুদিনটা লেখা থাকবে। আর একটা কথা লেখা থাকবে ‘লোকটা বেঁচে ছিল’।
এইটাই আমার রেজোলিউশন। এর জন্য বছর, মাস, যুগ টুগ না ভেবে প্রত্যেক দিন আমি ফুর্তিতে বেঁচে থাকি, রোজের আনন্দ, যন্ত্রণা, মস্তি, কষ্টগুলো নিয়ে। আমি রোজ খাটি, রোজ প্রেম করি। লড়াইটাও রোজের। দিন আনি দিন খাই, দিন বাঁচি। আমার উত্সব রোজের উত্সব। বাঁচলে তো বছর…।