Venereal Disease

লজ্জার ভয়ে তথ্য গোপন নয় যৌনরোগে

কমবয়সিদের মধ্যে বাড়ছে এসটিআই। সচেতনতার পথেই সমাধান হবে যৌন সংক্রমণের। রইল বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

Advertisement

সুনীতা কোলে

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০২৪ ০৯:২৮
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

ঘন ঘন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে আসতে হচ্ছিল বছর বাইশের মেয়েটিকে। কারণ, অস্বাভাবিক ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ। কেন বার বার এমনটা হচ্ছে, তার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, ওই ডিসচার্জ আসলে ক্ল্যামাইডিয়ার লক্ষণ। সংক্রমণ হওয়া সত্ত্বেও যৌনমিলন থেকে বিরত না থাকার কারণেই তা বার বার ফিরে আসছিল।

Advertisement

স্ত্রীরোগ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বিভিন্ন সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ইনফেকশন (এসটিআই) নিয়ে আসা রোগীদের মধ্যে বৃহত্তর অংশই এখন অল্পবয়সি। তাঁদের মধ্যে যেমন রয়েছে স্কুলপড়ুয়া, তেমন রয়েছেন ২০-৪০ এর নারী-পুরুষরাও। আইপি ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল ডার্মাটোলজি-তে ২০২০ সালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, সাত বছর ধরে একটি ক্লিনিকে যৌনরোগ নিয়ে ২১১১ জন রোগী এসেছেন। তার মধ্যে প্রায় ৩৬ শতাংশের বয়স ২১-৩০ এর মধ্যে। আর ৩৩ শতাংশ ৩১-৪০ বছর বয়সি।

এসটিআই কেন বাড়ছে অল্পবয়সিদের মধ্যে

Advertisement

স্ত্রীরোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় অল্পবয়সিদের মধ্যে এসটিআই-এর জন্য একাধিক কারণকে চিহ্নিত করছেন— কম বয়সে যৌন ভাবে সক্রিয় হওয়া, একাধিক সঙ্গী থাকা, সুরক্ষা ছাড়াই যৌন মিলন এবং সুরক্ষিত মিলন সম্পর্কে সচেতনতার অভাব। তিনি জানাচ্ছেন, কমবয়সিরা অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ নিয়ে যতটা সচেতন, তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না এসটিআই-এর ক্ষেত্রে। আবার গর্ভধারণ এড়াতেও অনেকে ঘন ঘন ইমার্জেন্সি গর্ভনিরোধক ওষুধ ব্যবহার করেন, যার গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। সমবয়সিদের আলোচনায় বা ইন্টারনেট থেকে গড়ে ওঠা ভুল ধারণাও তাঁদের ঠেলে দেয় ঝুঁকিপূর্ণ মিলনের দিকে। সব মিলিয়ে সচেতনতা এবং ঠিক তথ্যের অভাবই এই রোগের মূল কারণ।

এসটিআই-এর ধরন

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ভারতে এখন মূলত ক্ল্যামাইডিয়া বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া রয়েছে সিফিলিস, গনোরিয়া, ট্রিকোমোনিয়াসিস, অ্যানোজেনিটাল আঁচিল, জেনিটাল হার্পিস, হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি), হেপাটাইটিস বি এবং সি, হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (এইচপিভি)। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আক্রান্ত হতে পারেন এই ধরনের রোগে।

এসটিআই-এর লক্ষণ

রোগভেদে লক্ষণের তফাত হলেও সব এসটিআই-এর মূলত নির্দিষ্ট কিছু লক্ষণ থাকে। যৌনাঙ্গ থেকে অস্বাভাবিক ডিসচার্জ, অসময়ে ভ্যাজাইনাল রক্তপাত, যৌনাঙ্গে ব্যথা, আলসার, র‌্যাশ বা লাম্প, মিলনের সময়ে ব্যথা, প্রস্রাবের সময়ে ব্যথা, কুঁচকির গ্রন্থি ফুলে যাওয়া ইত্যাদি। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, অনেক সময়ে সংক্রমণ থাকলেও কোনও লক্ষণ থাকে না। কিন্তু তখনও যৌন মিলনের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারেন সঙ্গী। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে পুরুষদের এসটিআই-এর কোনও লক্ষণ থাকে না। ফলে বার বার সংক্রমিত হন তাঁদের সঙ্গী। এ ক্ষেত্রে, মেয়েটির রোগ ধরা পড়লে পরীক্ষা করাতে হবে পুরুষসঙ্গীরও।

বিপদ কোথায়

এই ধরনের লক্ষণ দেখা গেলে বা এসটিআই হয়েছে সন্দেহ হলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। ঠিক সময়ে এসটিআই-এর চিকিৎসা না হলে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে। যৌনাঙ্গ থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে দেহের অন্য অঙ্গেও। ইউরোলজিস্ট বিভাস কুণ্ডু বলছেন, “নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই চিকিৎসার অভাবে প্রভাব পড়ে জননতন্ত্রে। পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রস্টেট এবং শুক্রাণুবাহী নালিতে সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। এর সুরাহা না হলে পুরুষটির সঙ্গী বার বার সংক্রমিত হতে পারেন। এর জেরে প্রভাব পড়ে শুক্রাণু তৈরিতেও।” তা ছাড়া, চিকিৎসার অভাবে প্রস্টেটে অ্যাবসেস হয়ে তা প্রাণঘাতী পর্যায়েও পৌঁছতে পারে বলে সাবধান করছেন চিকিৎসকেরা। আবার মহিলাদের ক্ষেত্রে জরায়ু এবং ফ্যালোপিয়ান টিউবে এসটিআই-এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে তা থেকে বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত হতে পারে বলে জানাচ্ছেন, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত। চিকিৎসা না হলে এইচপিভি থেকে পরে জরায়ুমুখের ক্যানসার এবং এইচআইভি থেকে এডস হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। এসটিআই থেকে পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজ়িজ় এবং অ্যাবসেস হয়ে তা থেকে জীবনসংশয় পর্যন্ত হতে পারে। এ ছাড়া, ফ্যালোপিয়ান টিউব সংক্রান্ত বন্ধ্যাত্বের একটা বড় কারণ ক্ল্যামাইডিয়া। চিকিৎসকেরা আরও জানাচ্ছেন, কম বয়সে এমনটা হলে শুধু শারীরিক নয়, গভীর প্রভাব পড়ে মনেও, যার জের থেকে যেতে পারে দীর্ঘ দিন।

সমাধান কোন পথে

এসটিআই ঠেকাতে এবং তার চিকিৎসায় সচেতনতার কোনও বিকল্প নেই বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। যৌনতা নিয়ে সামাজিক প্রেক্ষাপটের কিছু কিছু বদল ঘটলেও সুরক্ষিত যৌনতা নিয়ে সচেতনতার অভাব এখনও রয়েছে। এর জন্য খোলাখুলি কথা বলার পরিসর গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা। স্কুলে সেক্স এডুকেশনের ক্লাসের পাশাপাশি সন্তান বয়ঃসন্ধিতে পড়লে তাদের যৌনতা সম্পর্কে স্বাভাবিক কৌতূহল মেটাতে এগিয়ে আসতে হবে বাবা-মায়েদেরই। এই সময়ে প্রজনন স্বাস্থ্য, নিজেদের শরীরের গঠন সম্পর্কে ঠিক তথ্য ও সহায়তার প্রয়োজন হয় তাদের। খুব অল্প বয়সে যৌন ভাবে সক্রিয় হওয়ার সমস্যার দিকগুলি বোঝাতে হবে তাদের। সম্পর্কে থাকলেও কেউ মানসিক ও শারীরিক ভাবে প্রস্তুত না হলে যে সঙ্গীকে ‘না’ বলার অধিকার রয়েছে, বোঝাতে হবে তা-ও। জানাতে হবে, সম্পর্কে যৌনমিলন একটা বড় দায়িত্বও বটে।

রোগ এড়াতে সুরক্ষিত যৌনমিলনের দিকেও জোর দেওয়া দরকার। এর জন্য কন্ডোমই সবচেয়ে ভরসাযোগ্য। এ ছাড়া, অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ এড়াতে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ব্যবহার করা যেতে পারে কন্ট্রাসেপটিভ পিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন