দিল্লি যান্ত্রিক। দিল্লি নিষ্ঠুর। নির্ভয়া ধর্ষণ কাণ্ডের পরে রাজধানীর বাসিন্দাদের এই অমানবিক চেহারা নিয়ে চর্চা হয়েছিল বিস্তর।
প্রাণ দিয়ে ফের রাজধানীর সেই চেহারার প্রমাণ দিয়ে গেলেন উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুরের বাসিন্দা মহম্মদ মতিবুর।
গ্রামের বাড়িতে রোজগার নেই। তাই বছর পনেরো আগে দিল্লিতে চলে এসেছিলেন বছর পঁয়ত্রিশের মতিবুর। সকালে রিক্সা চালাতেন। রাতে সেই রিক্সামালিকের গ্যারেজ পাহারা দিতেন।
গত কাল সকালে রাত পাহারার কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন বছর পঁয়ত্রিশের মতিবুর। আচমকাই পিছন থেকে একটি তিন চাকার ভ্যান এসে ধাক্কা মারে তাঁকে। ছিটকে পড়েন মতিবুর। বৃষ্টি ভেজা ভোরের সকালে সুভাষনগরের খোলা রাস্তায় পাক্কা দেড় ঘণ্টা ছটফট করে মারা যান তিনি। সিসিটিভি ফুটেজ বলছে, মতিবুরকে ধাক্কা মারা ভ্যানের চালক গাড়ি থেকে নেমে দেখে তিনি বেঁচে আছেন কি না। গাড়িতে রক্ত লেগেঠে কি না তাও পরীক্ষা করে। তার পর পালায়।
এর পরের ৯০ মিনিটে ৪০টি গাড়ি, ৮২টি অটো, ১৮১টি বাইক এবং জনা পঁয়তাল্লিশ ব্যক্তি মতিবুরকে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছেন। না দেখার অভিযোগ উঠেছে একটি পুলিশ ভ্যানের বিরুদ্ধেও। গোটা পর্বে থমকে দাঁড়িয়েছিল এক জন মাত্র রিক্সাওয়ালা। সে আহত মতিবুরের মোবাইলটি পকেটস্থ করে ফের রিক্সার প্যাডেলে চাপ দেয়।
মতিবুল
মতিবুর যে গ্যারেজে কাজ করতেন, সেখানেই রিক্সা চালান ইদু নামে আর এক যুবক। সকাল সাড়ে ছ’টা বাজলেও মতিবুর আসছেন না দেখে ইদু গ্যারেজের দিকে রওনা দেন। পথে মতিবুরকে পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। ততক্ষণে অবশ্য এসে হাজির হয়েছে স্থানীয় হরিনগর থানার পুলিশও। হাসপাতালে নিয়ে গেলে মতিবুরকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যু হয়েছে তাঁর।
তিহাড় গাঁওয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন ইসলামপুরের শ’চারেক বাসিন্দা। ঘুপচি গলিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে থাকেন তাঁরা। বঙ্গসন্তানরা এখানে কেউ রিক্সা চালান। কারও রুটি রুজি চলে হোটেলে কাজ করে। যে ভাবে আহত মতিবুর দেড় ঘণ্টা বিনা চিকিৎসায় পড়ে থেকে মারা গেলেন তা মেনে নিতে পারছেন না তাঁদের কেউই। গত কুড়ি বছর ধরে ওই এলাকায় রয়েছেন মহম্মদ আকালু। স্থানীয় বাঙালিদের কার্যত অভিভাবক তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘ইদু দেখতে না পেলে ঘটনার কথা আমরা জানতেই পারতাম না।’’ মতিবুরের আর এক পড়শি আসলাম বলেন, ‘‘পাশেই মিরাজ সিনেমার চৌকিদারেরা চেয়ার পেতে বসে ঘটনা দেখছে। দুধের গাড়ি থেকে প্যাকেট নামানো হচ্ছে। কিন্তু ওই আহত মানুষটিকে দেখে কারও কোনও হেলদোল হয়নি।’’ গ্রেফতার হয়েছে ঘাতক ভ্যানের চালক রাজেশ।
যে রিক্সাচালক মতিবুরের মোবাইল নিয়ে চলে গিয়েছিল, তাকেও আটক করেছে পুলিশ।
কিন্তু আহত মতিবুরকে দেখেও যাঁরা এগোলেন না, তাঁরা কেমন মানুষ? একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হিসেবে প্রতি বছর এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় দেড় লক্ষ লোক মারা যান। সময়ে হাসপাতালে পৌঁছে দিলে যাঁদের একটি বড় অংশকে বাঁচানো সম্ভব হতো বলেই সমীক্ষায় পেয়েছে ওই সংগঠন। কিন্তু সড়কে দুর্ঘটনা দেখে বা সাহায্যের জন্য চিৎকার শুনেও মানুষের এগিয়ে যাওয়ার নজির ক্রমশই কমে আসছে বলেই জানাচ্ছে সংগঠনটি। এমনকী দুর্ঘটনায় আহত মানুষের ছবি তুললেও সাহায্য করতে এগোন না অনেকে।
এমন ক্ষেত্রে হাসপাতালে পৌঁছে দিলে পুরস্কার দিতে উদ্যোগী হয়েছে দিল্লি সরকার। এমনকী সাহায্যকারীকে যাতে পুলিশি ঝামেলা পোহাতে না হয়, সে জন্য নির্দেশিকা জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু তাতে মানসিকতা বদলাবে কি?
প্রশ্নটা থাকছেই।