এগারো অস্ত্রোপচারে ফিরেছিল জীবন

প্রথম হুঁশ ফেরে বাঁ হাতের কবজিতে একটা বুলেট ঢোকার পর।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:৪১
Share:

নিগমপ্রিয় চক্রবর্তী। নিজস্ব চিত্র

শিরদাঁড়া ছুঁয়ে থাকা একটা বুলেট। যা তাঁকে এখনও ভাল করে বসতে দেয় না।

Advertisement

কিন্তু বৃহস্পতিবার কাশ্মীরে সেনা কনভয়ে জঙ্গিহানার খবর শুনে টিভির পর্দায় চোখ রেখে সিআরপি-র ১৬১ নম্বর ব্যাটেলিয়নের জওয়ান নিগমপ্রিয় চক্রবর্তী ঠায় বসে আছেন। অস্থির হাতে ঘুরিয়ে চলেছেন রিমোটের বোতাম। দুর্ঘটনার ছবি দেখে কখনও শিউরে উঠে বলছেন— “উফ! সেই একই জায়গা!” কখনও বা অনর্গল বলে চলেছেন, বছর তিনেক আগের এমনই এক জঙ্গিহানায় সাক্ষাৎ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার কথা।

দিনটা ছিল ২৫ জুন, ২০১৬। বিকেল চারটে নাগাদ ছোট বড় পাঁচটি গাড়ি বোঝাই সিআরপি জওয়ান কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার অবন্তিপুরা থানার লেথপোরা ক্যাম্প থেকে ফায়ারিং অনুশীলন সেরে ফিরছিল শ্রীনগরে। সামনে তিনটে ছোট গাড়ি। চতুর্থ গাড়িটি ছিল সেনা জওয়ানে ভরা একটি বাস। পিছনে আরও একটি।

Advertisement

১৪ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতি বার যেখানে জঙ্গিরা হামলা চালায় কনভয়ের উপরে। তার চেয়ে বড় জোর একশো মিটার দূরত্ব। পাম্পোরের কাছে বাসটা পৌঁছতেই আচমকা সামনে চলে আসে একটি ছোট অল্টো গাড়ি। চালক বাধ্য হয়ে বাস থামাতেই স্বয়ংক্রিয় এ কে ফর্টি সেভেনের গুলিতে গুঁড়িয়ে যায় বাসের উইন্ডস্ক্রিন।

তার পর মিনিট কুড়ি ধরে শুধুই গুলি আর পাল্টা গুলি।

জানালেন, বাসের দরজা দিয়ে উঠেই ডান দিকের সিটে বসে ছিলেন নিগমপ্রিয়। তাঁর কথায়, “ফায়ারিং রেঞ্জে সারা দিনের প্রবল ধকলের পর সকলেই কম-বেশি ক্লান্ত ছিলাম। প্রথমে বুঝতেই পারিনি কী হচ্ছে! কিন্তু কাঁচের টুকরো উড়ে আসতেই বুঝলাম আমরা আক্রান্ত। তাকিয়ে দেখি, একটা এ কে ফর্টি সেভেনের নল কাচভাঙা বাসের সামনে দিয়ে ঢুকে চালককে মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁঝরা করে দিল।”

এর পর আর বেশি ক্ষণ ভাবার সময় নেননি নিগমপ্রিয়। লাফিয়ে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের রাইফেল থেকে জবাব দিতে শুরু করেন। তিনি বলেন, “সেই মুহূর্তে আমি কী ভাবে কী করেছি, মনে নেই। শুধু মনে আছে আমার কাছে তখন তিনটি ম্যাগজিন মানে নব্বইটা বুলেট ছিল। আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম একবারে ম্যাগজিন খালি করব না। নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ফায়ার করতে হবে।’’

প্রথম হুঁশ ফেরে বাঁ হাতের কবজিতে একটা বুলেট ঢোকার পর। বলেন, ‘‘জঙ্গিরা আমাদের চেয়ে বড় জোর হাত তিরিশেক দূরে। বাসের সামনে আর পাশ থেকে নাগাড়ে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। একটা গুলি আমার কবজি ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। আর একটা বুকের বাম দিক দিয়ে ঢুকে পাঁজরার হাড়ে ধাক্কা দিয়ে ফুসফুস ছুঁয়ে নাভির কাছে পৌঁছে যায়। এ দুটো গুলি সামনে থেকে এসেছিল। আর তৃতীয়টা তলপেট দিয়ে ঢুকে ছিল।”

বাঁ হাতের কবজি তখন ঝুলছে। ওই অবস্থায় শুধু ডান হাতে রাইফেল চালিয়ে দুটো ম্যাগজিনের ষাটটা বুলেট শেষ করেন নিগমপ্রিয়। তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের পাল্টা জবাবে তত ক্ষণে খতম হয়েছে দুই জঙ্গি।

সে দিনের ওই হামলায় মৃত্যু হয়েছিল আট জন জওয়ানের। আহত হন আঠারো জন। তাঁদের মধ্যে সব চেয়ে আঘাত ছিল নিগমপ্রিয় চক্রবর্তীর। প্রাণ বাঁচাতে এখনও পর্যন্ত শরীরে মোট এগারো বার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে নিগমপ্রিয়ের। তবু বার করা যায়নি শিরদাঁড়ার কাছে পৌঁছে যাওয়া এ কে ফর্টি সেভেনের গুলি।

গুলিতে ছিন্নভিন্ন পেট থেকে বেরিয়ে আসা নাড়িভুঁড়ি আগের মতো করে সেলাই করতে করা হয়েছে স্ক্রিন গ্রাফটিং। কিন্তু তার বিনিময়ে এক বিরাট হার্নিয়া জন্ম নিয়েছে তাঁর শরীরে। যা তাঁর আজীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। গুলিতে ঝাঁঝরা বাঁ হাত বর্তমানে পুরোপুরি অকেজো।

কাশ্মীরের হামলা দেখে বত্রিশ মাস আগের সেই বিকেলের কথা কথা মনে পড়ছে নিগমপ্রিয়ের। নবদ্বীপের বাড়িতে বসে ছটফট করছেন তিনি।

নিহতদের তালিকা থেকে দু’জনের নাম দেখিয়ে বলছেন, “এক সময়ে আমরা একই ব্যাটেলিয়নে ছিলাম।”

আর বলছেন, “সে দিনের পর থেকে আমি জানি, মৃত্যু আসলে কী!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন