আজ বাদে কাল মায়ের বোধন, এক বছরের অপেক্ষা শেষ। উৎসবের শুরু। অথচ এই পুজোর আনন্দের বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বৃন্দাবনের বিধবারা! যাঁদের কাছে পুজো শুধু স্মৃতি। যা সততই বেদনার।
বৃন্দাবনে ভীষণ একাকিত্ব আর প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে যে সব বৃদ্ধা বিধবা জীবনধারনের জন্য লড়াই করছেন, বোধহয় তাঁদের সকলেরই উপাখ্যান এক। হ্যাঁ, এ এক লড়াই-ই বটে। বেঁচে থাকার লড়াই। তিলতিল করে যে পরিবার তিনি গড়ে তুলেছিলেন, সেই পরিবারেই তিনি আজ ব্রাত্য। বৃদ্ধ অবস্থায় বাড়ি থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরে জীবনধারণ করা যুদ্ধের থেকে কম কী? এই মহিলারা যথেষ্ট সাহসী এবং দৃঢ়। কিন্তু মায়ের মন তো! তাই দু’চোখে আশা। ব্যস্ততার মধ্যেও হয়ত সন্তান আসবে দেখা করতে। পুজোর আনন্দ উৎসবের মধ্যে হয়ত মনে পড়বে মায়ের কথা।
বৃন্দাবনের মাতৃমন্দির বিধবা আশ্রমে এসে দেখা মিলল বেলঘড়িয়ার নব্বই বছরের রেণু দাসের। চলাফেরা করতে পারলেও নষ্ট হয়ে গিয়েছে বেশির ভাগ স্মৃতি। কিন্তু ছেলে-মেয়েদের কথা জি়জ্ঞাসা করতেই ফোকলা মুখে একগাল হাসি। তিন মেয়ের অত্যাধুনিক জীবনে ঠাঁই হয়নি তাঁর। অগত্যা শেষ ঠিকানা বৃন্দাবনের মাতৃমন্দির বিধবা আশ্রম। পুজোর কথা জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, “কত ঠাকুর দেখেছি একসময়ে। কলকাতার বড়বড় ঠাকুর দেখতাম মেয়েদের নিয়ে লাইন দিয়ে। মহালয়া থেকে পুজোর উৎসব শুরু হয়ে যেত, বিজয়া দশমীতে শেষ হতো।”
যে সন্তানদের আবদার মেটাতে নিজের শখ-স্বাদ বিসর্জন দিয়েছিলেন, আজ তাদের জীবনে শখ-আহ্লাদ আছে কিন্তু মা’র জন্য স্থান নেই। তবু রেণু দাস খুশি, কেন না তাঁর মাথার ওপর ছাদ রয়েছে, দু’বেলা খাওয়াও জুটে যায় আশ্রমে। আরও ৬৯ জন নিঃসহায় বিধবা মহিলাদের নিয়ে নতুন পরিবার তাঁর। কিন্তু তাঁর মতো ভাগ্য নয় বেণুবালা দেবীর। বাঁকেবিহারি মন্দিরের সামনে ভিক্ষা করে জীবনযাপন করতে হয় তাঁকে। মন্দির চত্বরের পাশে এক ভাঙা কুঁড়েতে থাকেন। এক কালে থাকতেন বর্ধমান জেলার কোনও এক গ্রামে। নাম মনে করতে পারলেন না, বা চাইলেন না। স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই ছেলে পৃথক হয়ে যায়। দুই ছেলের কারও সংসারে ঠাঁই হয়নি তাঁর। এক ছেলে বৃন্দাবন ঘুরিয়ে নিয়ে আসার ছলনায় এখানে ফেলে রেখে চলে যায় বছর কুড়ি বছর আগে। তারপর থেকে আর কখনও কারও সঙ্গে দেখা হয়নি। পুজোর কথা জিজ্ঞাসা করতেই জলে ভরা দু’চোখ তুলে বললেন, “ভুলে গিয়েছি দেশের পুজোর কথা। এখানে পুজো হয় কয়েকটা। সে ক’দিন পেট ভরে খাওয়া মেলে। মায়ের মুখ আর দেখি না, শুধু ভিক্ষা পেতে আর পেট ভরে ভোগ খাওয়ার জন্য যাই। পুজোতে কম্বলও পাই কখনও কখনও।” বলে দেখালেন গত বারের উপহারটিকে।
তবে সুলভ ইন্টারন্যাশনালের বিধবা আশ্রমে কোন্নগরের ধনবতী দাস জানালেন, তিনি এখানে ভালই আছেন। ছেলেদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় বৃন্দাবনে চলে এসেছিলেন। মাথার ওপর ছাদ, দু’বেলা খাওয়া, আর কিছু চান না তিনি। কখনও কখনও বাড়িতে যান। ছেলেরাও আসে তাঁর কাছে। কিন্তু তিনি আর ফিরে যেতে চান না। পুজো নিয়ে অনেক স্মৃতি তাঁর। জানালেন, আগে প্রতি বছরই কলকাতার পুজো দেখতে যেতেন ছেলেদের সঙ্গে। কাঁচরাপড়ার দুলারী দাসের মন কিন্তু আজও কাঁদে পুজোর সময়। যে সংসারে তাঁর ঠাঁই হয়নি, সেই সংসারের কল্যাণের জন্য আজও ষষ্ঠীর উপোস করেন নিয়ম করে। মাতৃমন্দিরের কর্মকর্তারা আবাসিকদের মন ভালে করার জন্য এখানে দুর্গা পুজোর আয়োজনও করেছেন। বৃন্দাবনে বিধবাদের বেঁচে থাকা খুবই কঠিন। এই অসম্মান আর কঠিন লড়াইয়ের জীবনে একাকিত্ব আর অপেক্ষা থাকলেও তাঁদের কোনও অভিযোগ নেই কারও বিরুদ্ধে।