রাহুলের বিরুদ্ধেই ফুঁসছেন কর্মীরা

একের পর এক ন’টি নির্বাচনে হেরে ‘হেরো পার্টি’র তকমা আগেই সেঁটেছে গায়ে। দিল্লিতে দশ নম্বর ভোটে খাতাই খুলতে না পেরে এ বার আরও মুখ পোড়াল কংগ্রেস! স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে— খাস রাজধানীতে এ ভাবে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাওয়ার দায় কি সনিয়া গাঁধী, রাহুলের? নাকি ‘গাঁধী পরিবার’ নামের ম্যাজিকটাই ক্রমশ ফিকে হচ্ছে জাতীয় রাজনীতি থেকে!

Advertisement

শঙ্খদীপ দাস

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩০
Share:

মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে কংগ্রেসের সদর দফতরে উপস্থিত শুধুই সংবাদমাধ্যম। দেখা নেই নেতা-কর্মীদের। ছবি: এএফপি

একের পর এক ন’টি নির্বাচনে হেরে ‘হেরো পার্টি’র তকমা আগেই সেঁটেছে গায়ে। দিল্লিতে দশ নম্বর ভোটে খাতাই খুলতে না পেরে এ বার আরও মুখ পোড়াল কংগ্রেস!

Advertisement

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে— খাস রাজধানীতে এ ভাবে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাওয়ার দায় কি সনিয়া গাঁধী, রাহুলের? নাকি ‘গাঁধী পরিবার’ নামের ম্যাজিকটাই ক্রমশ ফিকে হচ্ছে জাতীয় রাজনীতি থেকে!

লোকসভা ভোটের আগে চারটি রাজ্যে হেরেছে কংগ্রেস। পরে আরও চারটি। ক্ষোভে অসন্তোষে রাহুলের বিরুদ্ধে এমনিতেই ফুঁসছিলেন দলের নেতা-কর্মীরা। জোড়াতালি দিয়ে তবু সামলে রাখছিলেন সনিয়া। কিন্তু আজ, দিল্লিতে গোটা কংগ্রেস দলটাই কার্যত জামানত খোয়ানোর পর, বিদ্রোহের গন্ধ পেতে শুরু করেছেন দলের নেতৃত্ব। কংগ্রেসের নেতারাই বলছেন আজ কাল বা পরশু, যে কোনও দিন অনাস্থার মুখে পড়তে পারেন রাহুল। প্রকাশ্যে প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে তাঁর দল চালানোর কৌশল।

Advertisement

দলের অবক্ষয়ের ছবিটা কেমন? ২০১৩-র ডিসেম্বরে বিধানসভা ভোটে দিল্লিতে কংগ্রেসের ভোট ছিল ২৫ শতাংশ। ২০১৪-র মে মাসের লোকসভায় তা কমে হয় ১৫ শতাংশ। এ বার ভোটের পরিমাণ মাত্র ৯.৭%! দিল্লিতে গরিব-নিম্নবিত্তের ভোট আগেই কংগ্রেসের হাতছাড়া হয়েছে। এ বার ঝুলি থেকে বেরিয়ে গেছে সংখ্যালঘু ভোটও। ফলে বাল্লিমারান, চাঁদনি চক, মাটিয়া মহল, ওখলা, মুস্তাফাবাদের মতো সংখ্যালঘু এলাকায় ঝেঁটিয়ে সাফ হয়ে গিয়েছে কংগ্রেস। গোটা ভোটপ্রচার পর্বে একমাত্র সীলমপুরে সভা করেছিলেন সনিয়া। আগের ভোটের তুলনায় সেখানে ২৩ হাজার ভোট কমেছে কংগ্রেসের। যেখানে রাহুল সভা করেছেন, সেখানেও ধস কোথাও দশ হাজার কোথাও বিশ। সর্বোপরি আম আদমি-র সঙ্গে কংগ্রেসের দূরত্ব এতটাই বেড়েছে যে, রাহুলের ‘তেজি ঘোড়া’ প্রদেশ সভাপতি অরবিন্দ সিংহ লাভলির এলাকায় তৃতীয় হয়েছে কংগ্রেস। অথচ আগের বিধানসভাতেও এই গাঁধীনগরে জিতেছিল কংগ্রেস।

কিন্তু উদ্বেগ শুধু দিল্লিকে নিয়ে নয়। প্রশ্ন উঠে গিয়েছে— এর পরেও জাতীয় দলের জার্সি কি মানায় কংগ্রেসের গায়ে? কংগ্রেসের নেতারা এ আশঙ্কাও করছেন, সর্বভারতীয় দল হিসেবে কংগ্রেসকে হয়তো আর বিকল্প বলেই গ্রহণ করবে না মানুষ। দিল্লি ভোটের ফলাফল স্পষ্ট হতেই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এক সদস্য বলেন, “বিজেপি হেরেছে ঠিকই। কিন্তু তাদের ৩২ শতাংশ ভোট তো অটুট রয়েছে! নিত্য নতুন এ রকম আঞ্চলিক শক্তি মাথা তুললে সেটাই হয়ে যেতে পারে নরেন্দ্র মোদীর জীবনবিমা। কারণ জাতীয় স্তরে বিজেপির আর কোনও বিকল্পই থাকবে না মানুষের সামনে।”

আশঙ্কার সেই সিঁদুরে মেঘ দেখেই বিদ্রোহের বাষ্প জমতে শুরু করেছে ১২ নম্বর তুঘলক রোডের কংগ্রেস সদর দফতর ঘিরে। কেন এর দায় নেবেন না সনিয়া-রাহুল? কেন প্রতিবার দল হারলে দোষ চাপানো হবে স্থানীয় নেতৃত্বের ঘাড়ে? আর সামান্যতম সাফল্যের কৃতিত্ব দেওয়া হবে গাঁধী পরিবারকে?

দিল্লি ভোটে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মাকেনকে কার্যত মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী করেছিল কংগ্রেস। রাহুলের ঢাল হয়ে আজ তড়িঘড়ি ভরাডুবির দায় নিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দেন মাকেন। প্রদেশ সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন লাভলিও। কিন্তু ঘরোয়া আলোচনায় জনার্দন দ্বিবেদীর মতো নেতারা বলছেন— পরাজয় এতটাই বেআব্রু করে দিয়েছে কংগ্রেসকে, যে এ সব ‘ছেঁদো ইস্তফায়’ কাজ হবে না। উল্টে তাঁরা এই প্রশ্ন তুলছেন, ভোটে প্রার্থী হতেই যিনি রাজি ছিলেন না সেই মাকেনকে কেন দলের মুখ করা হল? তার পর লাভলি-বাহিনী যখন অন্তর্ঘাত শুরু করল, তখন তাদেরই বা বাগে আনতে পারলেন না কেন রাহুল?

গত লোকসভা ভোটের পর দিল্লিতে সাময়িক ভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল আম আদমি পার্টি। আজ সেই প্রসঙ্গ টেনে কংগ্রেসের একাধিক নেতা প্রশ্ন তোলেন, তার পরেও কেন কেজরীবালের জন্য মাঠ ফাঁকা রেখেছিলেন রাহুল? কেন ছ’মাস আগে থেকে ভোট-প্রস্তুতি শুরু করেননি? কেনই বা নিজে মাঠে না নেমে স্রেফ ঘরে বসে কৌশল রচনা করে গিয়েছেন? যে কৌশল আদতে কোনও কাজেই আসেনি।

শুধু তাই নয় সংখ্যালঘু ভোট হাতছাড়া হওয়ার প্রশ্নেও রাহুলকেই কাঠগড়ায় তুলছেন কংগ্রেস নেতাদের একাংশ। দলের এক সাধারণ সম্পাদকের মতে, “রাহুল মুখে সংখ্যালঘু প্রীতির কথা বলছেন। অথচ ত্রিলোকপুরীতে যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হল, তখন এক বারও গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ালেন না। সংখ্যালঘুরাও বুঝে গিয়েছেন, মোদীকে রোখা রাহুলের কম্মো নয়।”

কংগ্রেস সূত্র বলছে, কেবল দিল্লি নয়, রাহুলের ওপর বিদ্রোহ আছড়ে পড়তে পারে অন্য রাজ্য থেকেও। পঞ্জাব ভোটের রাশ নিজের হাতে তুলে নিতে চেয়ে এর মধ্যেই বার চারেক সনিয়া-রাহুলের সঙ্গে দেখা করেছেন সেখানকার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অমরেন্দ্র সিংহ। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, অচিরেই নতুন দল গড়ার হুমকি দিতে পারেন তিনি। একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগড়েও।

এই বিদ্রোহের আঁচ যে রাহুল পেতে শুরু করেছেন, তা-ও আজ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। তাঁর তরফে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ক্ষত নিরাময়ে দ্রুত পদক্ষেপ করবে দল।” কংগ্রেসিরা যার অর্থ করছেন, আমূল সাংগঠনিক রদবদল করা হতে পারে। কিন্তু সেই সাংগঠনিক সংস্কার ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টাও শুরু হয়ে গিয়েছে দলের মধ্যে। কিছু বর্ষীয়ান নেতা চান, রাহুল ব্যর্থই হোন। কারণ, রাহুল বয়স্ক মুখ বাদ দিয়ে নতুনদের তুলে আনার পক্ষপাতী। রাহুল ব্যর্থ হলে দলের উপরে তাঁর কর্তৃত্ব আলগা হবে। তখন প্রবীণদের গুরুত্ব দেওয়ার জন্য তাঁর উপরে চাপ বাড়ানো সহজ হবে।

তবে রাহুল অনুগামী নেতা রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা আজ বলেন, “সনিয়া বা রাহুল গাঁধীর কর্তৃত্ব আলগা হয়েছে যাঁরা বলছেন, তাঁরা স্বপ্নের জগতে রয়েছেন।” তাঁর মতে, এমন সঙ্কট কংগ্রেস অতীতেও দেখেছে। ’৯৮ সালে মাত্র তিনটি রাজ্যে সীমাবদ্ধ ছিল দল। সেখান থেকে সনিয়া গাঁধীই দলকে টেনে তুলেছেন। সম্প্রতি ছত্তীসগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে পুর ও পঞ্চায়েত ভোটে ভাল ফল করেছে কংগ্রেস। দশ জনপথ ঘনিষ্ঠ প্রাক্তন এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলছেন, এই ঘোর সঙ্কটেও গাঁধী পরিবারের নেতৃত্ব হারানোর কোনও ভয় নেই। কারণ, কংগ্রেসে এমন কোনও সর্বজনগ্রাহ্য নেতা নেই, যিনি গাঁধী পরিবারের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেন।

ফলে কর্মীরা ফুঁসলেও কংগ্রেসে হয়তো নিরাপদ রাহুল। কিন্তু কংগ্রেসই আর নিরাপদ কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন