জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)নিয়ে অসমের প্রচুর বাঙালি পরিবার সঙ্কটের মুখে। কারণ বিবাহিত মহিলাদের নাগরিকত্ব প্রমাণে স্বামী নয়, তাঁদের বাপ-ঠাকুর্দার কাগজপত্র দেখাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এবং তাও হতে হবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগের। ৪৫ বছর আগের কাগজপত্র খুঁজে বের করতে স্বামী-সন্তানরাই হিমসিম খাচ্ছে। এর উপর বাপের বাড়ির কাগজ জোগাড় করা!
ঘরে ঘরে এ নিয়ে চলছে অস্থিরতা। অনেক মহিলা বলছেন, তা একেবারে অসম্ভব। তাহলে কী হবে? স্বামী-সন্তানদের নাগরিকত্ব চূড়ান্ত হলেও পরিবারের বিবাহিত মহিলাটিকে কি বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হবে? তাঁর সংসার কি ভেঙে যাবে? রাষ্ট্র কি তাঁকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে? এই সব নানা প্রশ্ন এখন মুখে মুখে।
আজ শিলচর গাঁধীভবনে নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটি (সিআরপিসি)-র রাজ্য অভিবর্তনে এই বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়। দাবি ওঠে, বিবাহিত মহিলাদের নাগরিকত্ব প্রমাণে স্বামীর কাগজপত্রকেই গণ্য করতে হবে। দিনভর আলোচনার পর স্থির হয়, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে প্রথমে সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত নোডাল অফিসার প্রতীক হাজেলার সঙ্গে কথা বলবেন। নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্টের নথিগুলিকেও সংযোজনের দাবি জানাবেন। অসমের এই সংগঠনের রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাধন পুরকায়স্থ বলেন, ‘‘বিষয়গুলি সুপ্রিম কোর্টের নজরে আনতে নোডাল অফিসারকে অনুরোধ করা হবে।’’ তিনি জানান, জুনের প্রথম দিকে দিল্লি যাবেন তাঁরা। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তাঁরা বিষয়টি নিয়ে দেখা করবেন। চাইবেন তাঁর হস্তক্ষেপ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ এবং রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ সিটিজেন-এর সঙ্গেও দেখা করবেন তাঁরা।
নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির জেলা সভাপতি মোজাম্মিল আলি লস্কর বিবাহিতাদের দলিলের যে বিধান দেওয়া হয়েছে, তাকে ‘অদ্ভুত’ আখ্যা দেন। ওই বিধানে বলা হয়েছে, বিবাহের পর স্থানান্তরিত মহিলাদের ক্ষেত্রে সার্কেল অফিসার বা গ্রাম পঞ্চায়েত সচিবের প্রমাণপত্রও গৃহীত হবে। মোজাম্মিল আলির প্রশ্ন, ৪৩ বছর আগে কার বিয়ে কোথায় হয়েছিল, আজকের পঞ্চায়েত সচিব তা কী করে বলবে? তাই সার্কল অফিসার বা গ্রাম পঞ্চায়েত সচিবরা এ ধরনের নথি দিতে নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করছেন। এতে জনসাধারণ আতঙ্কিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এনআরসি চূড়ান্ত করার আগে সন্দেহভাজন বা ডাউটফুল (ডি)-ভোটারদের নাগরিকত্বের ব্যাপারেও ফয়সালা করার দাবিও আজকের প্রস্তাবনায় রাখা হয়। নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির মুখ্য উপদেষ্টা হাফিজ রশিদ আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘‘গত ১৩ বছরে ৮৮ হাজার মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার জনকে বিদেশি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এর মানে ডি-ভোটারদের ৯৫ শতাংশই প্রকৃত ভারতীয়। তাঁদের বাদ দিয়ে এনআরসি তৈরি হলে প্রকৃত চিত্র প্রকাশিত হবে না।’’ তাই তাঁর আর্জি, ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে দ্রুত ডি-ভোটার মামলাগুলির নিষ্পত্তি করা হোক।
বিধায়ক আতাউর রহমান মাঝারভুইয়া এনআরসি জটিলতাকে রাজনৈতিক ষড়য়ন্ত্র বলে উল্লেখ করেন। পৃথক বরাকের দাবির কথাও আজ বারবার উঠে আসে। নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির সভাপতি নৃপেন্দ্র সাহা-সহ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার প্রতিনিধিরা বরাক উপত্যকাকে অসম থেকে আলাদা করার দাবি না তুলতে অনুরোধ করেন। তাঁদের কথায়, ‘‘বরাক পৃথক হলে ব্রহ্মপুত্রের বাঙালিদের উপর নির্যাতন বাড়বে।’’
এনআরসি ইস্যুতে যারা আন্দোলন করছেন, সবাইকে নিয়ে সমন্বয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন পরিতোষ পালচৌধুরী, হরিদাস দত্ত, সুফিয়া বেগম-রা। অনেকেই তাকে সমর্থন করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত এ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। বরং নাগরিকত্ব সুরক্ষা সংগ্রাম কমিটি নামে আরেকটি সংগঠন যে আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিয়েছে হাফিজ চৌধুরী এর বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, ‘‘আইন মেনে আন্দোলন করব আমরা।’’
এ দিকে, ইয়ুথ এগেনস্ট সোশাল এভিল (ইয়াসি)-র পক্ষ থেকে আজ দুধপাতিলে এক নাগরিক সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে সংগঠনের প্রধান সঞ্জীব রায় বক্তব্য রাখেন।