পি রাজীব
সাধারণ সম্পাদক হয়ে যে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, হয়তো আশাই করেননি সীতারাম ইয়েচুরি।
এমন ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। সিপিএমের এক সাংসদের মেয়াদ ফুরিয়েছে। তাঁকে রাজ্যসভায় ফিরিয়ে আনার জন্য দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে একযোগে আর্জি জানাচ্ছেন সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা। অথচ এত দিন তাঁদের উদ্দেশেই লাগাতার আক্রমণ শানিয়েছেন ওই সাংসদ। শুধু তা-ই নয়, সপা, বসপা, ডিএমকে, বিজেডি— সব দলই ওই সাংসদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমনকী সৌহার্দ্য-বার্তা দিচ্ছে তৃণমূলও!
কেরলের সাংসদ পি রাজীবকে ঘিরে এমন ঘটনাই আজ ঘটল রাজ্যসভায়। তিন দিন আগে রাজীবের মেয়াদ ফুরিয়েছে। তাঁর বদলে কেরল থেকে কে কে রাগেশকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছে সিপিএম। বিদায়ী সাংসদদের উদ্দেশে রাজ্যসভায় আজ শুভেচ্ছা-বক্তৃতা দেন সব দলের নেতারা। এবং সেখানেই ইয়েচুরিকে যারপরনাই বিব্রত করে প্রবল ‘রাজীব ফেরাও’ দাবি ওঠে। সাংসদেরা বলেন, ইয়েচুরি সদ্য সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। তিনি রাজীবকে ফিরিয়ে আনুন। ইয়েচুরি বোঝানোর চেষ্টা করেন, আগামী বছর কেরলে বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে রাজীবকে এর্নাকুলামের জেলা সম্পাদক করা হয়েছে। কিন্তু সেই যুক্তি শোনেননি কেউ। শেষে ইয়েচুরি বলেন, বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই নরেন্দ্র মোদী সরকারের। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই বিরোধী দলগুলিকে একজোট করে মোদী সরকারকে সর্বক্ষণ চাপে রেখে যান ইয়েচুরি। এত দিন সেই কাজে তাঁকে যোগ্য সঙ্গত করে গিয়েছেন রাজীব। সেই সাংসদকে ফেরাতে কেন এমন দাবি উঠল একযোগে?
কারণ বোঝাতে গিয়ে কেউ কেউ বলছেন, আদর্শ সাংসদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজীব। সেটা যেমন রণকৌশল রূপায়ণে, তেমনই আচরণে, কিংবা পাণ্ডিত্যে। এ সবেরই প্রতিফলন দেখা গিয়েছে আজ। রাজীব এবং অন্য দুই বিদায়ী সাংসদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হামিদ আনসারি বলেছেন, ‘‘এঁরা সভার সম্মান বাড়িয়েছেন।’’
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু বা বিরোধী দলনেতা গুলাম নবি আজাদ মূলত বলেছেন হাল্কা চালে। কিন্তু রাজীবের মুন্সিয়ানা স্বীকার করে নিতে কসুর করেননি। জেটলি বলেন, ‘‘রাজ্যসভায় বিতর্কের নিয়মকানুন খুঁজে খুঁজে বের করে শাসক দলকে তটস্থ করে রাখাটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন রাজীব।’’ গুলাম নবি যোগ করেন, ‘‘রাজীব ছিলেন নিয়ম-কানুনের এনসাইক্লোপিডিয়া। ওঁর আইপ্যাডটা হাতে পেলে লাভ হতো।’’ বেঙ্কাইয়ার কথায়, ‘‘এমন একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি সিপিএমে রয়েছেন এবং এনডিএ-সরকারের বিরোধিতা করেন— এটাই আশ্চর্য!’’ ইয়েচুরি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেন, ‘‘রাজীব যথেষ্ট বুদ্ধিমান বলেই তিনি সিপিএমে।’’
জেটলিদের সুরে সুর মেলান বসপা নেত্রী মায়াবতী, জেডিইউ নেতা শরদ যাদব, অকালি দলের নরেশ গুজরাল-রা। শরদ আবার যুক্তি দেন, কমিউনিস্টদের মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ দলের অস্তিত্ব কমে আসছে। তাই রাজীবকে ফেরানোর আরও চেষ্টা করা উচিত। তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, ‘‘হয়তো আমরা একে অন্যের মতাদর্শকে পছন্দ করি না, তবু আজ যে ওঁকে বিদায় জানাচ্ছি সেটা কোনও বাধ্যবাধকতা থেকে নয়। নিজের ইচ্ছেয়।’’ বস্তুত, বেঙ্কাইয়াও আজ বলেছেন, ‘‘মতাদর্শগত ভাবে আমি ছাত্রাবস্থা থেকেই কমিউনিজমের বিরুদ্ধে। তাই পশ্চিমবঙ্গে সৌগত রায় বা প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সির মতো নেতারা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়তেন বলে তাঁদের শ্রদ্ধা করতাম।’’ কিন্তু একই সঙ্গে মেনে নিয়েছেন, কমিউনিস্ট নেতা রাজীবের বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য ইয়েচুরিকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি রাজীবকে ফিরিয়ে আনার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনিও।
এই সম্মিলিত আবেদনের মুখে ইয়েচুরি বলেন, কমিউনিস্টদের সাধারণত ‘নৈরাজ্যবাদী’, ‘স্লোগান তুলে হল্লা করা’, ‘উন্নয়নের বিরোধী’ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু রাজীব গণতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেনে। এখন সংগঠনে তাঁকে বড় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ইয়েচুরি জানান, সিপিএম কিছু শৃঙ্খলা মেনে চলে। তবু সকলে যে ভাবে অনুরোধ করছেন, তার পর রাজীবকে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করা হবে।