বছরের প্রথম দিনেই সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়ত জওয়ানদের উপদেশ দিয়েছিলেন, ভারতীয় সেনার মজ্জায় ‘অরাজনৈতিক চরিত্র’-র মূল্যবোধ ঢুকে রয়েছে। তা রক্ষা করতে হবে।
আজ সেনাপ্রধান নিজেই ‘রাজনৈতিক’ মন্তব্য করে বিতর্কে জড়ালেন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের সমস্যা তুলে তাঁর মন্তব্য, এখানকার ‘জনসংখ্যার চরিত্র’ বদলানো যাবে না। অসমে বিজেপির থেকেও বদরুদ্দিন আজমলের পার্টি এআইডিইউএফ দ্রুত বাড়ছে বলেও তিনি মনে করিয়েছেন।
অসমের সীমান্তবর্তী যে জেলাগুলিতে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ বেশি বলে অভিযোগ, সেখানেই এআইডিইউএফ-এর আধিপত্য। তাদের দিকে বিরোধীরা, বিশেষ করে বিজেপি অনুপ্রবেশে মদত দেওয়ার অভিযোগ তোলে। আজ সেনাপ্রধানের মুখে সেই সুরই শোনা গিয়েছে বলে অভিযোগ। রাওয়ত বলেছেন, ‘‘জনসঙ্ঘের আমলে সংসদে মাত্র দু’টি আসন জয় থেকে শুরু করে (বিজেপি) আজ কোথায় পৌঁছেছে। এআইডিইউএফ অসমে তার থেকেও দ্রুত গতিতে বাড়ছে। অসম কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’’
জওহরলাল নেহরুর আমল থেকেই সেনাবাহিনী রাজনৈতিক বিষয়ে মাথা গলায় না। সেনা বরাবর নির্বাচিত সরকারের অধীনেই কাজ করে। যার জন্য পাকিস্তান-বাংলাদেশ বা প্রতিবেশী রাষ্ট্রে সেনা অভ্যুত্থান ঘটলেও ভারতে তা কখনওই ঘটেনি। তাই রাওয়তের মন্তব্যে প্রশ্ন উঠেছে, মোদী জমানায় কি সেনার রাজনীতিকরণ হচ্ছে?
মোদী ক্ষমতায় এসে প্রাক্তন সেনাপ্রধান ভি কে সিংহকে মন্ত্রী করেছিলেন। সরকার-বিজেপি সেনাবাহিনীর ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করেছে। দু’জন শীর্ষ অফিসারকে টপকে রাওয়তকে সেনাপ্রধান করা হয়েছিল। সেই সময়েও সেনার রাজনীতিকরণের অভিযোগ উঠেছিল। আজ রাওয়তের মন্তব্যের পরে ফের সেই প্রশ্ন উঠেছে। আজমল বলেন, ‘‘এমন রাজনৈতিক মন্তব্য বিস্ময়কর। কোন দল বিজেপির থেকে বেশি ছড়াচ্ছে, তা নিয়ে সেনাপ্রধানের চিন্তা থাকবে কেন?’’ তাঁর মন্তব্য, ‘‘প্রয়োজনে রাওয়তের দফতরে গিয়ে জবাব চাইব। আমরা ষড়যন্ত্রকারী হলে রাজনাথ সিংহ কেন ‘ভাই’ বলে পাশে বসিয়ে চা খাওয়ান?’’ কংগ্রেসের অভিযোগ, সেনাপ্রধানকে দিয়ে মোদী সরকারই বলাচ্ছে। গুলাম নবি আজাদ বলেন, ‘‘এটা নীরব কেলেঙ্কারি থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা।’’
প্রবীণ রাজনীতিকরা বলছেন, বিপদটা আরও গভীরে। গত চার দশক ধরে মন্ত্রিসভার বিভিন্ন শীর্ষ পদে থাকা এক প্রবীণ রাজনীতিবিদ বলেন, ‘‘নেহরু রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বে লক্ষণরেখা টেনেছিলেন। এত দিন তা বজায়ও ছিল। কিন্তু মোদীর আমলে ভি কে সিংহকে মন্ত্রী করা হয়। ফলে সেনাকর্তাদের উচ্চাশা তৈরি হচ্ছে। গণতন্ত্রে এটা বিপজ্জনক।’’
সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাহিনীতে ধর্ম, জাতপাত, রাজনীতির ভেদাভেদ করা হয় না। যে দলই ক্ষমতায় আসুক, সেনা তার প্রতি অনুগত থাকে। স্বাধীনতার সময় ব্রিটিশদের অধীনে থাকা সেনা ভারত সরকারের অনুগত থাকবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। নেহরু তা নিয়ে ব্রিটিশ সেনার কম্যান্ডার-ইন-চিফ ফিল্ড মার্শাল স্যর ক্লড অফলেককে চিঠি লেখেন। জবাবে অফলেক লেখেন, ‘‘সেনা ভাল করে জানে, তাদের কাজ সরকারের নীতি কার্যকর করা, সে ক্ষমতায় ব্রিটিশ থাকুক বা ভারতীয়রা। জওয়ানদের কোনও রাজনৈতিক মত থাকলেও তা কর্তব্যে প্রভাব ফেলবে না। তিন বাহিনীর সব স্তরেই এ কথা বোঝানো হয়।’’