বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সর্বদল বৈঠকে ওমর আবদুল্লা এবং পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি। শনিবার শ্রীনগরে।
আকাশ-ভাঙা বৃষ্টি থেমে গিয়েছে দিন তিনেক হল। খুব ধীরে হলেও আজ থেকে নামতে শুরু করেছে বন্যার জল। আর কয়েক দিন পর থেকে হয়তো ছন্দেও ফিরতে শুরু করবে জম্মু-কাশ্মীরের স্বাভাবিক জনজীবন। কিন্তু গোলাপি কম্বলে মোড়া একরত্তিকে নিয়ে এখন ভারী চিন্তায় সেনা হাসপাতালের চিকিৎসকেরা।
দিন কয়েক আগে শ্রীনগরের জলমগ্ন জি বি পন্থ হাসপাতাল থেকে ফুটফুটে ওই সদ্যোজাতকে উদ্ধার করেছিলেন সেনাবাহিনীর জওয়ানরা। দিন কয়েক আগেই ভূমিষ্ঠ হয়েছে সে। তার সঙ্গে উদ্ধার করা হয়েছিল আরও ৩০০টি শিশুকে। তার পর থেকে সেনা হাসপাতালেই ঠাঁই হয়েছে সকলের। কিন্তু সে দিনের পর থেকে খোঁজ মিলছে না ওই সদ্যোজাতের পরিজনের। বাকি জনা পঞ্চাশেক শিশু গুরুতর অসুস্থ হলেও তাদের সকলেরই পাশে রয়েছেন পরিজনেরা। কিন্তু কোনও খবর নেই ওই সদ্যোজাতর পরিবারের।
সেনা সূত্রে জানানো হয়েছে, জি বি পন্থ হাসপাতালের জল বাড়ার খবর পেয়ে উদ্ধারকাজে যান জওয়ানরা। সেনার নিয়ম অনুযায়ী, প্রথমে শিশু, তার পর মহিলা এবং সব শেষে আটকে পড়া পুরুষ রোগীদের উদ্ধার করে আনা হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ওই শিশুটিকে নিজের সন্তান বলে দাবি করতে আসেননি কেউ। সেনার চিকিৎসকদের একটি দল দেখভাল করছে ওই সদ্যোজাতর। তার শরীরও এখন ভালই। কিন্তু নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে তার কোনও দিন পুনর্মিলন হবে কি না, সেটাই ভাবাচ্ছে সকলকে। সেনাবাহিনীর এক চিকিৎসক, ব্রিগেডিয়ার এন এস লাম্বা বলেছেন, “যত দিন সম্ভব ও আমাদের সঙ্গেই থাকবে।” কিন্তু তার পর? সেনার এক জওয়ান জানিয়েছেন, যখন উদ্ধারকাজ চলছিল, তখনই হয়তো তার বাবা-মা মারা যেতে পারেন। কিন্তু সে বিষয়ে কেউই নিশ্চিত নন। তবে সেনা এটা ভাল করেই জানে, সারা জীবন ওই শিশুটিকে তারা নিজেদের কাছে রেখে দিতে পারবে না। এখন তাদের একটাই প্রার্থনা। যত দ্রুত সম্ভব, বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যাক ওই একরত্তির।
এর মধ্যেই আজ প্রশাসন জানিয়েছে, বিভিন্ন জলমগ্ন এলাকা থেকে নামতে শুরু করেছে জলস্তর। তবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা আজই জানিয়েছেন, উত্তর কাশ্মীরে কিছু নদীর জল এখনও বিপদ সীমার উপর দিয়ে বইছে। যদিও সেই সঙ্গেই তাঁর আশ্বাস, “আশা করি রাজ্যের অন্য অংশের মতো উত্তরের অবস্থা ততটাও বিপজ্জনক হবে না।” জল নামার সঙ্গে সঙ্গে জলবাহিত রোগের প্রকোপও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আগেভাগেই সতর্ক থাকতে চাইছে প্রশাসন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক মুখপাত্র আজই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই জল পরিস্রুত করার ১৩ টন ট্যাবলেট শ্রীনগর পৌঁছেছে। নয়াদিল্লি থেকে আনা হয়েছে জল নামানোর পাম্পও। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বিভিন্ন রাজ্যের সরকারও। বন্যা-কবলিত এলাকায় ১০ হাজার সৌর বাতি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছত্তীসগঢ় সরকার।
বন্যার মার।
রাজ্যের সামগ্রিক বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে আজই ডাকা হয়েছিল একটি সর্বদল বৈঠক। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার সঙ্গে সেই বৈঠকে হাজির ছিলেন পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি, কংগ্রেস নেতা সইফুদ্দিন সোজ এবং বিজেপি নেতা যুগল কিশোরের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বৈঠকে দলমত নির্বিশেষে সিদ্ধান্ত হয়, বন্যা দুর্গতদের পুনর্বাসনের জন্য রাজ্য ও রাজ্যের বাইরে প্রতিটি সংগঠন ও সংস্থার কাছে সাহায্যে আবেদন জানানো হবে। দলগুলির আর্জি, “যে যতটুকু পারেন, তা দিয়েই সাহায্য করুন।” এই বৈঠকেই রাজ্য প্রশাসনের পাশে দাঁড়িয়েছেন ওমর। বলেছেন, “দুর্গতদের পাশে প্রশাসনের দেখা না-পাওয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। প্রশাসনের পক্ষে যতটা সম্ভব ততটাই করা হয়েছে।”
এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আজ দেখা করেছে রাজ্যের এক প্রতিনিধি দল। অর্থমন্ত্রী আবদুল রহিমের নেতৃত্বাধীন ওই দল প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপিও পেশ করেছে। তাঁদের আর্জি, “অবিলম্বে জম্মু-কাশ্মীরের বন্যাকে জাতীয় বিপর্যয় বলে ঘোষণা করুক কেন্দ্র।”
মোকাবিলায় নামল গুগল
জম্মু এবং কাশ্মীরে আটকে পড়া মানুষদের খোঁজ দিতে এ বার এগিয়ে এল গুগল। বন্যা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে সম্প্রতি ‘পার্সন ফাইন্ডার’ নামে একটি টুল নিজেদের হোম পেজে প্রকাশ করেছে গুগল। এর মাধ্যমে বিশ্বের যে কোনও জায়গা থেকে বন্যায় আটকে পড়া এবং নিখোঁজদের খোঁজ পাওয়া যাবে। ‘পার্সন ফাইন্ডার’-এ গিয়ে নিখোঁজদের নাম টাইপ করলেই তাঁদের অবস্থান জানা যাবে। বোঝা যাবে সেনা এখনও তাঁদের উদ্ধার করতে পেরেছে কি না। আর ‘পার্সন ফাইন্ডার’ খোঁজ না দিতে পারলে গুগলে টাইপ করেই নিখোঁজ তালিকায় ওই ব্যক্তির নাম নথিভুক্ত করা যাবে। ভারত সরকারের সহযোগিতায় তাদের তথ্যভাণ্ডার (ডেটাবেস) ব্যবহার করেই এই টুলটি চালানো হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে হাইতিতে ভূমিকম্পের সময়ে এই টুলটি তৈরি করেছিল গুগল। তবে ভারতের কোনও ঘটনায় এই প্রথম ‘পার্সন ফাইন্ডার’কে কাজে লাগাল গুগল। এই টুলের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য সরকারি দফতর, বিপর্যয় মোকাবিলা দল, সংবাদ মাধ্যমের কাছেও পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। কম্পিউটার বা মোবাইল থেকে এই টুল ব্যবহার করা যাবে। হিন্দি এবং ইংরেজিতে এই টুল ব্যবহার করা যাবে।
জল দিয়ে সাহায্য
বন্যা-বিধ্বস্ত জম্মু-কাশ্মীরের জন্য সাহায্যের হাত বাড়াল পশ্চিমবঙ্গ। সেখানে দু’লক্ষ পাউচ পানীয় জল পাঠাচ্ছে রাজ্য সরকার। শনিবার নবান্নে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমায় জম্মু-কাশ্মীরে জলের পাউচ পাঠাতে বলেছেন। সোমবার তা পাঠানো হবে। এ রাজ্যের কোনও পর্যটক কাশ্মীরে আটকে রয়েছেন কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
ছবি: পিটিআই