সুপ্রিম কোর্টের দিকে তাকিয়ে অসমের বঙ্গভাষীরা

জাতীয় নাগরিক পঞ্জি সংশোধন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দিকে তাকিয়ে অসমের বঙ্গভাষীরা। আগামী মঙ্গল ও বুধবার এ নিয়ে শুনানি হবে। অসমিয়া সংগঠনগুলি ১৯৫১ সালকে ভিত্তি করার দাবিতে লড়ছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শিলচর শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৫ ০৩:০৭
Share:

জাতীয় নাগরিক পঞ্জি সংশোধন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দিকে তাকিয়ে অসমের বঙ্গভাষীরা। আগামী মঙ্গল ও বুধবার এ নিয়ে শুনানি হবে। অসমিয়া সংগঠনগুলি ১৯৫১ সালকে ভিত্তি করার দাবিতে লড়ছে। জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের জন্য মা-বাবা দু’জনকেই ভারতীয় বলে প্রমাণের দাবিও রয়েছে তাঁদের।

Advertisement

অন্য পিটিশনগুলির অধিকাংশের দাবি— এনআরসি ফর্ম জমার মেয়াদ বাড়াতে হবে। ২০১৪ সালের ভোটার তালিকাকে ভিত্তি করে এনআরসি প্রণয়নের জন্যও অনেকে সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করেছেন। অসমে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী ভিন রাজ্যের নাগরিকদের নাম এনআরসি-তে তোলার দাবিও উঠেছে। রাজ্য সরকারের তরফে এ সব নিয়ে অতিরিক্ত হলফনামা পেশ করা হয়েছে। সে সব জুড়ে দু’দিন শুনানি চালাবে সর্বোচ্চ আদালত।

শেষ পর্যন্ত এনআরসি ফর্ম জমার মেয়াদ না বাড়লে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তা ভেবে অনেকে দুশ্চিন্তায়। কাছাড় জেলার এনআরসি সুপারভাইজার রাজীব ঝা জানিয়েছেন, এ দিন পর্যন্ত মাত্র ১৪ শতাংশ বাসিন্দা ফর্ম জমা করেছেন। সেই হিসেবে আগামী ১০ দিনে ৮৫ শতাংশ ফর্ম সংগ্রহ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট তাঁর পুরনো নির্দেশে অনঢ় থাকলে বৃহস্পতিবার থেকে একই সঙ্গে সবাই সেবাকেন্দ্রের দিকে ছুটবেন। কে কার আগে জমা করতে পারেন, তা নিয়ে শুরু হবে লড়াই। বচসা থেকে হাতাহাতির আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

Advertisement

বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গৌতমপ্রসাদ দত্ত সোজাসুজি জানিয়ে দেন, ‘‘আমরাও তা ভেবে বিভ্রান্ত, শঙ্কিত। তারিখ না বাড়ালে লক্ষ লক্ষ লোক ফর্ম জমা দিতে পারবেন না। তাতে রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা যাবে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘তার সমস্ত দায় বর্তাবে কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের উপর। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না।’’ গৌতমবাবুর বক্তব্য, রাষ্ট্রযন্ত্রের একপক্ষীয় আচরণ শিকার অসমের বঙ্গভাষীরা। রাজনৈতিক নেতারা বারবার হতাশাজনক ভূমিকা পালন করছে।

এসইউসিআই নেতা অজয় রায় বলেন, ‘‘শুধু তারিখ বাড়ালে সমস্যা মিটবে না। ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে যাঁরা এ দেশে এসেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া না হলে লক্ষাধিক লোক বিপন্ন হবেন।’’ তাঁর বক্তব্য, নেহরু-লিয়াকত এবং ইন্দিরা-মুজিব আন্তর্জাতিক চুক্তিতে ওই সব ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু সেটিকে আইনে পরিণত করতে চাননি কেউ। কংগ্রেস-বিজেপি শুধু রাজনীতি করে চলেছে। উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদীদের নিয়ে এরা নীরবতা পালন করে চলেছে। তাঁদের অভিযোগ, বিশ্বাস করেই এনআরসি নিয়ে সঙ্কটে পড়তে চলেছেন তাঁরা। ১৯৭১ সালের পর এ দেশে আসা বাঙালি উদ্বাস্তুদেরও নাগরিকত্বের আশ্বাস দিচ্ছে গেরুয়া পার্টির নেতারা। অন্য দিকে, মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ, সাংসদ সুস্মিতা দেবরা জানিয়েছেন, ২০১৪ সালের ভোটার তালিকা মেনেই এনআরসি প্রণয়ন করতে চান তাঁরা। সাধারণ মানুষ সে কথা শুনে ৪৫ বছর আগের কাগজপত্র সংগ্রহে সময় ব্যয় করতে চাননি।

হাইলাকান্দি জেলা কংগ্রেস সভাপতি অশোক দত্তগুপ্তের দাবি, ২০১৪ সালের ভোটার তালিকা মেনে এনআরসি সংশোধনের দাবি থেকে তাঁরা সরছেন না। সে জন্য রাজ্য সরকার আদালতে যুক্তি দেখাবে। তাঁর আশা, সুপ্রিম কোর্ট তা মেনে নেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা না হলে? অশোকবাবুর জবাব, ‘‘তা হলে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।’’ এ নিয়ে আর বিশ্লেষণে যেতে চাননি জেলা কংগ্রেস সভাপতি।

বিজেপি কী বলছে? ২০১৪ সালের দাবি মানলেও বিপাকে পড়বেন, না মানলেও সঙ্কট— এটা মেনে নেন শিলচরের বিজেপি বিধায়ক দিলীপকুমার পাল। তাঁর বক্তব্য, অনুপ্রবেশ ইস্যুতে অসমিয়া সংগঠনগুলির সঙ্গে বিজেপিও সরব হয়েছে। বিদেশি বিতাড়নের জন্য দফায় দফায় তাঁরা আন্দোলন করেছেন। সঙ্গে দাবিও জুড়েছেন, ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে এ দেশে আসা সকলকে নাগরিকত্ব দিতে হবে। ২০১৪ সালের ভোটার তালিকার দাবি মেনে নিলে তাঁদের সেই দাবি টিকবে না। যাঁদের তাড়ানোর জন্য বিজেপির নানা কৌশল, তা আর কাজে আসবে না। অন্য দিকে, ২০১৪ সালের দাবি মানা না হলে সব চেয়ে বেশি বিপন্ন হবেন ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে এ দেশে আসা নাগরিকরা।

যুবমোর্চার কাছাড় জেলা সভাপতি রাজেশ দাস বলেন, ‘‘শিলচর শহরের ৮, ২৭ ও ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে অর্ধেকের বেশি নাগরিক এনআরসি-র নথি সংগ্রহ করতে পারছেন না।’’ দিশাহারা ওই বাসিন্দাদের এখন একটাই আশা— ২০১৪ সালের দাবি সুপ্রিম কোর্ট মেনে নেবে। কিন্তু বিজেপির পক্ষে সে কথা বলা সম্ভব নয়। একে কাজে লাগাতে ময়দানে নেমেছে কংগ্রেস। বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক টেনে নিয়ে ২০১৪ সালের ভোটার তালিকার ভিত্তিতে নাগরিক পঞ্জি সংশোধনের আওয়াজ তুলেছে। কৈবর্ত সমাজ উন্নয়ন পরিষদ আগামী শুক্রবার বরাক বনধ ডেকেছে। দিলীপবাবু অবশ্য আশাবাদী, এই সাময়িক সঙ্কট দ্রুত মিটে যাবে। কেন্দ্র ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে আসা সবাইকে নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার খুব শীঘ্রই তা ঘোষণা করবে। এরই মধ্যে তিনি দফায় দফায় এ নিয়ে সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক রামমাধব, সম্পাদক রামলালের সঙ্গে কথা বলেছেন। সবাই একই কথা বলেছেন। কিন্তু কথার খেলাপ হলে যে ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে অনেক আসনে তার প্রভাব পড়বে, সে কথা স্বীকার করেন শিলচরের বিজেপি বিধায়ক। দিলীপবাবু না মানলেও বাংলাদেশ থেকে আসা লোকেদের ধর্মীয় নির্যাতনের কথা বলে এ দেশের নাগরিকত্ব দিয়ে দিলে অসমিয়ারা হাসিমুখে তা মেনে নেবেন না। ফলে বিষয়টি নিয়ে বিজেপির অবস্থা ‘শাঁখের করাতের’ মতো।

বিজেপি বিপাকে বলেই যে কংগ্রেসের খুব লাভ হচ্ছে, তা-ও ঠিক নয়। কারণ সমস্যাগুলি কংগ্রেস আমলেই তৈরি। অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল রাজীব গাঁধীর আমলে। নাগরিকত্ব নির্ধারণে সংবিধান সংশোধন করে যে অসমের জন্য উপধারা যোগ করা হয়েছে, তা-ও সেই কংগ্রেসেরই আমলে। এনআরসি সংশোধনের জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের কথা বলা হলেও কঠোর যে সব নির্দেশিকার জন্য মানুষকে সঙ্কটে পড়তে হয়েছে, সে গুলি তৈরি করেছে তরুণ গগৈ সরকারের ক্যাবিনেট সাব-কমিটি। এখন গগৈ যে সব কথা বলে বঙ্গভাষীর ভোট কংগ্রেসের অনুকূলে এককাট্টা করতে চাইছেন, সে সব কথা নির্দেশিকা তৈরির সময় ভাবলে অনিশ্চয়তায় ভুগতে হতো না। রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, বিপন্ন মানুষ এই সময়ে মুখ না খুললেও বিষয়গুলি তাঁরা অনুধাবন করতে পারছেন না ভাবলে ভুল হবে।

এনআরসি ইস্যুতে কারও রাজনৈতিক ফায়দা হলে সেই দলটি হল এআইইউডিএফ। সংখ্যালঘুদের স্বার্থের কথা বলে এই দলটি গঠিত হওয়ায় বিজেপি-কংগ্রেসের প্রতি ক্ষোভের ফসল এরাই ঘরে তোলে। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৪ সালের ভোটার তালিকা মেনে নিলে তাঁদের ভালই হবে। সবাই নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। না দিলেও লোকসান নেই। সংখ্যালঘু বিপন্ন মানুষগুলি তাঁদের পিছনে থেকে নিজেদের বাঁচাতে চাইবেন। একই ভাবে বিজেপি সরকার ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে আসাদের নাগরিকত্ব দিলে সংখ্যালঘুরা বেশি করে সংগঠিত হতে চাইবেন। দু’ভাবেই লাভ এআইইউডিএফ-এর।

ফলে এনআরসি বিষয়ে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন নতুন সমীকরণ নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। তা অনেক রাজনৈতিক নেতার হিসেব উল্টে দিতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও তাই এখন সুপ্রিম কোর্টের শুনানির দিকে তাকিয়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন