জন্মভিটেয় বাঘা যতীনের নামেই কলেজের শপথ

বিশিষ্ট জনেরা বলছেন— বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আদতে ব্রিটিশ অধীনতার বিরুদ্ধে বাঙালির বিদ্রোহেরই উত্তরাধিকার। প্রশ্ন হল, সেই জন্যই কি বিপ্লবীদের ঐতিহ্যকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য সদা তৎপর জামাতে ইসলামির মতো শক্তি— বাংলাদেশে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা যাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি?

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

কুষ্টিয়া শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০২:৫৮
Share:

বাঘা যতীনের জন্মভিটের একাংশ। — নিজস্ব চিত্র।

বিশিষ্ট জনেরা বলছেন— বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আদতে ব্রিটিশ অধীনতার বিরুদ্ধে বাঙালির বিদ্রোহেরই উত্তরাধিকার। প্রশ্ন হল, সেই জন্যই কি বিপ্লবীদের ঐতিহ্যকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য সদা তৎপর জামাতে ইসলামির মতো শক্তি— বাংলাদেশে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা যাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি?

Advertisement

ওড়িশার বালেশ্বরের চষাখণ্ডে বুড়িবালাম নদীর তীরে ১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন বাঘা যতীন (যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়)। ১৮৭৯ সালে কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। দেশ ভাগের পর কয়া গ্রামের মুখোপাধ্যায় পরিবারে যাবতীয় সম্পত্তি জবরদখল করে বাংলাদেশের একটি স্বার্থাণ্বেষী চক্র। ১৯৯৩ সালে স্থানীয় বিএনপি এমপি মেহের রুমি বাঘা যতীনের বাস্তুভিটায় তাঁর বাবা মাসুদ রুমির নামে একটি কলেজ চালু করেন। নাগরিক সমাজের অভিযোগ— রাজাকার মাসুদ রুমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এক জন রাজাকারের নামে বাঘা যতীনের বাস্তুভিটায় তৈরি কলেজের নামকরণে ক্ষুব্ধ হলেও মুখ খুলতে সাহস পাননি স্থানীয় বাসিন্দারা। শেষে কয়া গ্রামের বাসিন্দা বাঘা যতীনের জীবনীকার রফিকুল হাসানের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয় ২০০১-০২ সাল নাগাদ।

রফিকুল সাহেবের বলেন,‘‘কত কঠিন সময় যে পেরিয়ে এসেছি! বাঘা যতীনের জন্মভিটেতে শহিদ দিবসটুকুও পালন করতে পারতাম না।’’ সেই কঠিন সময়েরই বিবরণ দিচ্ছিলেন কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী মহিদুজ্জামান মহব্বত। জামাতের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে নেমে ছাত্র শিবিরের হাতে তিনি ছুরিকাহত হয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও ক্রমে প্রাণে বেঁচেছি। কিন্তু লড়াই ছাড়িনি।’’ সম্প্রতি কয়া গ্রামে ঢাকঢোল পিটিয়ে বাঘা যতীনের মৃত্যুশতবার্ষিকী পালন করা হল। তারই অঙ্গ হিসেবে গ্রামের প্রবেশ পথ এবং বাস্তুভিটা জবরদখল করে তৈরি হওয়া কলেজটির নামকরণ বাঘা যতীনের নামে করার শপথ নিলেন মানুষ। মহিদুজ্জামান মহব্বত বলছিলেন— ‘‘বছর দশেক আগেও এটা ভাবা যেত না।’’ অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন কলকাতা থেকে আমন্ত্রিত বাঘা যতীনের নাতি ইন্দুজ্যোতি মুখোপাধ্যায়। কুষ্টিয়ার জেলাশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন এবং পুলিশ সুপার প্রলয় শিসিম জানালেন, মানুষের ইচ্ছা যাতে বাস্তবে রূপায়ণ হয়— তাঁরা নিশ্চয়ই দেখবেন।

Advertisement

বাঘা যতীনের মৃত্যুশতবার্ষিকী পালনের জন্য এ বার ভারত ও বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের একটি অংশ হাত মিলিয়ে তৈরি করেছেন উদযাপন কমিটি। কলকাতার ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ এবং ঢাকার একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির যৌথ উদ্যোগে গত এক বছর ধরে নানা জায়গায় এই অনুষ্ঠান হয়েছে। ২ সেপ্টেম্বর দুই দেশের প্রতিনিধিরা কয়া গ্রামে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, সেখানেই বাঘা যতীনের বাস্তুভিটে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির হাত থেকে মুক্ত করার শপথ নেওয়া হল।

অনুষ্ঠানে উদযাপন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেন, ‘‘এক বছর আগেই কলেজের গেট থেকে মাসুদ রাজাকারের নাম খুলে ফেলে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। এ বার বাঘা যতীনের নামে সেই কলেজ করার প্রক্রিয়া শুরু হল। ভুলে গেলে চলবে না, বাঘা যতীনদের লড়াই থেকে প্রেরণা নিয়েই স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।’’ কমিটির আহ্বায়ক শাহরিয়ার কবীরের যুক্তি, ‘‘১৯৭১ এর স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি ফের মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে। তাই বাঘা যতীনের মতো শহিদের লড়াই থেকে প্রেরণা নিয়েই বাংলাদেশের প্রগতিশীল অংশকে যুদ্ধে নামতে হবে।’’

বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের লড়াইয়ে যোগ দিয়েছেন প্রতিবেশী ভারতেরও বহু মানুষ। কলকাতার আইএসসিএসের কর্তা অরিন্দম মুখোপাধ্যায় জানান, আগামী ৮ সেপ্টেম্বর বালেশ্বরের বুড়িবালামের তীরে একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদেরও আনা হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘বাঘা যতীন যে দুই বাংলার কাছেই সমান গুরুত্বপূর্ণ— সেই বার্তা দিতেই এই উদ্যোগ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন