বিপর্যস্ত জীবনরেখা। — নিজস্ব চিত্র।
কেউ কথা রাখেনি। একটা বছর কেটে গেল, কেউ কথা রাখে না।
জামালউদ্দিন লস্কর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা পড়েননি। কিন্তু সুনীলের সঙ্গে তাঁর উপলব্ধির কোনও ফারাক নেই। সুনীলকে কথা দিয়েও কথা রাখেনি বোষ্টুমি, নাদের আলি, বরুণা। আর জামালদের কথা দিয়েও কথা রাখেননি কাটলিচড়ার বিডিও সাহেব। সুনীলের আক্ষেপ: বোষ্টুমির গানের অন্তরাটুকু শুনতে না পাওয়া, পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমরের খেলা দেখতে না পাওয়া, লাঠি লজেন্স না পাওয়া এবং সত্যিকারের ভালবাসা না পাওয়া। আর জামালদের আক্ষেপ শুধুমাত্র একটি রাস্তার জন্য। রাস্তাটি নিছক রাস্তা নয়, এটি হাইলাকান্দি জেলার কাটলিচড়ার সাহাবাদ এলাকার একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জীবন-রেখা।
২০১৩ সালের প্রবল বর্ষণে সাহাবাদের গাঞ্জাখাউরি ফেরি ঘাটের রাস্তাটিতে ধ্বস নেমে তার অনেকটাই চলে যায় নদীগর্ভে। এলাকার টুকেরগ্রাম, রংপুর ৪র্থ, সোনাছড়া বাগান, সোনাছড়া বস্তি, লামার, ধলাই ইত্যাদি ডজন খানেক গ্রামের মানুষজনের সদরে যাওয়ার এটাই ছিল একমাত্র পথ। আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে একমাত্র যোগাযোগ। ফলে গত দু’বছর ধরে চরম দুরবস্থার মধ্যে রয়েছেন তাঁরা। অনেক কষ্টে, ঘুরপথে এলাকার পড়ুয়া থেকে অফিস যাত্রী—সকলকেই যাতায়াত করতে হয়। গ্রামের অসুস্থ মানুষজনকে হাসপাতালে নেওয়ার দরকার হলে সমস্যায় পড়েন তাঁরা। আর প্রসূতি মা’দের নিয়ে সমস্যা আরও জটিল।
দশ-বারোটা গ্রামের মানুষ প্রশাসনিক কর্তা থেকে রাজনৈতিক কর্তা, কোনও দরজায় আঘাত করতেই বাকি রাখেননি জামালউদ্দিন লস্কর, মহম্মদ আলি মজুমদাররা। তাঁদের কথায়, ‘‘বিডিও থেকে আরম্ভ করে পঞ্চায়েত প্রতিনিধি, এমনকী আমাদের বিধায়ক গৌতম রায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও কোনও লাভ হয়নি।’’ শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্র মেনেই প্রতিবাদের পথ বেছে নেন তাঁরা। গত বছর লোকসভা ভোটের সময় ভোট বয়কটের সিদ্ধান্ত নেন এলাকার মানুষ। খবর পেয়ে তত্পর হয়ে ওঠেন হাইলাকান্দির তত্কালীন জেলাশাসক সমশের সিংহ। নিজের ‘সার্ভিস বুক’-এ যাতে কোনও দাগ না পড়ে তার জন্য তড়িঘড়ি তিনি সরকারি কর্তাদের ওই এলাকায় পাঠান। বিডিও গিয়ে জানান, ‘‘জেলাশাসক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ভোট মিটে গেলেই রাস্তা ঠিক করা হবে। ভাঙা সেতুটিও নতুন করে গড়া হবে। আপনারা ভোট বয়কট করবেন না।’’ জেলাশাসক, বিডিও-র অনুরোধ রাখেন গ্রামের মানুষ।
লোকসভা ভোট মিটে গিয়েছে। বিধানসভার ভোট এসে গিয়েছে। পদোন্নতি হয়ে জেলাশাসকও চলে গিয়েছেন অন্যত্র। কিন্তু সেই রাস্তা, যেমনকার তেমনই। ক’দিন আগেও গ্রামের মানুষ হাইলাকান্দির নতুন জেলাশাসক, জেলাপরিষদের সিইও, বিডিও—সবার সঙ্গে দেখা করে রাস্তা মেরামতির অনুরোধ করেন। জেলা পরিষদের সিইও এইচ এ লস্কর রাস্তাটি সংস্কারের নির্দেশও দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্দেশই সার। কাজের কাজ কিছু হয়নি। গ্রামের মানুষ ফের বিডিও–র কাছে গেলে তিনি নানান অজুহাত দেখাচ্ছেন বলে ভুক্তভোগীদের দাবি।
গ্রামবাসীদের অভিযোগ সম্পর্কে বিডিও কে ইউ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি পুরনো কথারই পুনরাবৃত্তি করেন। বলেন, ‘‘রাস্তাটি সম্পর্কে আমি অবগত আছি। শীঘ্রই এর সংস্কার করা হবে।’’