দিল্লির পর বিহার, মুখ থুবড়ে পড়ল ‘অমিত’-কৌশল

হাওয়া খারাপ। আগেই বুঝেছিলেন। তাই গোড়া থেকেই বলে আসছিলেন, বিহারের ভোট নরেন্দ্র মোদী সরকারের জনমত নয়। ভোট শেষেও এড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রশ্ন। বলেছিলেন, ৮ তারিখ যা বলার বলব। আজ ফল প্রকাশের পর স্বঘোষিত ঘরবন্দি অমিত শাহ!

Advertisement

দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৫ ১৭:৫০
Share:

হাওয়া খারাপ। আগেই বুঝেছিলেন।

Advertisement

তাই গোড়া থেকেই বলে আসছিলেন, বিহারের ভোট নরেন্দ্র মোদী সরকারের জনমত নয়। ভোট শেষেও এড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রশ্ন। বলেছিলেন, ৮ তারিখ যা বলার বলব। আজ ফল প্রকাশের পর স্বঘোষিত ঘরবন্দি অমিত শাহ!

কিন্তু হাওয়া খারাপ বুঝে সকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আর সংগঠন নেতা রামলালের সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণীর বাড়ি। দলের প্রবীণ নেতাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে। মাথা ঝুঁকিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। টেলিভিশনের পর্দায় তখনও কিন্তু দেখাচ্ছে, জিতছে বিজেপি-ই। মনে একটু আশা থাকলেও জানতেন বদলে যেতে পারে ছবিটা। তাই আগেভাগে আডবাণীর মতো এক জন বিক্ষুব্ধ নেতাকে সঙ্গে রাখতে চাইলেন। পাছে হারের ছবিটা স্পষ্ট হতেই না বেঁকে বসেন আডবাণী। বেসুরো গেয়ে সুষমা স্বরাজ, রাজনাথ সিংহ, নিতিন গডকড়ীর মতো নেতাদের না ফের উস্কে দেন বিদ্রোহে।

Advertisement

দিল্লির পর বিহার। একের পর এক ভরাডুবির পরেও নিজের গদি হয়তো খোয়াচ্ছেন না অমিত শাহ। কিন্তু আর যা-ই হোক, সব নির্বাচনে জেতার ধারাবাহিকতা নিয়ে তিনি যে বড়াই করতেন এত দিন ধরে, সেটি ধাক্কা খেল। টলমল হল তাঁর নৈতিক কর্তৃত্বও। দিল্লি হারের পর নিজের ওয়েবসাইটে অমিত শাহ লিখেছিলেন, তিনি সে সময়ে তেমন নজর দিতে পারেননি। দলের সদস্যতা অভিযান নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু এ বারে সেই অজুহাত অমিত শাহ স্বয়ং দিতে পারবেন না।

অরুণ জেটলি, রাজনাথ সিংহ, সুষমা স্বরাজ, নিতিন গডকড়ীদের মতো শীর্ষ নেতাদের দূরে রেখে গোটা নির্বাচন পরিচালনার ভার নিজের হাতেই তুলে নিয়েছিলেন তিনি। বিহারে রীতিমতো ঘাঁটি গেড়ে বসেছিলেন। সংগঠনের যাবতীয় কৌশল থেকে নরেন্দ্র মোদীকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করা— সবই হয়েছে তাঁর তত্ত্বাবধানে। মোদীর উন্নয়নের ব্র্যান্ড থেকে মেরুকরণের স্লোগান— সবই তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত। গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সেখানে এই মেরুকরণের রাজনীতিতে সওয়ার হয়েই বাজিমাত করেছিলেন তিনি। নরেন্দ্র মোদীর কাছে লোকসভার ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’-এর শিরোপা পেয়ে দেশের শাসক দলের সভাপতির পদটি হাসিল করেছিলেন। কিন্তু তার পর এই একই গতে বাঁধা কৌশল দিল্লি ও বিহারে প্রয়োগ করতে গিয়েই মুখ থুবড়ে পড়লেন বার বার।

এখানেই প্রশ্ন, এ বারে অমিত শাহ পরের বছর পশ্চিমবঙ্গ, অসম, কেরল নির্বাচনে কী করবেন? সেখানেও কি একই ভাবে হিন্দুত্বের লাইন নেবেন?

বিহার নির্বাচনে দলের কৌশলে হতাশ ও ক্ষুব্ধ এক বিজেপি নেতা বললেন, ‘‘অমিত শাহ যদি এত বড়ই রণনীতির কারিগর হন, তা হলে তাঁর বোঝা উচিত, একই সমীকরণ সর্বত্র চলে না। মোদীকে দিয়ে উন্নয়ন, আর নিজে হিন্দুত্ব— এই প্যাকেজ খাটে না সবসময়। তা-ও আবার পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গে মেরুকরণ করার চেষ্টা হলে সেখানকার হিন্দুরাও সেটি ভাল চোখে নেবেন না। বড়জোর যেটি করতে পারেন, সেটি হল নরেন্দ্র মোদী সরকার যদি সত্যিই উন্নয়ন করে হাতেকলমে কিছু দেখিয়ে দিতে পারেন, তা হলে মানুষ বিশ্বাস করতে পারে। কারণ, সেই প্রত্যাশা নিয়েই মানুষ ভোট দিয়েছিলেন তাঁকে। আর বিহার হারের পর আত্মবিশ্বাস যখন তলানিতে ঠেকেছে, তখন কোন শক্তিতে পরের ভোট জেতার উৎসাহ পাবে?’’

অমিত শাহের ঘনিষ্ঠ নেতা ও পশ্চিমবঙ্গের পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় অবশ্য গোটা বিতর্ক থেকে মোদী-শাহ জুটিকে বাঁচানোর জন্য একটি যুক্তিও খাড়া করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘যে কোনও নির্বাচনে জেতার জন্য তিনটি বিষয় প্রয়োজন। নেতৃত্ব, রণনীতি ও তার রূপায়ণ। আমাদের নেতৃত্ব সমর্থ। রণনীতিও ঠিক ছিল। কিন্তু এর রূপায়ণ করে কর্মীরা ভোটকেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেননি।’’ অর্থাৎ দায় দলের নিচুতলার কর্মীদের। ঠিক যে যুক্তিটি দেখানো হয়েছিল দিল্লি হারের পর। দলের বিক্ষুব্ধ নেতারা কিন্তু তলে তলে খুশি মোদী-শাহের কর্তৃত্ব খর্ব হওয়ায়। তাঁদের মতে, শীর্ষনেতাদের বাদ দিয়ে অমিত শাহ অনন্ত কুমার, ধর্মেন্দ্র প্রধান, ভূপেন্দ্র যাদবের মতো নেতাদের ভরসায় ভোট করিয়েছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতাও কম। আজ বিজেপি জিতলে দুপুরেই অমিত শাহ সামনে এসে ঘটা করে সাংবাদিক সম্মেলন করতেন। মোদী-হাওয়া যে এখনও অব্যাহত, তা নিয়ে ফলাও প্রচার করতেন। কিন্তু হারের পর এখন কর্মীদের ঘাড়ে দায় চাপানো শুরু হয়েছে।

বিজেপি-রই এক নেতার প্রশ্ন, ‘‘লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো নেতাদের এত দিন ব্রাত্য করে রেখে আজ তাঁর জন্মদিনে তো একটি ‘হার’ উপহার দিলেন! এখন হেরে যাওয়ার পর কেন তার দায় নেবেন না নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ?’’ দিল্লি হারের পরেও এ ভাবে দলের মধ্যে বিক্ষুব্ধ স্বর দানা পেকেছিল। এ বারেও বাধতে শুরু করেছে। কিন্তু নৈতিক কর্তৃত্ব খাটো হলেও ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে মোদী-শাহ জুটি। কারণ একটাই। মোদীর নামেই আজ ক্ষমতায় বিজেপি। বিহারেও যত আসন পাক না কেন বিজেপি, সেটিও মোদীর নামেই। মুখ্যমন্ত্রীর কোনও মুখ ছিল না। আর দলের রাশ ধরে রেখেছেন অমিত শাহ। আর বিক্ষুব্ধ নেতারাও সে ভাবে সংগঠিত হতে পারেনি।

এ বারের পরাজয়ের পর সেই জল কতটা গড়ায়, সেটাই দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন