ত্রিশঙ্কুর আশঙ্কা, মায়াকে নিয়ে পুরনো কটু মন্তব্য মুছছে বিজেপি

ঢাকঢোল-পুষ্পবৃষ্টি। চারদিকে হই-হই রব। বিজেপির মালাটি তখন সবে গলায় পরেছেন কিরণ বেদী। পাশে জ্বলজ্বল করছে অমিত শাহের মুখ। বিজেপি সভাপতি ভাবছেন, এই কিরণ-তাসেই দুরমুশ হবে অরবিন্দ কেজরীবালের ঝড়।

Advertisement

দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও অগ্নি রায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৪:৪৮
Share:

আজমগড়ের জনসভায় মায়াবতী। সোমবার। ছবি: পিটিআই

ঢাকঢোল-পুষ্পবৃষ্টি। চারদিকে হই-হই রব। বিজেপির মালাটি তখন সবে গলায় পরেছেন কিরণ বেদী। পাশে জ্বলজ্বল করছে অমিত শাহের মুখ। বিজেপি সভাপতি ভাবছেন, এই কিরণ-তাসেই দুরমুশ হবে অরবিন্দ কেজরীবালের ঝড়।

Advertisement

কিরণ বেদীর বিজেপিতে যোগ দেওয়ার সেই অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায়, ঘুরপাক খেতে শুরু করে তাঁর পুরনো টুইট। যেখানে এই প্রাক্তন আইপিএস অফিসার জবাবদিহি করতে বলেছেন নরেন্দ্র মোদীকে, ‘আদালত নিষ্কৃতি দিলেও গুজরাত হত্যাকাণ্ডের জবাব দিন নমো।’

ওমর আবদুল্লা সে সময় টিপ্পনি কেটেছিলেন, দোহাই বিখ্যাত ব্যক্তিরা কোনও দলে যোগ দেওয়ার আগে পুরনো টুইট, ফেসবুক স্ট্যটাসগুলি মুছে ফেলুন। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েই হোক বা ভবিষ্যতের আশঙ্কা, উত্তরপ্রদেশে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে এখন ঠিক এই কাজটিই সন্তর্পণে করছে বিজেপি। ওমরের সেই খোঁচাকেই কার্যত সুপরামর্শ বলে মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব। দলের তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগকে তাঁরা নির্দেশ দিয়েছেন, মায়াবতী সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় করা যাবতীয় কটাক্ষ, শ্লেষ এখনই মুছে ফেলতে হবে।

Advertisement

আরও পড়ুন: শহিদ-কন্যাকে খোঁচা সহবাগের, বিতর্ক আরও তীব্র

কেন? জবাবও স্পষ্ট। বিজেপির আশঙ্কা, একার জোরে লখনউয়ের তখতে বসার স্বপ্ন অধরা থেকে যেতে পারে। ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হলে হাত ধরতে হতে পারে মায়াবতীর। সেটাই একমাত্র বিকল্প বিজেপির কাছে। তখন যাতে মায়াবতীকে নিয়ে বিজেপির পুরনো কটাক্ষ বা আক্রমণের প্রসঙ্গ তুলে সরকারে যাওয়ার আশায় জল ঢেলে না দেয় বিরোধীরা।

আসলে নির্বাচন যত শেষের দিকে এগোচ্ছে, ততই বিজেপির অন্দরে একটা আশঙ্কা তীব্র হচ্ছে। তা হল, গোবলয়ের সব থেকে বড় রাজ্যে ‘অপেক্ষাকৃত’ ভাল ফল করলেও দু’‌শোর গণ্ডি হয়তো পেরোনো সম্ভব হবে না। রাজনাথ সিংহ ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে কবুল করেছেন, রাহুল গাঁধী আর অখিলেশ যাদবের জোট হওয়ায় ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি। শেষ বাজারে হাওয়া তুলতে খোদ প্রধানমন্ত্রীর সভা আরও বাড়ানো হয়েছে। নোট বাতিল, সেনা অভিযান, বহু-ব্যবহৃত উন্নয়ন অস্ত্রের ধার কমছে বুঝে বিজেপি ফের তুলে নিয়েছে মেরুকরণের হাতিয়ার। যদিও সাহসি মুখ করে বিজেপি নেতারা এখনও বলে যাচ্ছেন, সরকার হবে তাঁদেরই।

শেষ পর্যন্ত যদি তা না হয়! তার প্রস্তুতিও চুপিসারে শুরু করে দিয়েছেন বিজেপি নেতারা। আগেই মায়াবতীর আস্থাভাজন নেতা সতীশ মিশ্রর সঙ্গে গোপন বৈঠক সেরে ফেলেছেন। ছকে ফেলেছেন ভোটের পরে মায়াবতীর হাত ধরার একটি প্রাথমিক নকশাও। সংখ্যা কম পড়লে বিজেপিকে তাঁরা যে পাশে পাবেন, সে ব্যাপারে বহেনজি পাকা কথা বিজেপি নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ভোটের আগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিষয়টি চাউড় হয়ে গেলে তা বিজেপি-বসপা উভয়েরই বিপদ। ফলে বাইরে-বাইরে ও জনসভায় চলছে লোক দেখানো পারস্পরিক আক্রমণ। অখিলেশ যাদব, রাহুল গাঁধীর জোটকে দ্বিতীয় স্থানে রেখে বিজেপিকেই রাজনৈতিক আক্রমণের মূল নিশানা করছেন মায়াবতী।

যেমন আজমগড়ে আজ বসপা নেত্রীর কপ্টার নামার পরেই গর্জন উঠল, ‘সর্ব সমাজ কে সম্মান মে / বহনজি ময়দান পে।’ মঞ্চে তাঁর বক্তব্যের সিংহভাহ জুড়ে রইল, বিজেপি এলে এই ‘সর্ব সমাজ’-এর কল্যাণ’ কী ভাবে বিঘ্নিত হবে, সেই কথা।

বসপা নেত্রীর বক্তব্য, ‘‘বিজেপি যদি এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তা হলে তা হলে সঙ্ঘ পরিবারের ঢালাও কর্মসূচি চালিয়ে যাবে। সংখ্যালঘু, দলিত, অনগ্রসরদের জন্য যা যা সুবিধা ও সংরক্ষণ দেওয়া হয়েছে তা এক কথায় শেষ করে দেবে। গোরক্ষা এবং দেশভক্তির নাম করে অত্যাচার শুরু করবে।’’

সপা-কংগ্রেস জোটের নেতাদের কাছে এটা স্পষ্ট, মায়াবতী আসলে মরিয়া চেষ্টা করছেন, যাতে বিজেপির সঙ্গে আঁতাঁত নিয়ে তাঁর ভোটারদের মধ্যে কোনও সংশয় তৈরি না হয়। ভোট পর্যন্ত এটা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায়ও নেই মায়াবতীর। কারণ, চিরাচরিত দলিত ভোটব্যাঙ্কের সঙ্গে এ বার তিনি মুসলিম ভোটকে যোগ করতে চাইছেন। উত্তরপ্রদেশের সর্বশেষ জনগণনায় দেখা গিয়েছে জনসংখ্যার ২০.৭% দলিত ও ১৮.৫% মুসলিম। এই দুই সম্প্রদায়ের ভোট যোগ করলে কুর্সি দখলের দৌড়ে তাঁর এগিয়ে যাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যাবে।

নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের নাম করে মায়াবতী আজ বলেছেন, ‘‘মোদী-অমিত শাহ থেকে বিজেপি-র ছোট ছোট নেতারাও বলে চলেছেন, তারা এই রাজ্যে সরকার গঠন করলে দুধ এবং দইয়ের বন্যা বওয়াবেন।’’ মুসলিম ভোটারদের প্রতি তাঁর বার্তা, ‘‘সন্ত্রাসবাদের নাম করে আসলে মুসলমানদের সন্দেহের চোখে দেখা শুরু হয়ে গিয়েছে। এদের প্রতিরোধ করতে সপা-কংগ্রেসের পাশে থেকে কোনও লাভ নেই। নিজেদের স্বার্থেই ভোট দিন বহুজন সমাজ পার্টিকে।’’

বিজেপি নেতাদের অঙ্কটা এই রকম, ভোটের পরে দরকারে এই সব রাজনৈতিক আক্রমণ সামলে নেওয়া যাবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কথা বলে। কিন্তু, ব্যক্তিগত কুৎসা বা আক্রমণের হদিস থেকে গেলে, সেটাই কাঁটা হয়ে উঠতে পারে মিলিজুলি সরকার গড়ার পথে।

বিজেপি তথ্য-প্রযুক্তি দফতরে এখন তাই জোর ব্যস্ততা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন