তুমুল হইচই লোকসভায়। তৃণমূলের সঙ্গে সংঘাতে জড়ালেন সিপিএম, কংগ্রেস ও বিজেপির সাংসদরা। ছবি: পিটিআই।
গোপন ক্যামেরায় তোলা ঘুষ-বিতর্কের ঝড় আছড়ে পড়ল রাজধানীতে। যার জেরে দিনভর সংসদে কোণঠাসা হয়ে রইল বঙ্গের শাসক দল! ক্ষোভের আঁচ মিলল দলের অন্দরেও!
নারদ-কাণ্ডের ধাক্কায় এ দিন লোকসভা থেকে রাজ্যসভা সর্বত্রই তীব্র অস্বস্তির মুখে পাল্টা আক্রমণের রাস্তায় হেঁটেছে তৃণমূল। যা করতে গিয়ে আগামিকাল রাজ্যসভায় ‘স্টিং অপারেশন’ নিয়ে আলোচনা চেয়ে আগ বাড়িয়ে নোটিস দিলেও সেখানে কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপির সম্মিলিত আক্রমণ কতটা সামাল দেওয়া যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে দলেই। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এ দিন সংসদীয় দলের বৈঠকে যে ভাবে একাধিক সাংসদ নারদ প্রসঙ্গে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন, তাতে তৃণমূলের রক্তচাপ ঊর্ধ্বমুখী!
এখানেই শেষ নয়! তৃণমূলের চাপ বাড়িয়েছে বিজেপিও। লোকসভায় সংসদীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু বুঝিয়ে দেন, নারদ-কাণ্ডের তদন্তে সায় রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের।
বিধানসভা ভোটের ঠিক মুখে ভিডিও ঘুষ-কাণ্ডে বিব্রত তৃণমূলের নেতারা অবশ্য প্রকাশ্যে সাহসী মুখই দেখাচ্ছেন। কিন্তু ভয় কাটছে কই! এই অবস্থায় দলনেত্রীর নির্দেশে গত কাল থেকে মুখে তালা তৃণমূল সাংসদদের। সংসদের অধিবেশন-পর্বে উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে সাংসদরা যাতে নতুন কোনও অস্বস্তি না বাড়ান, তা নিশ্চিত করতে আজ সকালে দিল্লি যান ডেরেক ও’ব্রায়েন। দুপুরে সংসদে তৃণমূলের দলীয় দফতরে উপস্থিত রাজ্যসভা এবং লোকসভার সাংসদদের নিয়ে বৈঠকে বসেন তিনি। সূত্রের খবর, সেখানেই দীনেশ ত্রিবেদী, সুগত বসুর মতো সাংসদরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁদের মোদ্দা বক্তব্য, এমন ঘটনায় দলের ভাবমূর্তি ধাক্কা খেয়েছে। ওই নেতাদের আশঙ্কা, এতে বিধানসভা ভোটে দলের ফল খারাপ হতে পারে। সংসদেও অস্বস্তিতে পড়তে হবে।
দীনেশ-সুগতদের আশঙ্কা যে সত্যি, তা আজ লোকসভায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। বিজেপির সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া, কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী তৃণমূলকে নিশানা করতে ছাড়েননি। কিন্তু পরিস্থিতি সবচেয়ে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সিপিএমের মহম্মদ সেলিম বলতে উঠলে। ভোটের মুখে বিপাকে পড়া তৃণমূলকে ঠেসে ধরার সুযোগ ছাড়তে নারাজ সেলিম এ দিন শুরু থেকেই সুর চড়ান। পাশের বেঞ্চে বসা সৌগত রায়, সুলতান আহমেদের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘‘সাংসদরা নোটের তাড়া নিচ্ছেন! লজ্জা করছে এমন সাংসদদের সঙ্গে আমায় বসতে হচ্ছে!’’ রে রে করে ওঠেন সৌগত, সুলতান। সেলিমকে বলতে শোনা যায়, ‘‘আপনারা চোর! কেন এই সব বলছেন!’’ পাল্টা সৌগত বলেন, ‘‘তুম চোর হ্যায়!’’ স্পিকারের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি তখনকার মতো শান্ত হয়।
নারদ-কাণ্ডে সংসদ হস্তক্ষেপ করুক, তা প্রথম থেকেই চাইছিল না তৃণমূল। বিরোধীদের লাগাতার আক্রমণের মুখে সৌগতবাবু উঠে স্পিকারকে বলেন, একটি ওয়েব পোর্টালে দেখানো তথ্যের ভিত্তিতে জিরো আওয়ারে সেই প্রসঙ্গ তোলার অনুমতি কী করে দেওয়া হল? সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপিকে নিশানা করে তিনি বলেন, ‘‘স্টিং অপারেশনটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র।’’ তার পরেই উঠে বেঙ্কাইয়া বলেন, ‘‘কংগ্রেস, সিপিএম এবং বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মতো গুরুতর অভিযোগ এনেছেন সৌগত রায়।’’ এ সময় সৌগতবাবু ফের চিৎকার শুরু করতেই তাঁকে থামিয়ে বেঙ্কাইয়া বলেন, ‘‘আপনি যথেষ্ট অভিজ্ঞ সাংসদ। কেন বিড়ম্বনা তৈরি করছেন!’’ সৌগতকে থামিয়ে স্পিকারকে তিনি বলেন, ‘‘কোনও তদন্ত না করে এ ভাবে গোটাটাকে রাজনৈতিক চক্রান্ত বলা হলে মানুষ সত্যটা জানতে পারবেন না। তাই তদন্ত প্রয়োজন। দু’ভাবে তা হতে পারে। সরকার নিজে থেকে তদন্ত করতে পারে। বা সংসদের অভিভাবক হিসেবে দেখুন বিষয়টি নীতি কমিটির কাছে পাঠানো যায় কিনা। যদি অন্য কোনও ভাবে সত্য জানার চেষ্টা হয়, তাতেও আপত্তি নেই।’’
রাজ্যসভাতেও সিপিএমের তপন সেন, কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্যরা নারদ-বিতর্কে সরব হন। তাঁদের অভিযোগ, সাংসদদের টাকা নিতে দেখা যাচ্ছে। এটা গোটা সংসদের অপমান। এ বিষয়ে সংসদীয় কমিটি গঠন এবং আলোচনার দাবি তোলেন তাঁরা। সিপিএমের তরফে আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে আলোচনার চেয়ে মুলতুবি প্রস্তাবের নোটিস জমা পড়েছে। পাল্টা আলোচনা চেয়ে নোটিস দিয়েছে তৃণমূলও। যার বিষয়বস্তু হল, ভোটের আগে বিদেশ থেকে আসা টাকায় ষড়যন্ত্র! যা জানার পরে এক বাম নেতা বলেন, ‘‘বিদেশ থেকে টাকা এল, সেটা খেলেন তৃণমূলের নেতারা! তার পরে তাঁরাই বলছেন ষড়যন্ত্র!’’
নারদ-কাণ্ডে নির্বাচন কমিশনের তরফে বলা হয়েছে, বিরোধীরা অভিযোগ করেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এখনই তারা এ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেবে না।