উল্লাস! সোমবার হিমাচল প্রদেশে জয়ের পর বিজেপি সমর্থকরা। ছবি: এপি।
দু’জনের কেউই এ বার আর মুখ্যমন্ত্রী হতে পারলেন না! বীরভদ্র সিংহ এবং প্রেমকুমার ধুমল।
প্রথম জন জিতলেও তাঁর দল কংগ্রেস হেরে গিয়েছে। ঝুলিতে গত বারের থেকে গোটা পনেরো আসন কম।
দ্বিতীয় জনের দল বিজেপি ম্যাজিক সংখ্যা ৩৫-এর থেকে অনেকগুলি আসনই বেশি পেয়েছে। কিন্তু, তিনি নিজেই তো পরাজিত!
দু’জনেই দু’দলের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ছিলেন! অথচ, দু’জনের কারওরই এ বার আর হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া হল না।
তা হলে দেবভূমির মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন? জল্পনায় ভেসে বেড়াচ্ছে একাধিক নাম। তার মধ্যে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেপি নাড্ডা। গত ৯ নভেম্বর হিমাচলে নির্বাচন ছিল। তার দিন দশেক আগে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে প্রেমকুমার ধুমলের নাম ঘোষণা করেছিলেন বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, ‘মোদী ম্যাজিক’ কাজ করছে না বলেই ধুমলের নামে ভোটে যেতে বাধ্য হয় বিজেপি। তার আগে যদিও নাড্ডার নামই শোনা যাচ্ছিল বিজেপি-র অন্দরমহলে। কিন্তু, রাজপুত ভোট কংগ্রেসের ঝুলিতে যাওয়া ঠেকাতেই নাকি ধুমলের নামে ছাড়পত্র দেন মোদী-অমিত জুটি। বিজেপি-র অন্দরের খবর, ধুমল ছাড়া এ যাত্রায় দলকে হিমাচল বৈতরণী পার করাতে পারতেন না কেউই। কিন্তু, ধুমলের হারের পরেই ফের নাড্ডার নাম ভেসে উঠছে।
যদিও বিজেপি-র একটা অংশের দাবি, ২০১৯-এর আগে হিমাচলে দলের কোনও ‘অগ্নিপরীক্ষা’ নেই। তাই নাড্ডার মতো নেতাকে সেখানে মুখ্যমন্ত্রী করে পাঠানোর কোনও প্রশ্নই নেই। সে ক্ষেত্রে অবশ্য উঠে আসছে জয়রাম ঠাকুরের নাম। মান্ডি জেলায় বিজেপি এ বার বড়সড় সাফল্য পেয়েছে। তাই, জয়রাম ঠাকুর সেই জেলার মানুষ হিসাবে দায়িত্ব পেতেই পারেন। এমনিতেই সোমবার ফল প্রকাশের মাঝ পর্যায়ে দিল্লিতে পৌঁছে গিয়েছেন জয়রাম। তাঁকে নাকি ডেকে পাঠানো হয়েছে। তবে, পিছিয়ে নেই সঙ্ঘ পরিবারও। তাদের ঘনিষ্ঠ অজয় জামওয়ালের নামও কিন্তু ভেসে আসছে হিমাচলের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে। অন্য দিকে, হিমাচলের অবস্থা উত্তরপ্রদেশের মতোও হতে পারে। যোগী আদিত্যনাথের মতো নতুন কোনও মুখকে মোদী-শাহ জুটি বসিয়ে দিতে পারেন হিমাচলের মসনদে।
কিন্তু, দলের এমন সাফল্য আর নিজের ভরাডুবি নিয়ে কী বলছেন প্রেমকুমার ধুমল? এ দিন হামিরপুর থেকে টেলিফোনে তিনি বললেন, ‘‘দলের বড়সড় জয় এসেছে। ব্যক্তিগত পরাজয়ের থেকে দলের এই জয় অনেক বড় বিষয়। যাঁরা জিতেছেন তাঁদের প্রত্যেককে অভিনন্দন জানাচ্ছি। পরাজিতদের জন্য সমব্যথী।’’ মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে কার কথা ভাবছেন? বিষণ্ণ ধুমল বললেন, ‘‘দল যে সিদ্ধান্ত নেবে আমি তাতে সম্মতি জানাব।’’ তবে কি জয়রাম? তিনি কি তাতে সম্মতি জানাবেন? ধুমলের ছোট্ট জবাব, ‘‘অপেক্ষা করুন। দেখতে পাবেন।’’
ধুমলের এই হার নিয়ে বিজেপি-র অন্দরেই একটা অংশের ক্ষোভ রয়েছে। তাঁদের মতে, ধুমল জিতুন এটা দলের একাংশই চায়নি। কারণ, নরেন্দ্র মোদীকে সামনাসামনি ‘বন্ধু’ হিসাবে পরিচয় দিলেও ধুমল আসলে দলের অভ্যন্তরে পুরনোপন্থী হিসাবেও পরিচিত। আর মোদী-অমিতের জমানায় পুরনোদের ঠাঁই নেই। পাশাপাশি, ধুমলের জনপ্রিয়তা হিমাচলে এতটাই যা দিল্লির নেতাদের না-পসন্দ হওয়ারই কথা। আর সে কারণেই নাকি ধুমলকে সুজানপুরের মতো কঠিন কেন্দ্রের টিকিট দেওয়া হয়েছিল। আর গোটাটার পিছনেই নাকি ছিল রাজপুত ভোটের অঙ্ক। যদিও অন্য অংশটি এই দাবি উড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের মত, ধুমলকে যদি এতটাই অপছন্দ করবে মোদী-অমিত জুটি, তা হলে তাঁর নামে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীর সিলমোহর দেওয়া হত না। দলীয় অন্তর্ঘাত নিয়ে এ দিন ধুমলকে প্রশ্ন করা হলেও তিনি তা এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘‘এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না।’’
জয়ের পর বিজেপি সমর্থকদের উল্লাস শিমলা শহরে। ছবি: পিটিআই।
এমনিতে সেই নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই হিমাচলে ক্ষমতার পালাটা পাঁচ বছরের জন্য নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় বিজেপি এবং কংগ্রেস। শেষের দিকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবেও বীরভদ্র এবং প্রেমকুমারের মধ্যে পাঁচ বছর অন্তর ক্ষমতা-বদল হত। ১৯৮৩ সালে প্রথম বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন বীরভদ্র। ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি সেই পদেই ছিলেন। এর পরের দু’বছর ক্ষমতা যায় বিজেপি-র হাতে। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শান্তাকুমার। তার পর ১৯৯৩ সালে ফের বীরভদ্র। ১৯৯৮-তে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। সে বার মুখ্যমন্ত্রী হলেন প্রেমকুমার ধুমল। তার পর প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এক বার বীরভদ্র, পরের পাঁচে ধুমল— এ ভাবেই এগিয়েছে হিমাচল বিধানসভা নির্বাচন। সেই ‘ধারা’ অনুযায়ী এ বার ক্ষমতায় বিজেপি-রই আসার কথা ছিল। কিন্তু, দল ক্ষমতায় এলেও জেতা হল না ধুমলের। সুজানপুর থেকে মাত্র তিন হাজার ভোটে কংগ্রেসের রাজেন্দ্র রানার কাছে হেরে গিয়েছেন বিজেপি-র মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী।
আরও পড়ুন
অস্বস্তির কাঁটা নিয়েই গুজরাতে ক্ষমতায় ফিরল বিজেপি
তবে, এ দিন সোলান জেলার আরকি কেন্দ্র থেকে জিতে গিয়েছেন কংগ্রেসের বীরভদ্র সিংহ। সিমলা গ্রামীণ কেন্দ্র থেকে জিতেছেন তাঁর ছেলে বিক্রমাদিত্য সিংহ। এ দিন বিকেলে বীরভদ্র বলেন, ‘‘বিজেপির এই জয় মেনে নিচ্ছি। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দলের পরাজয়ের দায় গোটাটাই আমার। আজকের মতো বিক্রমাদিত্য আগামীতেও জিতবে আশা রাখি।’’ হারের কারণ নিয়ে তিনি কিছু বলতে চাননি। তবে এআইসিসি-র সদস্য তথা রাজ্য কংগ্রেসের প্রাক্তন মুখপাত্র কুলদীপ রাঠৌর স্পষ্ট ভাবেই জানিয়ে দিলেন, ‘‘এ বার সরকার বিরোধী ভোটই হয়েছে। হয়তো আমাদের সংগঠন তৃণমূল স্তর পর্যন্ত কাজ করতে পারেনি।’’
সোমবার সকাল ৮টায় ভোটগণনা শুরু হয়েছিল। শুরু থেকেই ইঙ্গিত মিলছিল, কংগ্রেসের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তর হতে পারে। সকাল থেকেই বিজেপিকে চালিয়ে খেলতে দেখা যাচ্ছিল বিভিন্ন বিধানসভা কেন্দ্রে। ২০১২-র বিধানসভা নির্বাচনে নিজেদের দখলে থাকা আসনগুলো বড় দ্রুতই কংগ্রেসের হাতছাড়া হতে থাকে। দুপুরের আগেই স্পষ্ট হয়ে যায়, বিজেপিই রাজ্য দখল করছে। বেলা শেষে তাতেই সিলমোহর পড়ল। ৬৮ আসনের হিমাচল বিধানসভায় ৪৪টি-ই বিজেপি নিজেদের দখলে রেখেছে। গত বিধানসভা নির্বাচনের থেকে তারা ১৮টি আসন বেশি পেয়েছে। অন্য দিকে, কংগ্রেস গত বারের জেতা ১৫টি আসন খুইয়ে সর্বসাকুল্যে ২১টি কেন্দ্রে নিজেদের জয় ধরে রাখতে পেরেছে। এর পাশাপাশি ১৯৯৩ সালের পর এই প্রথম সিপিএমের কোনও প্রার্থী বিধানসভা নির্বাচনে এ দিন জিতলেন। দুই নির্দল প্রার্থীও বিধায়ক হিসাবে জয়ী হয়েছেন। তবে, এত বছর পর নিজেদের দলীয় বিধায়কের মুখ বিধানসভায় দেখা যাবে বলে খুশি রাজ্য সিপিএম সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য টিকেন্দর সিংহ পাঁওয়া। এ দিন দিল্লি থেকে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের এক জনই একশো জনের সমান, এটা মনে রাখবেন।’’
আরও পড়ুন
গুজরাত থেকে হিমাচল, কে জিতলেন, কে হারলেন
এ দিন দিল্লিতে বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ সাংবাদিক সম্মেলন করে হিমাচলবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন হিমাচলে? এ প্রশ্নের অবশ্য কোনও জবাব মেলেনি।
গ্রাফিক্স: শৌভিক দেবনাথ