অগ্নিযুগ ফেরাল ব্রাত্যজনের নাটক

শতবর্ষের অধিক নাট্যচর্চার ঐতিহ্যে স্নাত দক্ষিণ অসমের প্রান্তিক শহর শিলচর। এখানকার মানুষ নাটক কতটা ভালবাসেন, ‘ব্রাত্যজন’ আয়োজিত চার দিনের নাট্য উৎসবে তা প্রমাণিত হল। বঙ্গভবন কানায় কানায় ভরে গিয়ে ‘হাউসফুল’ বোর্ড ঝোলাতে হয়েছিল।

Advertisement

দীপক সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৪:২৪
Share:

শতবর্ষের অধিক নাট্যচর্চার ঐতিহ্যে স্নাত দক্ষিণ অসমের প্রান্তিক শহর শিলচর। এখানকার মানুষ নাটক কতটা ভালবাসেন, ‘ব্রাত্যজন’ আয়োজিত চার দিনের নাট্য উৎসবে তা প্রমাণিত হল। বঙ্গভবন কানায় কানায় ভরে গিয়ে ‘হাউসফুল’ বোর্ড ঝোলাতে হয়েছিল। এক-দু’দিন নয়, টানা চার দিন শিলচরের মানুষ নিজেদের সাংস্কৃতিক মনন, সর্বোপরি নাটকের প্রতি যে অনুরাগ দেখালেন তাতে আগামী দিনের জন্য আরও বড় মাপের উৎসব আয়োজনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হল।

Advertisement

২৪ নভেম্বর কাছাড়ের জেলাশাসক এস বিশ্বনাথন নাট্যোৎসবের উদ্বোধন করেন। ব্যবস্থাপনায় ছিল স্থানীয় নাট্যসংস্থা ‘ভাবীকাল’ ও বেসরকারি সামাজিক সংস্থা ‘আশ্বাস’।

প্রথম নাটক পাইকপাড়া ব্রাত্যজনের ‘অদ্য শেষ রজনী’। তাতে সত্তর দশকের কলকাতা নাট্যজগতের সেই সন্ধিক্ষণ উদ্ভাসিত হয়েছে, যখন মূল্যবোধভিত্তিক বিষয় আর সনাতনী আঙ্গিক নিয়ে গ্রুপ থিয়েটার মানুষ টানতে পারছিল না। একই সময়ে পেশাদারি নাটক রমরমিয়ে মিনার্ভা, সারকারিনা, প্রতাপ প্রেক্ষাগৃহে চলছিল। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’, বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটকের ধারাবাহিকতায় নাটক হবে, না কি ‘বিবর’,‘বারবধূ’ হবে— সেই প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছিল বাংলার নাট্যজগত। ‘অদ্য শেষ রজনী’ সেই দ্বন্দ্বই তুলে ধরেছে। অজিতেশ, কেয়া, রুদ্রপ্রসাদ, শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের জীবনে সম্পর্কের টানাপড়েন যাঁরা জানেন, এবং যাঁরা জানেন শ্যুটিং চলাকালীন কেয়া চক্রবর্তীর মৃত্যু হয়েছিল, তাঁরা সহজেই নাটকের ভিতরে ঢুকতে পেরেছিলেন। অন্যদের কাছে নাটকটি বড্ড ভারী ঠেকেছে। অনেকের কাছে মিস শেফালি চরিত্রটি খুব অস্বস্তির ছিল। তাঁরা না পারছিলেন অনাবৃত শরীরের উপস্থিতি সহ্য করতে, না পারছিলেন তাঁর নৃত্য দেখতে। তবে উনবিংশ শতকে পেশাদারি মঞ্চে নটি বিনোদিনীর উপস্থিতিকে অনুমোদন করে গিয়েছেন স্বয়ং ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব। এই নাটকে মঞ্চ এবং আলো সম্পর্কে একটাই শব্দ যথেষ্ট— অভূতপূর্ব। আবহ খুব ভাল। অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রত্যেকে সফল, কোনও খামতি রাখেননি। বিশেষ করে অনির্বাণ ভট্টাচার্য ও অঙ্কিতা মাঝির অভিনয় অত্যন্ত উঁচু শৈলীর।

Advertisement

দ্বিতীয় নাটক নৈহাটি ব্রাত্যজনের পরিবেশিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’। ঋত্বিক ঘটক নির্দেশিত সিনেমার অনুকরণে এই নাটক। নীতার চরিত্রে পৌলমী বসুর অভিনয় দুর্দান্ত। তবু নাটকটি যেহেতু সরাসরি সিনেমার মুখোমুখি হয়েছে এবং সিনেমাটি দেখা, তাই বারবার মনে হয়েছে, পুরো বিষয় এখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তার অবশ্য বহু কারণও রয়েছে। প্রথমত, সিনেমার ব্যাপ্তি অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, সিনেমার নির্দেশকের জীবনদর্শন ও রাজনৈতিক বোধ নাটকের নির্দেশকের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। দেশভাগের ব্যথা ঋত্বিক ঘটকের বুকের পাঁজরকে আজীবন ছিন্নভিন্ন করেছে। হতদরিদ্র সংসারের বাঙালি মেয়ের যে রূপ সিনেমায় ফুটে উঠেছিল নাটকে তা হয়নি। মলিন বস্ত্র ছাড়া নাটকের নীতার চেহারায় দারিদ্রের কোনও ছাপ পাইনি। পুঁজিবাদের চরম সঙ্কট মায়ের নিঃস্বার্থ ভালবাসাকে গ্রাস করে, তার বেদনা সিনেমায় যতটা মূর্ত হয়েছিল নাটকে তার ছিঁটেফোটাও হয়নি। আসলে গানের রিমেকের মতো ভাল হয়েও ভাল হলো না নাটকটি। ‘দাদা আমি বাঁচতে চাই’, সেই আর্তিটা মোটেও ফুটে ওঠেনি।

কালিন্দি ব্রাত্যজনের পরিবেশনায় ‘বোমা’-য় ত্রিমাত্রিক মঞ্চ, আলো-শব্দ, দেবশঙ্কর হালদারের অভিনয় নাটকটিকে যে জায়গায় নিয়ে যেতে পারত, তা হলো না।

যে ভাবে উল্লাসকর, বারীন ঘোষকে উপস্থাপন করা হল, আমাদের মন তা মেনে নিতে পারেনি। বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিতরা রাধাকৃষ্ণের প্রেমে যে দেবত্ব খুঁজে পান, উল্লাসকর-লীলার মধ্যে তেমন দৈব সম্পর্কের ছাপ পাওয়া যায়। তাঁদের শেষ জীবন আমাদের শহরে কেটেছে। জন্মের শহরের উল্লেখ থাকলেও মৃত্যুর শহরের উল্লেখ নাটকে পেলাম না।

এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র কে—অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ না উল্লাসকর? দেখা গেল, তিন জনই বিপ্লবী আন্দোলনকে পিছন থেকে ছুরি মারলেন। অরবিন্দের কথা স্বতন্ত্র, কিন্তু বাকি দু’জনকে নিয়ে আমাদের আবেগ যেখানে টগবগ করছে, সেখানে এত সহজে এই নাটক হজম হওয়ার নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরের সন্দীপ, ‘চার অধ্যায়ের অতীন আর ব্রাত্য বসুর নাটকের এই সব চরিত্রে বাংলার বিপ্লবী যুগের যে ছবি আঁকা হচ্ছে, তাতে কি এই কথা প্রমাণিত হয় না, বাঙালি সত্যি সত্যি আত্মঘাতী! প্রফুল্ল চক্রবর্তীর স্ত্রী কল্পনা বিপ্লবী নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে না। প্রীতিলতা ওয়েদ্দার, মাতঙ্গিনী হাজরারাই বিপ্লবী নারীদের প্রতিনিধি। এখানে একটা মৌলিক প্রশ্ন, নাটককে শুধু বিষয়গত ভাবনা থেকে ভাবব নাকি তার আঙ্গিকের দিক থেকে। ইতিহাসনির্ভর নাটক বলে নির্দেশক বা নাট্যকারের স্বাধীনতা এখানে সীমাবদ্ধ।

এ বার আসা যাক, শেষ তথা চতুর্থ নাটক ‘রুদ্ধসঙ্গীত‘। অন্য তিনটির মতো ‘রুদ্ধসঙ্গীত‘-রও নির্দেশক ব্রাত্য বসু। দেবব্রত বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে মঞ্চস্থ এই নাটকে উঠে এসেছে পঞ্চাশের দশকের গণনাট্য আন্দোলনের স্বপ্ন দেখার আবিলতা ও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণার কথা। দেখলাম রাজনীতি যখন সংস্কৃতির উপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে, তখন শিল্প ও শিল্পীর কী অবস্থা হয়। কী করে রাজনীতির খবরদারি শিল্পীর সৃজনী সত্ত্বাকে ক্ষতবিক্ষত করল। জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্তের সঙ্গে ঋত্বিক ঘটকের দ্বৈরথ অনেকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। তবে আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, গণনাট্যের ভিতরের কোন্দলকেও তুলে ধরা প্রয়োজন। ব্যক্তিত্বময় পুরুষ
দেবব্রত বিশ্বাসের চরিত্রে দেবশঙ্কর হালদারকে মানিয়েছে বেশ। ব্রাত্য বসুর খুব সংক্ষিপ্ত অভিনয়েও মুন্সিয়ানা ধরা পড়ে।

যাই হোক, এই চার দিন আমরা কখনও সত্তর দশক, কখনও অগ্নিযুগে ভ্রমণ করেছি। ব্রাত্য বসু ও দেবশঙ্কর হালদারকে একসঙ্গে শিলচরে দেখব আশা করিনি। ফলে এই উৎসবের সফলতা অনেক স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবে, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন