National News

বাঙালিয়ানার মিশেল, তবু স্বাচ্ছন্দ্য নেই সিআর পার্ক বাজারে

প্রত্যেকটা বাজারেরই কিছু নিজস্ব গল্প থাকে। সে গল্পে যেমন ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের সুফিয়ানা আছে, হিংয়ের কচুরির নৈর্ব্যক্তিক স্বাদ আছে, ল্যাংড়া আমের নস্ট্যালজিয়া আছে, আর এ সব মিলিয়ে এই গল্পে জীবন-বাসনা-রসনা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

Advertisement

রিমি মুৎসুদ্দি

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১৮:২৭
Share:

প্রত্যেকটা বাজারেরই কিছু নিজস্ব গল্প থাকে। সে গল্পে যেমন ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের সুফিয়ানা আছে, হিংয়ের কচুরির নৈর্ব্যক্তিক স্বাদ আছে, ল্যাংড়া আমের নস্ট্যালজিয়া আছে, আর এ সব মিলিয়ে এই গল্পে জীবন-বাসনা-রসনা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

Advertisement

কলকাতা থেকে কেটে এক টুকরো গড়িয়াহাট যেন বসিয়ে দেওয়া হয়েছে সিআর পার্ক বাজারে। যেখানে বঙ্গসন্তান-সহ মৎস্যপ্রিয় দিল্লিবাসীদের নিত্য যাতায়াত। সে দিক থেকে দেখতে গেলে গোটা সিআর পার্ক-ই বাঙালির খুব প্রিয় অঞ্চল। এই বাজারে শুধু সিআর পার্কের অধিবাসীরাই নন, দিল্লির অন্যান্য অঞ্চল থেকেও লোকজন আসেন বাজার করতে। এখানে বাজার করতে আসা ক্রেতারা যেহেতু শহরের প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডকে প্রোমোট করেন, বা বলা ভাল, এই প্রিমিয়াম শহরের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হলেন এই বাজারের ক্রেতারা। সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নেওয়া যায় অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী জিনিসপত্রের দাম এখানে অনেক বেশি। হয়তো বা, রাজধানীর সব থেকে দামী বাজার হল সিআর পার্কের বাজারগুলো। কী বলছেন ক্রেতা ও বিক্রেতারা?

আরও পড়ুন, কুর্সি নয় কারাবাস, শশীর স্বপ্নে জল ঢাললেন দুই বাঙালি

Advertisement

ময়ূরবিহার এক্সটেনশন অঞ্চল থেকে সিআর পার্কে বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে আসার ফাঁকে কবি এবং আইটি কর্মী অর্ক মজুমদার প্রায়ই এক নম্বর বাজারে আসেন মাছ কিনতে। শুধু মাছই নয়, কলকাতার নস্ট্যালজিয়ায় বিভোর কবি আরও অনেকখানি বাঙালিয়ানার আঁচ পেতেই ঢুঁ মারেন এই বাজারে। “মাছবাজারে ঢুকলে একটু কলকাতা কলকাতা মনে হয়। তাই ভাল লাগে, তবে এখানে সমস্যা অনেক। চারিদিকে মাছি ভনভন, অত্যন্ত নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। আমাদের জন্য একটা নির্দিষ্ট গ্যারাজ বা পার্কিংয়ের ব্যবস্থা না থাকার জন্য, গাড়ি পার্কিং নিয়েও যথেষ্ট সমস্যা হয়। গাড়ি চুরি যাওয়ার ঘটনাও প্রায়ই শোনা যায়। সে ক্ষেত্রে নিশ্চিন্তে বাজার করা হয়ে ওঠে না।”

“মাছবাজার থেকে নোংরা জল রাস্তায় ও ফুটপাথে চলে আসার দরুণ এখানে হাঁটা প্রায় অসম্ভব।” অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে গাড়িতে উঠতে উঠতে জানালেন সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায়, সিআর পার্কের বাসিন্দা। জেন-এক্সের প্রতিনিধি বছর বাইশের যুবক স্নেহেল অডি থেকে নেমে কানে ইয়ারফোন গোঁজার আগে বললেন, “বন্ধুরা বেঙ্গলের মিষ্টি দই খেতে চেয়েছে, তাই এখানে আসা। এখানে কোনও সিসিডি (কাফে কফি ডে) বা বারিস্তা ধরনের কোনও ভদ্রস্থ কাফে নেই যে বন্ধুদের এখানে নিয়ে এসে একটু আড্ডা দেব।”

যে বাজারকে ঘিরে বাঙালির এত নস্ট্যালজিয়া, অবাঙালিরাও ভিড় করেন বং-রসনার স্বাদ নিতে, সেই বাজারকে ঘিরেই জমে উঠেছে এত অসন্তোষ! অভিমান ও অসন্তোষ ঝরে পড়ছে বিক্রেতাদের কথায়ও। ১৯৭১-এর নভেম্বরে এই মার্কেটের অ্যালটমেন্ট শুরু হওয়ার সময় থেকে এখনও অবধি এই বাজারের সঙ্গে যুক্ত ও এখানকার এক দোকানের মালিক অনিমেষ চক্রবর্তী বললেন, “এই বাজার নিয়ে আমাদের যে দীর্ঘ লড়াই শুরু হয়েছিল তা এখনও চলছে। এখনও আমরা স্থানাভাবে জমিয়ে দোকান খুলতে পারিনি। শুধু স্থানাভাবই নয়, এখানে আরও অনেক সমস্যা রয়েছে। যার মধ্যে জলের সমস্যা প্রবল। তা ছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর স্বচ্ছ ভারতের আঁচ এখানে এসে পৌঁছয়নি, এখানে কোনও নির্দিষ্ট টয়লেট নেই। সিকিউরিটিরও প্রচন্ড অভাব, আমরা গাড়ি পার্কিংও করতে পারি না, যেহেতু কোনও নির্দিষ্ট পার্কিং নেই।”

নিরাপত্তার অভাব ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই অনুভব করছেন। মধ্যদুপুরে ভরপেট মাছভাত অথবা ছোলে-কুলচা পরবর্তী ঘুমের আমেজ নিয়েও এই বাজারের চোখ জুড়িয়ে আসে না। বরং ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। এই ব্যস্ততম চলন্ত বাজারের দিকে তাকিয়ে কেন জানি না মনে হল, তাজমহলের শাদার শুভ্রতায় যেমন হলদের অভিশাপ লেগে আজ মাড প্যাকের প্রয়োজন হচ্ছে, সে রকমই এক দিন বিশ্ব-ব্র্যান্ডের প্যাকেজিং-এর মোড়কে নতুন কসমেটিক সজ্জিত একেবারে অন্য কেউ এসে এত দিনের পুরনো প্রেম, নস্ট্যালজিয়া সব ধুয়ে মুছে সাফ করে দেবে। ঘন ঘন ব্র্যান্ড বদলানো ক্রেতারা হয়তো খুশিই হবেন। কিন্তু যাঁরা বা যাঁদের পূর্বপুরুষেরা কলকাতা বা বাংলার কোনও দূরতম প্রান্ত থেকে জীবিকার সূত্রে বা ভাগ্যান্বেষণে দিল্লিবাসী হয়েছিলেন এবং বহুযুগ ধরে এই বাজারের সঙ্গে যুক্ত আছেন, এই বাজারের হক আদায়ের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন, তাঁদের অবস্থাটাও কি অত্যন্ত সুখের হবে?

আরও পড়ুন, নিলামে উঠবে জয়ার সম্পত্তিও

“১৯৭১ –এর নভেম্বরে যখন দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ডিডিএ) সি আর পার্ক ১ নং মার্কেটের প্লট অ্যালটমেন্ট করেছিল, আমরা তখন খড়ের ছাপরা দিয়ে প্রথম দোকান শুরু করি। সেই সময় থেকেই আমরা এই বাজারের উন্নতির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এখনও পর্যন্ত সবই অধরা।” জানালেন বহু পুরনো বাংলা বই ও ম্যাগাজিন স্টলের বিক্রেতা শম্ভু পট্টনায়েক। ২০০৫-এ ডিডিএ নিলামের মাধ্যমে রি-অ্যালটমেন্টের আয়োজন করে। সেখানে যাঁদের এলিজিবল ঘোষণা করা হয়েছিল তাঁদের বিনাপয়সায় দোকানের জন্য জায়গা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে অবশ্য সেই জমি ডিডিএ-র কাছ থেকে অনেক বেশি দামেই কিনতে হয়েছিল দোকানীদের। তার আগে ২০০৩-এ অবশ্য এক বার বাজার পুনর্গঠনের জন্য সমস্ত দোকান উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন যাঁরা রাস্তার উপর অস্থায়ী দোকানঘর নির্মাণ করে বিক্রিবাটা চালু রেখেছিলেন, তাঁদের অনেকেই অবশ্য ২০০৫-এর নিলামে দোকানের জন্য জায়গা পাননি।

এই টালমাটাল অবস্থার জন্য শুধু ডিডিএ-ই দায়ী নয়। ১৯৭১-এর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর শরণার্থী নীতিও খানিকটা দায়ী এই পরিস্থিতির জন্য। বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়াতে তিনি দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের কর্মসংস্থান ও বসবাসের সুযোগ করে দেন। সিআর পার্কও তার মধ্যে একটা অঞ্চল। সেই সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যের স্মৃতি নিয়ে আজও এই বাজারের একতলায় ইস্ট-পাকিস্থান দিল্লি-র (ইপিডি) অফিস রয়ে গিয়েছে।

কারণ যা-ই হোক না কেন, বাজারের অসম্পূর্ণতা আজও লক্ষ করার মতো। “এখানে একটাও ওষুধের দোকান নেই, রাতবিরেতে দরকার পড়লে গাড়ি নিয়ে অনেকটা দূরে যেতে হয়। আমি না হয় ড্রাইভ করে ওষুধ নিয়ে আসব গিন্নির জন্য। কিন্তু আমি নিজে অসুস্থ হলে কী করব?” জানালেন সিআর পার্ক আই-ব্লকের বাসিন্দা সৌগত বসু। সিআর পার্কের বহু বাসিন্দাই বৃদ্ধ, যাঁদের সন্তান-সন্ততিরা কর্মোপলক্ষে দিল্লির বাইরে বা বিদেশে থাকেন। বাজারের কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও সেই সব মানুষও আপতকালীন পরিস্থিতিতে এই বাজারের সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন