কিরণদেবী (নাম পরিবর্তিত) প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ও হতাশ। তাঁর গ্রামের গর্ভবতী মহিলাদের জন্য বরাদ্দ রেশন আসছে না। বাল্মীকিনগর গ্রামের এই ‘আশা’র (অ্যাক্রেডিটেড সোশ্যাল হেল্থ অ্যাক্টিভিস্ট) সঙ্গে এ নিয়ে ওখানকার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর খিটিমিটি লেগেই আছে। অথচ ওই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরও বেশি কিছু করার নেই। মাসে মাসে ওই গ্রামের গর্ভবতী মহিলাদের জন্য বরাদ্দ রেশনের চার ভাগের মাত্র এক ভাগ করে পাচ্ছেন। তাও আসছে অনেক দেরিতে। কাকে ছেড়ে কাকে দেবেন। যে পাবে না তার গুস্সা তো হবেই। ‘আশা’র কাজ গ্রামের গর্ভবতী মহিলাদের সনাক্ত করে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পরে প্রসবের জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, তার পরিপূরক খাদ্য পাচ্ছে কি না তা দেখা। নিজের দায়িত্ব পালন করতে না-পারলে তাঁর রাগ হওয়ারই কথা। রাগের আরও একটা কারণ আছে। এ সব কাজের জন্য ‘আশা’রা রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য মিশনের থেকে কাজের ভিত্তিতে অর্থ পেয়ে থাকেন। কিন্তু ২০১৬-র এপ্রিল থেকে নিজের প্রাপ্য টাকা পাচ্ছেন না বাল্মীকিনগরের এই ‘আশা’।
বিহারের পশ্চিম চম্পারণ জেলার নেপাল সীমান্তবর্তী এই গ্রামে কিরণদেবীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল নোট বাতিল ঘোষণার কয়েক দিন পরে। সেখানে গিয়েছিলাম কমন রিভিউ মিশনের সদস্য হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্থাস্থ্য মিশনের কাজকর্ম পরিদর্শনের জন্য।
আরও পড়ুন, দিল্লির এটিএম থেকে বেরিয়ে এল দু’হাজারি ‘ছেলেখেলার’ নোট
আসলে ‘আশা’ ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী দু’জনের সমস্যার মূল একই জায়গায়। গত তিন চার বছর ধরে কেন্দ্রীয় বাজেটে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন এবং আইসিডিসিএস-এর বরাদ্দ যে ভাবে কমানো হয়েছে, তাতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এই দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ। সময় মতো পৌঁছচ্ছে না এ সবের জন্য বরাদ্দ রেশন, জীবনদায়ী ওষুধ, ইত্যাদি। দেওয়া হচ্ছে না বকেয়া টাকা। এমনকী সন্তান প্রসবের জন্য মায়েদের প্রাপ্য টাকাও পৌঁছতে সময় লাগছে ছয় মাসেরও বেশি। ফলে, ভুগছেন এর সঙ্গে যুক্ত তৃণমূল স্তরের কর্মীরা। আর অবশ্যই অসংখ্য প্রান্তিক মানুষ যাঁরা তাঁদের প্রাপ্য সামান্য রেশন বা অল্পবিস্তর প্রসূতি ভাতার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন। তাঁদের কাছে বাজেট কিছু তথ্য বা পরিসংখ্যান নয়, টিকে থাকার লড়াইয়ে রসদ পাওয়ার মাধ্যম।
ভাবলে কষ্ট হয়, বিশ্বে পাঁচটি শিশু মৃত্যুর একটি হয় ভারতে। যে দশটি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে তাদের চার জনই আমাদের দেশের। এখানে অংসখ্য মানুষ মারা যায় এমন সব রোগে যেগুলি সহজেই নিরাময় হয়।
এ সব তথ্য জেনেও আমরা, আমাদের সমাজ, আমাদের সরকার অসম্ভব রকমের উদাসীন জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, সামাজিক সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে। স্বাস্থ্য খাতে সরকারি খরচ আমাদের জাতীয় আয়ের এক শতাংশের সামান্য বেশি— যা কি না বিকাশশীল দেশগুলির গড়ের তিন ভাগের এক ভাগ। যে সব দেশে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ সবচেয়ে কম ভারত তাদের অন্যতম। চিন, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, তাইল্যান্ডের মতো আমাদের প্রতিবেশীদের চেয়ে বেশ খনিকটা কম।
সরকার খরচ না-করলে, দায়িত্ব না নিলেও, প্রিয়জন অসুস্থ হয়ে পড়লে পরিবারকে তো দায়িত্ব নিতেই হয়। জোগাড় করতে হয় চিকিৎসার খরচ। কেউ জমিজমা বিক্রি করতে বাধ্য হন, কেউ আবার বাধ্য হন চড়া সুদে ধার নিতে। যাদের সে সামর্থ্যও নেই তাঁরা হয় চিকিৎসা করাতে পারেন না, কিংবা একান্ত নিরুপায় হয়ে রোগী মরণাপন্ন হলে ভেঙে-পড়া সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দ্বারস্থ হন। ফি-বছর আমাদের দেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ চিকিৎসা করাতে গিয়ে দারিদ্রসীমার নীচে চলে যান।
আরও পড়ুন, পার্কে নীতি পুলিশের খবরদারি ফেসবুকে লাইভ করে দিলেন প্রেমিক যুগল!
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের উন্নয়নশীল দেশগুলির সরকার গত দশ বছর ধরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। বাড়াচ্ছে সরকারি খরচ। অথচ আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার খরচ সমানে কমিয়ে চলেছে। ফলে, ব্যাহত হচ্ছে, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা সচল রাখার ন্যূনতম প্রয়াসটুকুও। এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেট গণমাধ্যমের বেশ প্রশংসা পেয়েছে সামাজিক খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, এটা অর্থমন্ত্রী নিখুঁত হিসেবের ভেল্কিবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথাই ধরা যাক। অর্থমন্ত্রী স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ১০,৬০০ কোটি টাকা বাড়িয়েছেন। ঘোষণা করেছেন বেশ কয়েকটি নতুন প্রকল্প। বাস্তবে, মুদ্রাস্ফীতি বাদ দিলে এই টাকাটা কিন্তু ২০১১-১২ সালের বরাদ্দ থেকেও কম। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি ঢেলে সাজার কথা উনি ঘোষণা করেছেন। অথচ এর জন্য কোনও টাকা বরাদ্দ করা হয়নি এ বারের বাজেটে। গত কয়েক বছর ধরে বাজেটে বরাদ্দ টাকার চেয়েও কম টাকা পেয়ে আসছে স্বাস্থ্য মন্ত্রক। তার জন্য বিস্তর চেঁচামেচি করেছেন স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কিন্তু লাভ তাতে কিছুই হয়নি। এ বারও শিঁকে ছিড়ল না তেমন ভাবে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় খামতির দায় রাজ্য সরকারও এড়াতে পারে না। এ রাজ্যে ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্বাস্থ্যে বাজেট বরাদ্দ অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় বেশি ছিল। কিন্তু গত দুই দশকে এ রাজ্যে ক্রমশ কমেছে স্বাস্থ্য রক্ষায় সরকারি খরচ। আর তা করা হয়েছে রাজস্ব ঘাটতির দোহাই দিয়ে। অথচ রাজ্য সরকার এমন অনেক খরচ বাড়িয়ে চলেছে যেগুলি রাজনৈতিক ভাবে লাভজনক হলেও সামাজিক দিক থেকে জরুরি নয়।
নোট বাতিলের প্রভাবে ধুঁকছে দেশের অর্থনীতি। কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সব শ্রেণির মানুষ। তবে সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের উপর। সম্ভবত, নোটবাতিলের কুপ্রভাব থেকে বাঁচতে আমাদের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী শরণাপন্ন হয়েছেন কুবের দেবতার। তা না করে উনি যদি সামাজিক সুরক্ষার জাল নিবিড় ভাবে বোনা এবং আরও ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে রোজগার, খাদ্য ও পুষ্টি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জোরদার করার কাজে মন দিতেন, তা হলে দেশের বিকাশের নতুন দরজা খুলে যেতে পারত।
এই ক্ষেত্রে অমর্ত্য সেনের ক্যাপাবিলিটি অ্যাপ্রোচ বা সক্ষমতার দৃষ্টিভঙ্গির ধারণাটি প্রাসঙ্গিক। তাঁর মতে, মানবিক সত্ত্বার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও পুষ্টি এবং অবশ্যই রোজগারের চাহিদা মেটাতে রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিহার্য। আর তা আখেরে আর্থিক বিকাশের ভিত্তিকেও পোক্ত করে। এ সব থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে মোদী সরকার যে শুধু ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগানের অকালে সলিল সমাধি ঘটাচ্ছেন তা নয়, আমাদের ভাবী প্রজন্মের প্রতি অবিচারও করছেন।
(লেখক পাবলিক হেল্থ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার রিসার্চ সায়েন্টিস্ট ও অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর)