নিজস্ব চিত্র
মুম্বইয়ের সরকারি হাসপাতালের ইন্ডোরে, আউটডোরে গিজগিজ করা ক্যানসার রোগীর একটা বড় অংশই ভিন রাজ্যের। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের। হাসপাতালের বাইরে হোটেল, গেস্টহাউস, রেলস্টেশন, বিমানবন্দর— সর্বত্র রোগীর ভিড়। চেনা জায়গা থেকে অনেক দূরে ভিন শহরে এসে দিশেহারা অনেকেই। এ ভাবে আর কত দিন? কবে স্বাবলম্বী হবে অন্য রাজ্যগুলি?
রবিবার, মুম্বই টাটা মেমোরিয়াল ক্যানসার হাসপাতালের ৭৫ বছর উদ্যাপন অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জে পি নাড্ডার উপস্থিতিতে বড় হয়ে উঠল এই প্রশ্ন। বড় হয়ে উঠল এই তথ্যও যে, কলকাতা-সহ বিভিন্ন শহরে সম্প্রতি ক্যানসারের আধুনিক চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে উঠলেও সেখানে ‘হি়ডন কস্ট’ বা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসার শুরুতে ঘোষিত আনুমানিক বরাদ্দ ছাড়াও বিস্তর খরচ লুকিয়ে থাকে যা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খান রোগীর পরিবার। ফলে দ্রুত ভরসা হারায় তাঁদের।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, রাতারাতি পরিস্থিতি বদলানো যাবে না। কিন্তু ধাপে ধাপে তাঁরা পদক্ষেপ করছেন| সেগুলি কী?
যেমন, রাজ্য সরকারগুলিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলির ওপরে কঠোর নজরদারি রাখার কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরে রোগ নির্ণয়ের জন্য ‘কমিউনিটি বেসড হেলথ ওয়ার্কার’দের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কোন কোন উপসর্গ ক্যানসারের হতে পারে তা শেখানো হচ্ছে তাঁদের। এরই পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাসপাতালে যাতে মুম্বইয়ের ‘টাটা কালচার’ চালু করা যায়, সেই চেষ্টাও চলছে। তিনি বলেন, ‘‘আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা আমরা করব। কিন্তু সেই সংস্কৃতি গড়তে মুম্বইয়ের এই হাসপাতালের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা চাই। দেশে এমন ১৫টি কেন্দ্র গড়া হবে।’’
এ দিন ‘ভার্চুয়াল টিউমার বোর্ড’-এর উদ্বোধন করেন তিনি। ন্যাশনাল ক্যানসার গ্রিড ও মুম্বই টাটা হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে কাজ করবে এই বোর্ড। দেশের যে কোনও প্রান্তের ক্যানসার হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তাঁদের রোগীদের ব্যাপারে দেশের তাবড় ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ পাবেন। নাড্ডা বলেন, ‘‘সকলকে কেন মুম্বই ছুটতে হবে? মুম্বই যাবে তাঁদের কাছে। চিকিৎসার বিষয়ে ‘এভিডেন্স বেসড গাইডলাইন’ দেওয়া হবে।’’
এ ছাড়াও চালু করা হল একটি নতুন প্রকল্প। যেখানে, নিজের স্মার্ট ফোন থেকেই যে কোনও রোগী বা তাঁর পরিবারের সদস্য সমস্যার কথা আপলোড করতে পারবেন| ন্যাশনাল ক্যানসার গ্রিড ও টাটা মেমোরিয়ালের বিশেষজ্ঞেরা তাঁদের পরামর্শ দেবেন| আপাতত এই তালিকায় রয়েছেন ৬৫০ জন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ। তথ্য আপলোড করার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জবাব পাবেন রোগী|
প্রশ্ন উঠেছিল, যতই ভার্চুয়াল বোর্ড হোক বা স্মার্ট ফোনে তথ্য আদানপ্রদানের ব্যবস্থা হোক, সব রোগী তো সেই আওতায় আসবেন না। তাঁদের কী হবে? প্রত্যন্ত গ্রামের এক রোগী কী পাচ্ছেন, সেটাও তো ভাবনায় আসা দরকার। এ দিন মহারাষ্ট্রের চিকিৎসকদের জন্য একটি ম্যানুয়াল প্রকাশ করা হয়। টাটা মেমোরিয়াল সেন্টারের চিকিৎসক পঙ্কজ চতুর্বেদী জানান, ‘ইউনিফর্ম ট্রিটমেন্ট মডেল’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে ওই ম্যানুয়াল। গ্রামীণ হাসপাতালেও বিলি হবে ওই ম্যানুয়াল।
স্কুল পড়ুয়াদের জন্য ছবি-সহ ক্যানসার সচেতনতার পুস্তিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। সঠিক জীবনচর্যার হদিশ দেওয়া থাকবে ওই পুস্তিকায়। যেহেতু ক্যানসার এখন অনেকটাই ‘লাইফস্টাইল ডিজিজ’, তাই কম বয়স থেকেই সচেতনতা বাড়াতে এই পদক্ষেপ করা হচ্ছে বলে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান|
টাটা মেমোরিয়াল সেন্টারের অধিকর্তা রাজেন্দ্র বাডওয়ে বলেন, ‘‘গোটা দেশের ক্যানসার রোগী এক জায়গায় ভিড় করছেন, এটা গৌরবের বিষয় নয়। ক্যানসার চিকিৎসার বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। এই সম্মেলন থেকে সেই পথে হাঁটার দিশাটা দেখতে চাইছি। এটাও এক অর্থে ‘মুম্বই ডিক্লারেশন’|’’
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের উপস্থিতিতে এ দিনই প্রকাশিত হয় মূল ‘মুম্বই ডিক্লারেশন’| কী আছে এই ঘোষণাপত্রে? রাজেন্দ্র জানান, কেন্দ্রের সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বা়ড়ানো নিয়ে কথা চলছে। রাজ্য সরকার, পুরসভা ও হাসপাতালগুলিকে একত্রিত করে স্বাস্থ্য খাতে আমজনতার খরচ কমানোর চেষ্টা চলবে। অন্তিম পর্যায়ের ক্যানসার রোগীদের উপশম চিকিৎসায় জোর দেওয়া হবে। সর্বোপরি, অনাবশ্যক ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং অস্ত্রোপচারের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।
অমর্ত্য সেন বলেন, ‘‘আমি চাই এটা একটা জাতীয় আন্দোলনের চেহারা নিক। সব রাজ্য এগিয়ে আসুক। রাজনৈতিক সদিচ্ছা কাজ করুক। তা না হলে চিকিৎসা করাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের নরক যন্ত্রণা কমবে না।’’