লক্ষ কোটি দূর অস্ত্, লক্ষ্যের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারছে না নরেন্দ্র মোদীর সরকার! কালো টাকা সাদা করার প্রকল্প ঘোষণা করে সরকার আশা করেছিল, ১ লক্ষ কোটি কালো টাকার ঘোষণা হবে। তাতে বকেয়া কর ও জরিমানা বাবদ সরকারি কোষাগারে অন্তত ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকা আসবে। চার মাসের জানলা বন্ধ হতে আর মাত্র তিন দিন বাকি। অর্থ মন্ত্রক সূত্র বলছে, অঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও পৌঁছনো যাবে কি না সন্দেহ। ১ জুন থেকে জানলা খোলা হলেও প্রথম তিন মাসে তেমন সাড়াই মেলেনি।
শেষ বেলায় অবশ্য কালো টাকা জানানোর পরিমাণ বাড়তে শুরু করেছে। অর্থ মন্ত্রক ঘোষণা করেছে, সময় শেষ হচ্ছে ৩০ সেপ্টেম্বর। এই সময় বাড়ানো হবে না। তবে ওই দিন রাত ১২টা পর্যন্ত আয়কর দফতরের কাউন্টার খোলা থাকবে। অনলাইনেও আবেদন করা যাবে। কেন্দ্রীয় প্রত্যক্ষ কর পর্ষদ এ বিষয়ে আয়কর দফতরের প্রিন্সিপাল চিফ কমিশনারদের নির্দেশ পাঠিয়ে দিয়েছেন।
এখন পর্যন্ত কত কালো টাকার খবর জমা পড়েছে সরকারের কাছে? অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, জানলা বন্ধ হওয়ার পরেই একবারে সব তথ্য জানানো হবে। মন্ত্রকের একটি সূত্রের খবর, অগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত মাত্র ৪ হাজার কোটি কালো টাকার খবর সরকারকে জানানো হয়েছিল। পরিস্থিতি দেখে রণকৌশল বদলানো হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে এ বিষয়ে মুখ খোলেন। বলেন, ‘‘৩০ সেপ্টেম্বরের পর আমি যদি কড়া ব্যবস্থা নিই, তা হলে যেন আমাকে দোষ না দেওয়া হয়।’’ লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোদী। বিদেশে জমা কালো টাকা উদ্ধারে এখনও তেমন এগোতে পারেনি সরকার। দেশে রাখা কালো টাকা উদ্ধারে তাই বিশেষ জোর দিচ্ছেন তিনি।
পাশাপাশি আয়কর দফতরও প্রচার শুরু করে, ৩০ সেপ্টেম্বরের পর থেকেই কঠোর অভিযান শুরু হবে। কারা কারা কর ফাঁকি দিচ্ছে, তার বিশদ তথ্য সরকারের কাছে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আয়কর দফতরের এক উচ্চপদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘গত কয়েক মাস ধরে আয়কর অফিসাররা নানা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য-পরিসংখ্যান ঘেঁটে ফেলেছেন। এখন কিন্তু আমাদের হাতে অনেক বেশি কর ফাঁকির খবর রয়েছে। রয়েছে প্যান কার্ড ছাড়া লেনদেনের তথ্যও। ৩০ সেপ্টেম্বরের পর থেকেই অভিযান শুরু হবে। কাজেই কোনও ঝুঁকি না নেওয়াই ভাল।’’ কার্যত হুমকির সুরে এই প্রচারের পরেই কালো টাকা ঘোষণার পরিমাণ বেড়েছে।
কিন্তু তাতেও কি লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়া যাবে? কংগ্রেস নেতা রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালার বক্তব্য, ‘‘মোদী সরকার শুধু সাধারণ চাকরিজীবী ও পেশাদারদের উপর চাপ তৈরি করছে। কিন্তু ছাড় দেওয়া হচ্ছে সরকার-ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের। এঁদের কর ফাঁকি ধরলেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়ে যেতে পারে।’’
অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তার যুক্তি ১৯৯৭ সালেও কালো টাকা ঘোষণার প্রকল্প চালু হয়েছিল। সে বার প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকার কথা ঘোষণা হয়। কিছুটা তার ভিত্তিতেও আশা করা হয়েছিল, এ বার অন্তত ১ লক্ষ কোটি টাকার খবর মিলবে। ঘোষিত কালো টাকার ৪৫% কর ও জরিমানা বাবদ দিতে হবে। এর পুরোটাই যে এক বারে জমা দিতে হবে, তা-ও নয়। ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কালো টাকার অঙ্কটা শুধু জানাতে বলা হচ্ছে। এর পরে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ২৫%, ২০১৭-র ৩১ মার্চের মধ্যে আরও ২৫% এবং বাকি ৫০% দিতে হবে ২০১৭-র ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে।
তবু কেন আশানুরূপ সাড়া মিলছে না এই প্রকল্পে?
অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, এই ধরনের প্রকল্পে শেষ বেলাতেই বেশি সাড়া মেলে। কালো টাকার অঙ্ক ঘোষণা করার আগে সকলেই যতটা সম্ভব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও আইনজীবীদের পরামর্শ নেন। এ বারও তা-ই হচ্ছে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট থেকে শুরু করে কর সংক্রান্ত মামলার আইনজীবীরা বলছেন, মোদী সরকারের ‘ইনকাম ডিক্লারেশন স্কিম-২০১৬’ বলছে, ঘোষিত কালো টাকার উপর ৩০% কর, ৭.৫% জরিমানা ও ৭.৫% কৃষি-কল্যাণ সেস— সব মিলিয়ে ৪৫% জমা করতে হবে। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, আয়কর ফাঁকি ধরা পড়লেও ৩০ শতাংশ জমা করলেই ছাড় মিলতে পারে। তা হলে ৪৫% কর-জরিমানা গুনতে যাব কেন!
যদিও আয়কর দফতরের কর্তারা বলছেন, ৩০ সেপ্টেম্বরের পরে আয়কর হানায় ধরা পড়লে তখন আর শুধু বকেয়া কর মিটিয়েই ছাড় মিলবে না। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারের শীর্ষস্তর থেকে তেমনই নির্দেশ এসেছে। আর একটি সমস্যা হল, কেউ হয়তো ২০ বছর আগে কালো টাকা দিয়ে একটি বাড়ি কিনেছেন। তখন খরচ পড়েছিল ১০ লক্ষ টাকা। সেই বাড়িরই দাম এখন হয়তো দাঁড়িয়েছে ১ কোটি টাকা। ফলে এই বাজারদরের ভিত্তিতে কর-জরিমানা হিসেবে দিতে হবে ৪৫ লক্ষ টাকা। বিভিন্ন মহল থেকে বারবার দাবি উঠলেও সরকার এই নিয়ম শিথিল করেনি।