সংসদ চত্বরে নরেন্দ্র মোদী। মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই।
সকালবেলাতেই বোঝা যায়, দিনটা কেমন যাবে।
সরকার সংসদে গঠনমূলক আলোচনার ডাক দিলেও অধিবেশনের প্রথম দিনেই সনিয়া গাঁধী বুঝিয়ে দিলেন, এ যাত্রায় অন্তত ভবি ভোলার নয়! তিন উইকেট পড়লে তবেই সংসদ চলবে, নইলে নয়। বিদেশমন্ত্রী ও বিজেপির দুই মুখ্যমন্ত্রী ইস্তফা না দিলে পণ্য পরিষেবা কর বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ তো দূর, বাদল অধিবেশনের ১৮ দিন স্রেফ স্লোগান, হট্টগোল আর ধর্নায় ধুয়ে যাবে।
প্রথম দিন গেলও তাই!
বাদল অধিবেশনের প্রথম দিনে সম্মিলিত বিরোধী ঝড়ের মুখে সরকার পক্ষের কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়া থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেল, অধিবেশনের বাকি দিনগুলি কেমন হতে চলেছে।
কংগ্রেস আজ পাতে ফেলেছে দু’জনের ইস্তফার দাবি। ললিত-কাণ্ডে জড়িয়ে যাওয়া বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজের ইস্তফার দাবিতে কংগ্রেস-বাম-সহ বিরোধীদের তুমুল হট্টগোলে আজ দফায় দফায় পণ্ড হয়ে যায় অধিবেশন। কাল ব্যপম-দুর্নীতির কঙ্কাল সংসদের উঠোনে তুলে আনবে কংগ্রেস। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানের ইস্তফার দাবিতে গাঁধী মূর্তির পাদদেশে ধর্নায় বসবেন তাদের সাংসদরা। তাতে সামিল হতে পারেন মা-ছেলেও। এর পর লোকসভায় এ নিয়ে মুলতবি প্রস্তাব পেশ করবেন কংগ্রেস নেতা কমল নাথ ও জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া।
বিজেপিকে চাপে ফেলার এই লড়াইয়ে কংগ্রেস বামেদের পাশে পেলেও তৃণমূল বা সমাজবাদী পার্টির মতো দলগুলি যে এ ব্যাপারে কিছুটা নরম, তা স্পষ্ট। নিজেই সেই প্রসঙ্গ তুলে সনিয়া এ দিন জানিয়ে দেন, কে সমর্থন করছে, কে করছে না, দেখার দরকার নেই। কংগ্রেস শিবিরের বক্তব্য, বিজেপিকে চাপে ফেলতে ধাপে ধাপে সুর চড়াবে তারা। শাসক দলের যে সব নেতা-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল উঠেছে, এক সঙ্গে তাদের সবার বিরুদ্ধে সুর চড়ানোর পরিবর্তে এক এক করে নিশানা করবে দল। কারণ একটাই। যাতে গোটা অধিবেশন জুড়েই শাসক শিবিরকে অস্বস্তিতে ফেলা সম্ভব হয়।
তিন জনের ইস্তফার প্রশ্নে সনিয়া কতটা অনমনীয়, আজ সকালেই তা স্পষ্ট হয়ে যায় দলের লোকসভা সদস্যদের নিয়ে এক বৈঠকে। সনিয়া ও সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধীর উপস্থিতিতে এই বৈঠকের শুরুতেই শশী তারুর আগ বাড়িয়ে বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, সংসদ অচল করা ঠিক হবে না। অতীতে বিজেপি যে পথে হেঁটে সংসদ একটানা অচল করে রাখত, কংগ্রেস কেন তা অনুসরণ করবে? বরং সংসদে সুষমা-বসুন্ধরা নিয়ে আলোচনা চাওয়া হোক।’’ দলীয় সূত্রের খবর, শশীর কথা শুনেই চোয়াল শক্ত করে ফেলেন সনিয়া। তাঁর দিকে না তাকিয়েই অন্যদের মত জানতে চান। নেত্রীর মনোভাব বুঝে বাকিরা শশীর তত্ত্ব দূর ছাই করতে শুরু করেন! সনিয়া দলীয় সাংসদদের স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘‘বিদেশমন্ত্রী ও দুই মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা আদায় করে তবেই সংসদ চলতে দেবে কংগ্রেস।’’ তাঁর বক্তব্য, ওই তিন জন ইস্তফা দেবেন কি না, তা নিয়ে হইচইয়ের মধ্যে দিয়ে কংগ্রেস গোটা দেশে তুলে ধরতে চায় যে, প্রধানমন্ত্রী মুখে স্বচ্ছতার কথা বললেও আদতে তিনি দুর্নীতিগ্রস্তদের ত্রাণকর্তা!
এর পরেই সক্রিয় হয় কংগ্রেস। সকালে বিজেপি সাংসদ দিলীপ সিংহ ভুরিয়ার মৃত্যুতে লোকসভা মুলতুবি হয়ে যায়। কিন্তু রাজ্যসভা শুরু হতে না হতেই কংগ্রেস ও বামেরা সুষমার ইস্তফার দাবিতে সরব হয়। কংগ্রেসের রাজ্যসভার দলনেতা আনন্দ শর্মা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা দাবি করেন এবং তাতে রাজি হয়ে যায় বিজেপি। এতে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে কংগ্রেস। কিন্তু দ্রুত তারা পাল্টা কৌশলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার শেষে ভোটাভুটি দাবি করে। এই দাবি মানতে চায়নি শাসক শিবির। এ নিয়ে হট্টগোলে বারবার মুলতুবি হয়ে যায় রাজ্যসভার অধিবেশন। আগামিকাল ফের বিষয়টি নিয়ে উভয় কক্ষেই সরব হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে কংগ্রেসের।
পাল্টা আক্রমণে অরুণ জেটলি বলেন, ‘‘কংগ্রেস ও বাম আলোচনা চাইছে না। রাজ্যসভায় আলোচনার দাবি আমরা মেনে নিয়েছিলাম। সুষমা স্বরাজও সংসদে জবাব দিতে প্রস্তুত। সভা পণ্ড করার জন্যই বিরোধীরা ভোটাভুটির দাবি তুলেছে।’’ জেটলি ভুল বোঝাচ্ছেন বলে পাল্টা অভিযোগ তুলে আনন্দ বলেন, ‘‘সংসদে কোনও মন্ত্রীর ইস্তফা চেয়ে আলোচনা দাবি করার মতো নিয়ম নেই। একমাত্র ভোটাভুটি চাওয়াটাই পথ। কংগ্রেস সেটাই হুবহু অনুসরণ করেছে।’’
সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির আবার বক্তব্য, ‘‘টুজি কেলেঙ্কারির সময়ে এই বিজেপি যৌথ সংসদীয় কমিটির দাবিতে সরব হয়েছিল। কংগ্রেস রাজি না হওয়ায় তখন সংসদের কাজ ভন্ডুল করে দিয়েছিল। এখন বিজেপি ভোল পাল্টালে কী করে হবে!’’ ঘটনাও তাই। এ ব্যাপারে দৃষ্টান্ত তৈরি করে রেখেছে বিজেপিই। এখন যেমন সুষমা স্বরাজের বিরুদ্ধে কোনও এফআইআর নেই, তেমনই ইউপিএ জমানায় বিদেশমন্ত্রী নটবর সিংহের বিরুদ্ধেও কোনও মামলা ছিল না। কিন্তু ভোলকার কাণ্ডে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠতেই জেটলিরা বলেছিলেন, আগে ইস্তফা হবে, তার পর সংসদে আলোচনা হবে। পরে আইপিএল-বিতর্কে শশী তারুরের পদত্যাগ চেয়ে একই ভাবে সংসদ অচল করে রাখে বিজেপি। শশীর ইস্তফার পরে লোকসভার তৎকালীন বিরোধী দলনেতা সুষমা স্বরাজ বলেছিলেন, ইস্তফা আগে হয়ে গেলে সংসদে আগেই চলতে পারত! পরবর্তী কালে টেলিকম মন্ত্রীর পদ থেকে এ রাজার ইস্তফা, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অশোক চহ্বাণের পদত্যাগ বা পবন বনশল ও অশ্বিনী কুমারের ইস্তফার দাবি নিয়ে এ ভাবেই সংসদ টানা অচল করে রেখেছিল বিজেপি। আজ সেটাই ফিরিয়ে দিচ্ছে কংগ্রেস।
কিন্তু বিজেপি কংগ্রেসের দাবির কাছে মাথা নোয়াতে এখনও নারাজ। সুষমা বা বসুন্ধরা, কারও ইস্তফার পক্ষে নন মোদী। কারণ তাতে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাবে। একই সঙ্গে বিজেপির বক্তব্য, আজ বিরোধীদের দাবি মেনে বসুন্ধরা-সুষমা ইস্তফা দিলেও কংগ্রেস তো অধিবেশন চলতে দেবে না! যেমনটা করেছিল গত বারের বাজেট অধিবেশনের সময়। বরং ওই ইস্তফার পরে রক্তের স্বাদ পেয়ে আরও সক্রিয় হবে বিরোধীরা। তখন শিবরাজ থেকে শুরু করে পঙ্কজা মুণ্ডে-সহ বেশ কিছু শীর্ষ নেতা-মন্ত্রীকে নিশানা করবেন বিরোধীরা।
তাই আজ থেকে যেটা শুরু হল, সেটা স্নায়ুর যুদ্ধ। এক দিকে বামেদের পাশে নিয়ে সরকারকে ঘেরার কৌশল নিয়েছে কংগ্রেস। অন্য দিকে ইস্তফা নিয়ে মোদীর কড়া অবস্থান। কে আগে পলক ফেলে, এখন সেটাই দেখার!
বিদেশ সফর থেকে ফেরার পরে প্রধানমন্ত্রী আজ রীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন। বিরোধী শিবিরে জল্পনা, জমি প্রশ্নে দরকারে চতুর্থ বার অধ্যাদেশ জারি করতে পারে সরকার। এমন কিছু প্রসঙ্গেও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলে থাকতে পারেন মোদী।
কিন্তু সংসদের অধিবেশন? মন্ত্রীদের ইস্তফা না হলে এ যাত্রায় তা হলে সংসদ চলবেই না! আনন্দ শর্মার তির্যক জবাব, ‘‘হ্যাঁ চলতে পারে। আর একটা পথ আছে, যদি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি দিয়ে বলেন, ললিত মোদীকে ব্রিটিশ ভিসা পাইয়ে দিতে ভারতের বিদেশমন্ত্রী তাঁদের কোনও অনুরোধ করেননি! ললিত মোদীর অভিবাসনের জন্য গোপন হলফনামা দেননি বসুন্ধরা রাজে। মোদী চেষ্টা করে দেখুন, তাঁর বন্ধুর কাছ থেকে সেই বিবৃতি যদি আদায় করতে পারেন!’’