নীতি আয়োগে নেই কংগ্রেস, সহমতের আশাও দূর অস্ত্

বিরোধীদের বাধায় আটকে রয়েছে জমি বিল। ফলে এক দিকে যেমন গতি রুদ্ধ শিল্পায়নের, তেমনই অন্য দিকে ব্যাহত হচ্ছে গ্রামীণ প্রকল্পের কাজ। এই অবস্থায় এ বারে দু’ভাবে বিরোধীদের উপরে চাপ বাড়ানোর পথ নিল নরেন্দ্র মোদী সরকার।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৫ ০৩:৪৩
Share:

বৈঠকের আগে বসুন্ধরা রাজের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।

বিরোধীদের বাধায় আটকে রয়েছে জমি বিল। ফলে এক দিকে যেমন গতি রুদ্ধ শিল্পায়নের, তেমনই অন্য দিকে ব্যাহত হচ্ছে গ্রামীণ প্রকল্পের কাজ। এই অবস্থায় এ বারে দু’ভাবে বিরোধীদের উপরে চাপ বাড়ানোর পথ নিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী নিজে গ্রামীণ প্রকল্পগুলি আটকে থাকার কথা বলে বোঝাতে চাইলেন, বিলের বিরোধিতা করে বিরোধীরা আদতে সামাজিক কাজকেই আটকে দিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, রাজ্যগুলিকে পৃথক জমি আইন তৈরির অধিকার দিতে ভাবনাচিন্তা শুরু করল কেন্দ্র। এর ফলে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলি নিজেদের মতো আইন করে নিতে পারবে। দিল্লি পুরনো জমি আইনে আটকে থাকলেও রাজ্যগুলির আর অধিগ্রহণে সমস্যা হবে না।

Advertisement

বিরোধীরা একজোট হয়ে বাধা দিচ্ছে বলেই বারবার অর্ডিন্যান্স এনেও আইন সংশোধনে ব্যর্থ হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। সেই বাধা কাটাতে এ দিন নীতি আয়োগের বৈঠকে জমি বিল নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। বৈঠকে হাজির ছিলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। কিন্তু কংগ্রেসশাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা এই বৈঠক বয়কট করেছেন। ছিলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়ললিতা, অখিলেশ যাদব, নবীন পট্টনায়কের মতো আঞ্চলিক দলগুলির মুখ্যমন্ত্রীরা। থাকতে যে পারবেন না, সে কথা জানিয়ে মমতা আগেই প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন। এ দিন তিনি বর্ধমানে বলেওছেন, ‘‘আমরা নীতি আয়োগকে বয়কট করিনি। কিন্তু এ দিন নীতি আয়োগের বৈঠক ডাকার অনেক আগেই আমাদের শততম বৈঠক ঠিক হয়। তাই যাওয়া সম্ভব হয়নি।’’ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য ঘোষিত ভাবেই কোনওরকম জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে। বিরোধীদের মধ্যে হাজির ছিলেন নীতীশ কুমার, অরবিন্দ কেজরীবাল এবং মানিক সরকার। নীতীশ দাবি করেন, এখন নতুন জমি বিল নিয়ে এগোনোর উপযুক্ত সময় নয়। কারণ এই বিল কৃষক স্বার্থ বিরোধী বলে ধারণা তৈরি হয়েছে। কেজরীবালের বক্তব্য, নতুন আইন না এনে বরং পুরনো আইন নিয়েই আরও চেষ্টা করা দেখা হোক। মানিক জানিয়েছেন, তাঁর পক্ষে এই বিল মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

বিরোধীদের এই সামগ্রিক আপত্তির মধ্যে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীরা কিন্তু কেন্দ্রের বিলের পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের সাফ কথা, ইউপিএ-সরকারের তৈরি ২০১৩-র জমি অধিগ্রহণ আইনে শিল্প বা পরিকাঠামোর জন্য জমি অধিগ্রহণ কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এই আইন অনুযায়ী শিল্পের জন্য জমি নিতে হলে ৮০ শতাংশ জমিদাতার সম্মতি প্রয়োজন। বাস্তবে যা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। অথচ যে সব রাজ্য দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধির পথে যেতে চাইছে, তাদের পক্ষে অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস এই যুক্তি দেখিয়ে দাবি তোলেন, কাজেই ওই সব রাজ্যকে নিজের মতো জমি অধিগ্রহণ আইন তৈরির ক্ষমতা দেওয়া হোক।

Advertisement

ফডণবীসের এই বক্তব্যকেই এর পর লুফে নেন জেটলি। তিনি বলেন, ‘‘আজকের বৈঠকে এই পরামর্শটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ।’’ তাঁর কথা থেকেই ইঙ্গিত, কেন্দ্রও এই পথেই ভাবনাচিন্তা করছে। জেটলি এর পরে রাজ্যগুলিকে আলাদা আইন তৈরির অধিকার দিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে উন্নয়নমূলক প্রতিযোগিতা উস্কে দিতে চেয়েছেন। ঠিক যেমনটা চেয়েছিল ভূতপূর্ব দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার। তারা যে আইন তৈরি করে, তাতেও রাজ্যগুলিকে পৃথক জমি নীতি তৈরির অধিকার দেওয়া হয়েছে।

মজার বিষয় হল, সেই কংগ্রেসই এখন নতুন জমি আইনের প্রবল বিরোধী। শুধু নিজেদের মুখ্যমন্ত্রীদের নীতি আয়োগের এই বৈঠক থেকে দূরে রেখেই ক্ষান্ত হয়নি তারা, একই সঙ্গে কেন্দ্রের এই চাপের বিরোধিতাতেও দ্রুত নেমে পড়েছে। কংগ্রেস নেতৃত্বের যুক্তি, রাজ্যগুলিকে পৃথক আইন তৈরির ক্ষমতা দেওয়া হোক। কিন্তু তাদের আইন যেন কেন্দ্রের আইনকে ছাপিয়ে না যায়। অর্থাৎ, কেন্দ্রের আইনে যদি ৭০ শতাংশ জমি মালিকের সম্মতির কথা বলা হয়, তবে রাজ্য তার থেকে সম্মতিতে অধিগ্রহণ করতে পারবে না।

ইউপিএ আমলে জমি আইন তৈরির মূল কারিগর ছিলেন জয়রাম রমেশ। নিজেদের শর্ত আইনে রাখার ব্যাপারে দাবিদাওয়া নিয়ে তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু বৈঠক করেছিলেন জেটলিএখন মোদী সরকার নতুন আইন চাইলে কংগ্রেস সহযোগিতা করছে না— এই অভিযোগ বিজেপি নেতাদের মুখে। এ দিন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীরা বৈঠকে না আসায় জেটলির কটাক্ষ, ‘‘যাঁরা বৈঠক বয়কট করছেন, তাঁরা সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো মেনে চলছেন কি না সে বিষয়ে আত্মসমীক্ষা করুন।’’ তবে সরকার শেষ পর্যন্ত কী ভাবে এগোবে, তা স্পষ্ট করেননি জেটলি।

জেটলি এবং বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীদের এই অবস্থান যদি বিরোধী সামলাতে পয়লা কৌশল হয়, তবে দ্বিতীয় চালটা দিয়ে রাখলেন মোদী। তিনি বলেছেন, জমি বিল নিয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থাই গ্রামীণ উন্নয়নে প্রধান বাধা। এর ফলে স্কুল, রাস্তা বা সেচের মতো কাজগুলি আটকে যাচ্ছে।

বিজেপির একটি অংশের বক্তব্য, মোদী বহু সভায় বিরোধীদের গরিব-বিরোধী বলে দাবি করেছেন। এ দিন নীতি আয়োগের বৈঠকে স্পষ্ট বোঝালেন, কেন অভিযোগ এনেছেন। স্কুল, রাস্তা বা সেচ গ্রামীণ প্রকল্প বা সামাজিক পরিকাঠামো—যে কোনও বিভাগেই পড়তে পারে। নতুন আইনে দুই বিভাগের জন্য জমি অধিগ্রহণেই ৮০ শতাংশ জমি মালিকের সম্মতির শর্তটি তুলে দেওয়া হয়েছে। এমন আইনকে যে আটকাবে, তারা গ্রামবাসীদের ক্ষতি করবে— এ দিন এটাই স্পষ্ট করতে চেয়েছেন মোদী।

এত কিছুর পরেও কি এগোলেন মোদী-জেটলিরা? সংসদীয় কমিটিতে বিল পড়ে আছে। সেখানে বেগতিক বুঝেই মোদী মুখ্যমন্ত্রীদের ডেকে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা করেন। ১৬ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা এসেছেন। প্রায় অর্ধেক গরহাজির। তাঁরা বিরোধী পক্ষের। সে ক্ষেত্রে ঐকমত্যের চেষ্টা কি মাঠে মারা গেল না? জেটলির যুক্তি, জমি অধিগ্রহণ সহজ করতে ২০১৩-র আইনে সংশোধন দরকার বলে মুখ্যমন্ত্রীরাই দাবি তুলেছিলেন। পরে ইউপিএ-র মুখ্যমন্ত্রীরা অবস্থান বদলান। কিন্তু যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার জন্য নীতি আয়োগই উপযুক্ত মঞ্চ। তাই এই বৈঠকের ডাকা হয়। বিজেপির একাংশ বলছে, এত চেষ্টাতেও জটটা থেকেই গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন