মমতাকে কাছে টানতে চায় কৌশলী কংগ্রেস

আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদী বিরোধী রাজনৈতিক মঞ্চ গঠনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কংগ্রেসের মনোভাব কী হবে, তা নিয়ে সনিয়া গাঁধী নবকলেবরে পর্যালোচনা শুরু করেছেন।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৬ ০৩:২৩
Share:

আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদী বিরোধী রাজনৈতিক মঞ্চ গঠনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কংগ্রেসের মনোভাব কী হবে, তা নিয়ে সনিয়া গাঁধী নবকলেবরে পর্যালোচনা শুরু করেছেন।

Advertisement

সনিয়া গাঁধী গত কয়েক দিনে আহমেদ পটেল, কমল নাথ, দিগ্বিজয় সিংহ, সি পি জোশী, অজয় মাকেনের মতো বেশ কয়েক জন শীর্ষ নেতার সঙ্গে মমতা সম্পর্কে তাঁর অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেছেন। দরজা খুলে না দিলেও জানলা খুলে রাখা উচিত, এমন একটা রাজনৈতিক লাইন সনিয়া নিতে আগ্রহী। রাহুল গাঁধীর সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের আলোচনা হবে।

পশ্চিমবঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ও বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে রাজ্যে কংগ্রেস ভোটে হেরে যাওয়ার পরেও মমতা-বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বটে, কিন্তু কংগ্রেস শীর্ষনেতৃত্ব মমতার বিষয়ে জানলা খুলে রাখার নীতির সঙ্গে তার কোনও বিরোধ দেখছেন না। সি পি জোশী বলেন, রাজ্যস্তরে তৃণমূল শাসক দল। সেখানে কংগ্রেস বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু জাতীয় স্তরে মোদী-বিরোধী মঞ্চে সকল ধর্মনিরপেক্ষ দলকে সামিল করাই কংগ্রেসের লক্ষ্য। আর তাই জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে মমতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার রাস্তা বন্ধ রাখাকে ঠিক বলে মনে করছেন না সনিয়া গাঁধী। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, শতকরা ৩০ ভাগ সংখ্যালঘু ভোট এখনও করায়ত্ত রাখতে পারা মমতা আর যা-ই হোক, কিছুতেই এনডিএ-তে সামিল হবেন না।

Advertisement

লক্ষ্য করার বিষয়, সিপিএম পলিটব্যুরো সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের হিংসা রুখতে সকলের সঙ্গে জোট হবে, কিন্তু কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও মতাদর্শগত জোট থাকবে না। পলিটব্যুরোর এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সনিয়া কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। তিনি মনে করছেন, জাতীয় স্তরে মোদী-বিরোধী মঞ্চ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলে সংসদে বা সংসদের বাইরে মমতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হবে না কেন? কংগ্রেস যদি নীতীশ কুমার, লালু প্রসাদ যাদব, অখিলেশ যাদব, ফারুক আবদুল্লা, করুণানিধি প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে, তা হলে মমতার সঙ্গে রাখবে না কেন? মমতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা মানে সিপিএমের সঙ্গে ঝগড়া করা নয়।

মমতার সঙ্গে বোঝাপড়ার প্রশ্নে কংগ্রেসের মধ্যে টানাপড়েন আছেই। এ বারে যখন কংগ্রেস ও সিপিএমের নির্বাচনী জোট গঠন হল, তখন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে আহমেদ পটেল, কমল নাথ, জনার্দন দ্বিবেদীর মতো বেশ কিছু নেতা মমতার সঙ্গে জোট গড়ার পক্ষে ছিলেন। নীতীশ কুমারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের দিনে যখন মমতার সঙ্গে রাহুলের দেখা হয় বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে, তখন মমতা তাঁকে বলেছিলেন, আর যা-ই করো, সিপিএমের সঙ্গে জোটে যেও না। লাভ হবে না। রাহুল গাঁধী সে কথা দিল্লি এসে বলে দিয়েছিলেন রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের কাছে। এমনকী কিছু সাংবাদিকের কাছেও। অন্য দিকে, অধীর চৌধুরী, আবদুল মান্নান, সোমেন মিত্র, প্রদীপ ভট্টাচার্য প্রমুখ নেতারা মমতার সঙ্গে জোট গঠনের বিরোধিতা করেন। কেন না রাজ্য কংগ্রেস নেতারা এখনও মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসকে বাড়তে গেলে মমতা বিরোধিতার তাস ব্যবহার করেই বাড়তে হবে। আর মমতার সঙ্গে জোট গঠন করলে কংগ্রেস সম্মানজনক ভাবে আসন পায় না।

এখন কিন্তু সনিয়া-ঘনিষ্ঠ কংগ্রেস নেতা পি সি চাকো বলছেন, সিপিএম যেমন বলছে, কংগ্রেসের সঙ্গে এখন আর পশ্চিমবঙ্গের জোট নেই, আমরাও এখন বলছি, ভোট হয়ে যাওয়ার পর নির্বাচনী সমঝোতা নেই। নির্বাচন না থাকলে নির্বাচনী জোট থাকে কী করে! উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন। সেখানেও কংগ্রেস, সিপিএম কোনও জোট নেই। ওই নির্বাচনের পর মোদী-বিরোধী রাজনীতি তুঙ্গে উঠবে, সে রাজনীতিতে কারা কারা থাকবে, সেটা নতুন করে পর্যালোচনা
হওয়া প্রয়োজন।

সন্দীপ দীক্ষিত বলেন, ‘‘সংসদে তৃণমূলের লোকসভা সদস্য ৩৩ জন, রাজ্যসভা সদস্য ১২ জন। সিপিএমের তুলনায় সেটা অনেক বেশি। বিজেপি-বিরোধী রাজনীতিতে যদি এই সংখ্যক সাংসদদের নিয়ে মমতা সামিল হন, তবে তাঁকেও আমরা স্বাগত জানাব। মমতার বিজেপি-বিরোধিতার বিরোধিতা করব কেন!’’

ভোট শেষ হওয়ার পরে পরেই মমতার দল রাজ্যসভায় গাঁধী পরিবারের বিরুদ্ধে কপ্টার-দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলেছে। যেটি বিজেপির তোলা প্রশ্ন। বিজেপি চায়, আসন্ন বাদল অধিবেশনে মমতা গাঁধী পরিবার তথা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আরও আক্রমণাত্মক হোন। বিজেপির উসকানিতে মমতা কংগ্রেস-বিরোধী হলে কংগ্রেসের লাভের চেয়ে লোকসান বেশি।

মায়াবতীকেও বিজেপি ‘ম্যানেজ’ করতে চাইছে। কিন্তু কংগ্রেসের দৌত্যের সফলতা দেখা গিয়েছে উত্তরাখণ্ডে কংগ্রেস সরকার গঠনের ক্ষেত্রে। তখন কিন্তু মায়াবতীর দুই বিধায়ক বিজেপির ফাঁদে পা না দিয়ে কংগ্রেসকেই সমর্থন করেছেন। এ হেন অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের জোট রক্ষা করতে গিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে মমতাকে সঙ্গে না পাওয়া ভুল রণকৌশল বলে মনে করছেন অনেক কংগ্রেস শীর্ষ নেতা। জ্যোতি বসুর জমানায় প্রিয়-মমতা যতই রাজ্য স্তরেসিপিএম বিরোধিতা করুন না কেন, জাতীয় স্তরে হরকিষেণ সিংহ সুরজিত চিরকাল রাজীব গাঁধীর সঙ্গে দৌত্য রক্ষা করেছেন। অতীতের সেই দ্বিমুখী রণকৌশল মমতার ক্ষেত্রে অনুসরণ করতে কংগ্রেসেরই একটা অংশ তৎপর।

অধীর চৌধুরীর নেতৃত্বে রাজ্য কংগ্রেস নেতারা অবশ্য মমতার সঙ্গে বোঝাপড়ার ঘোরতর বিপক্ষে। আবদুল মান্নান সম্প্রতি দিল্লি এসে সনিয়াকে পিএসি চেয়ারম্যানের পদটি সিপিএমকে দেওয়ার পরামর্শ দেন। মান্নানের যুক্তি ছিল, সিপিএম কংগ্রেসকে পরিত্যাগ করলে সেটা তারা আগে করুক। জোট ভাঙার দায় কংগ্রেস কেন নেবে? বরং সিপিএম জোট ভাঙলে সিপিএম কর্মীরা হতাশ হয়ে কংগ্রেসে চলে আসতে পারেন। কিন্তু মমতার চালে মানস ভুঁইয়া পিএসি চেয়ারম্যান হয়ে যাওয়ায় এখন মান্নানের মতো নেতারা মানসবাবুকে সাসপেন্ড করার জন্য হাইকম্যান্ডের উপর চাপ দিচ্ছেন। কিন্তু ডি পি রায়ের মতো কংগ্রেস নেতা দিল্লি এসে সম্প্রতি সনিয়াকে পাল্টা যুক্তি দিয়ে জানিয়ে গিয়েছেন যে, সিপিএমের বিরুদ্ধেও কংগ্রেস কর্মীরা লড়তে চায়। এই বোঝাপড়ার জন্য পিএসি-র মতো একটি তুচ্ছ তিলকে তাল করার মানে হয় না।

ভরা বর্ষায় রাজনীতি

আর পাঁচটা বর্ষায় পাহাড়ের রাজনৈতিক দলগুলির তেমন কর্মসূচি চোখে পড়ে না। কিন্তু, এ বার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী ৫ দিন ধরে পাহাড়ে ঘাঁটি গেড়ে থাকার কারণে পুরো ব্যাপারাটাই যেন ভিন্ন মাত্রা নিয়েছে। আবহাওয়া ঠিক থাকলে আজ, সোমবার সন্ধেতেই দার্জিলিঙে পৌঁছে যাবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে প্রায় গোটা নবান্নের শীর্ষ কর্তারা। যাবেন একঝাঁক মন্ত্রীও। আগামী কাল, মঙ্গলবার পাহাড়ে চার দিনের সফরে পৌঁছবেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। সে দিন সন্ধেয় তাঁকে ম্যালেই সংবর্ধনা দেবেন মুখ্যমন্ত্রী। গত বিধানসভা ভোটে জিএনএলএফ, হরকাবাহাদুর ছেত্রীর জন আন্দোলন পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে কালিম্পং, কার্শিয়াং, দার্জিলিং আসনে মোর্চার ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলেছে তৃণমূল। আগামী বছর জিটিএ ভোট। জিএনএলএফ সোমবার বিকেলে রোহিণী থেকে দার্জিলিং স্টেশন পর্যন্ত মানব বন্ধন করবে। হরকাবাহাদুরও গাড়ি বোঝাই সমর্থক নিয়ে দার্জিলিঙে যাবেন। গোর্খা লিগ নেত্রী ভারতী তামাঙ্গও মমতার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। এর পরে কী বসে থাকতে পারেন বিমল গুরুঙ্গ। তিনিও তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে তলানিতে চলে যাওয়া সম্পর্ক মেরামত করতে চান। রাজ্যের অনুষ্ঠানের কারণে জিটিএ-এর ভানু-জয়ন্তীর দিন পিছিয়ে দিয়েছেন। মোর্চার শীর্ষ নেতা তথা গুরুঙ্গের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বিনয় তামাঙ্গের কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীকে সোমবারই স্বাগত জানানো হবে। সময় দিলে আমাদের সভাপতিও দেখা করবেন। খোলা মনেই সব কিছু নিয়ে আলোচনা চাই।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন