Coronavirus Lockdown

‘ছেলেকে জল দিতে পারিনি’

কথাগুলো শুনে চকিতে এক বছর আগের সেই ছবি ভেসে ওঠে। গত এপ্রিল-মে মাসে লকডাউনের দিল্লি। এলোমেলো চুলে বিধ্বস্ত একটি মুখ।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২১ ০৫:৩২
Share:

সেই ছবি: নিজামুদ্দিন ব্রিজে রামপুকর। পিটিআইয়ের ফাইল চিত্র

ফোনে কথা বলতে গিয়ে গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠছে কান্না। নিজেকে কোনওক্রমে সামলে, সামান্য দম নিয়ে রামপুকর পণ্ডিত শুধু বললেন, ‘‘একটা গাছ পুঁতলে, তাতে জল দিতে হয়। আমি তো নিজের ছেলেকেও মরে যাওয়ার সময়ে জল দিতে পারিনি।’’

Advertisement

ছেলে আর নেই। কিন্তু লকডাউনের ক্ষত আর আতঙ্ক পুরোদস্তুর রয়ে গিয়েছে এখনও। এতটাই যে, এত মাস পেরিয়েও দেশের রাজধানীতে ফেরার ‘সাহসটুকু পর্যন্ত’ আর সঞ্চয় করতে পারেননি রামপুকর। বলছেন, ‘‘আর দিল্লি যাব না। কে জানে, সরকার কবে আবার না বলে-কয়ে লকডাউন ঘোষণা করে দেবে! এ বার হয়তো ফোনে শুনব মা বা বাপ মরতে বসেছে। কিন্তু আটকে পড়ার দরুন শেষবেলায় তাঁদের মুখেও হয়তো জল দিতে পারব না।’’

কথাগুলো শুনে চকিতে এক বছর আগের সেই ছবি ভেসে ওঠে। গত এপ্রিল-মে মাসে লকডাউনের দিল্লি। এলোমেলো চুলে বিধ্বস্ত একটি মুখ। নিজামুদ্দিন ব্রিজে রাস্তার ধারের ফুটপাথে বসা। কানে ফোন। মাস্কটা থুতনির কাছে নামানো। হাউহাউ করে কেঁদে চলেছেন এক অসহায় মানুষ। কাঁদতে কাঁদতে মুখের শিরা ফুলে উঠেছে। দেশ জুড়ে আচমকা লকডাউন ঘোষণার দরুন রামপুকর ‘দেশের বাড়িতে’ ফিরতে পারছেন না। যাওয়ার সব উপায় বন্ধ।

Advertisement

রামপুকরের কান্নার সেই ছবি, তাঁর অসহায় মুখ লকডাউনের সময়ে ‘ভাইরাল’ হয়েছিল। পিটিআইয়ের চিত্র-সাংবাদিক অতুল যাদবের তোলা এই ছবি লকডাউনের জেরে দিল্লি, মুম্বইয়ের মতো বড় শহরে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থার কার্যত প্রতীক হয়ে উঠেছিল। তখন নাম না-জানলেও, সারা দেশ রামপুকরের ওই অসহায় কান্নার মুখ ভুলতে পারেনি।

ছবি যখন তোলা হয়, তখন রামপুকরের ফোনের ও প্রান্তে স্ত্রী বিমলা হাহাকার করছেন, ‘বাড়িতে একরত্তি ছেলেটা ভুগছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। ছেলেটা বোধহয় মরেই যাবে। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।’ কিন্তু রামপুকর ফেরেন কী করে? দিল্লি থেকে বিহারের বেগুসরাই প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার। ট্রেন-বাস সব বন্ধ। উপায় নেই দেখে নজফগড় থেকে হাঁটতে শুরু করেছিলেন বছর পঁয়তাল্লিশের রামপুকর। কিন্তু নিজামুদ্দিন ব্রিজের কাছে পুলিশ আটকে দিয়েছে। তখনই স্ত্রী ফোনে জানান, ছেলেটাকে বোধহয় বাঁচানো যাবে না।

বেশ কিছু দিন দিল্লিতে আটকে থাকার পরে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে বিহারে নিজের বাড়ি ফিরেছিলেন রামপুকর। তত দিনে সব শেষ। তাঁর ছোট্ট ছেলেটাকে বাঁচানো যায়নি। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে ছেলের নাম রামপ্রবেশ রেখেছিলাম। নজফগড়ে কনস্ট্রাকশন সাইটে শ্রমিকের কাজ করতাম। দু’হাতে সিমেন্ট-বালি মাখতাম আর ভাবতাম, কবে বাড়ি গিয়ে ছেলেটাকে কোলে নেব! লকডাউন সেটুকুও হতে দিল না’’—ফোনেই ফের গলা বুজে আসে রামপুকরের।

এক বছর আগে লকডাউনের পরে গ্রামে ফিরতে হয়েছিল। তারপরে আর দিল্লিমুখো হননি রামপুকর। বেগুসরাইয়ের বারিয়ারপুর পূর্বী গ্রামেই মাথা গুঁজে পড়ে রয়েছেন। কুমোর পরিবারের সন্তান রামপুকর বলেন, ‘‘নিজেদের বিশেষ জমি নেই। অন্যের জমিতে ফসল কাটি। মাসে ৭-৮ হাজার টাকা আয় হয়। বাড়িতে স্ত্রী, তিন মেয়ে, মা-বাপ রয়েছেন। ‘এতগুলো পেট’ ওই টাকায় চলে না। দিল্লিতে অনেক বেশি রোজগার হত। কিন্তু ভিক্ষে করে খেতে হলেও আর দিল্লি ফিরব না।’’ কেন? রামপুকরের জবাব, ‘‘নোট বাতিলের সময়ে বাইরে কাজ করে গিয়ে মুশকিলে পড়েছিলাম। হঠাৎ কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেল। তারপর হঠাৎ লকডাউন করে দিল। এখন কেমন ভয় করে!’’

বিহারে বিধানসভা ভোট হয়ে গিয়েছে। রামপুকর শুনেছেন, নীতীশ কুমার বলেছেন, গ্রামে গ্রামে পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হবে। মোদী সরকারও বিহারে গরিব কল্যাণ রোজগার যোজনা চালু করেছে। তেজস্বী যাদব তাঁর জন্য চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সবই শুনেছেন। কিন্তু কিছুই চোখে দেখেননি। রামপুকরের কথায়, ‘‘বড় মেয়েটা ক্লাস ফোরে পড়ছে। মেজটা ক্লাস ওয়ানে।
ছোটটাও স্কুলে যাবে এ বার। ওদের মা বলেছে, ভিক্ষে করতে হলেও আমি যেন আর সন্তানদের ছেড়ে ভিন্‌ রাজ্যে না যাই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন