সুযোগ কর্পোরেটকে

রাজি এমসিআই, মেডিক্যাল কলেজ খুলতে সবুজ সঙ্কেত কর্পোরেটকেও

কেন্দ্র রাজি ছিল। কথাবার্তা চলছিল বেশ ক’মাস ধরে। অবশেষে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)-র সবুজ সঙ্কেত এসে যাওয়ায় দেশে কর্পোরেট বা লাভজনক সংস্থাগুলির সামনে মেডিক্যাল কলেজ খোলার পথ আরও প্রশস্ত হল।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৯
Share:

কেন্দ্র রাজি ছিল। কথাবার্তা চলছিল বেশ ক’মাস ধরে। অবশেষে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)-র সবুজ সঙ্কেত এসে যাওয়ায় দেশে কর্পোরেট বা লাভজনক সংস্থাগুলির সামনে মেডিক্যাল কলেজ খোলার পথ আরও প্রশস্ত হল।

Advertisement

গত ২২ নভেম্বর দিল্লিতে এমসিআইয়ের বৈঠকে প্রস্তাবটির পক্ষে কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য রায় দিয়েছেন। কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রকে পাঠানো হয়েছে। তাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সিলমোহর পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। তার পরে যে কোনও কর্পোরেট হাসপাতাল, এমনকী ফার্মা কোম্পানিও চাইলে মেডিক্যাল কলেজ খুলতে পারবে। সেখানকার লাভের টাকা ঘরে তুলতে বাধা থাকবে না। পাশাপাশি যে সব সমিতি বা ট্রাস্ট মেডিক্যাল কলেজ চালাচ্ছে, তারাও নিজেদের লাভজনক সংস্থায় পরিণত করে কলেজ চালাতে পারবে।

কেন্দ্রীয় বিধি মোতাবেক এখন দেশে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ চালানোর অধিকার শুধু ট্রাস্ট বা সমিতির, যারা কিনা ‘অলাভজনক’ সংস্থা। মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাওয়া মুনাফার অর্থ খরচ করা যায় শুধু কলেজের পরিকাঠামো উন্নয়নে। নিয়মটি শিথিল করে লাভজনক সংস্থাকেও মেডিক্যাল কলেজ খোলার অধিকারদানের জন্য মাস দুয়েক আগে সুপারিশ করেছিল কেন্দ্রীয় নীতি আয়োগ কমিটি।

Advertisement

কেন্দ্র তা এমসিআইয়ের কাছে পাঠায়। তাতে সম্মতিদানের কথা জানিয়ে এমসিআইয়ের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড গ্রিভান্স সেলের চেয়ারম্যান, চিকিৎসক অজয়কুমার বলেন, ‘‘অনেক অলাভজনক সংস্থা বা ট্রাস্ট সেবা করার নামে মেডিক্যাল কলেজ খুলে টেবিলের তলা দিয়ে টাকা নিয়ে থাকে। আমরা চাইছি, লুকোচুরি বন্ধ হোক। যা লাভ করার, খোলাখুলি করুক। স্বচ্ছতা থাকুক।’’ তাঁর যুক্তি, ‘‘ব্যবসায়িক লাভ না-থাকলে কেউ খামোখা মেডিক্যাল কলেজ খুলতে চাইবে না। অনেক ট্রাস্ট আমাদের বলেছে, তারা আর চালাতে পারছে না। এ দিকে আমাদের প্রচুর ডাক্তার দরকার। অথচ সরকারও এত নতুন কলেজ খুলতে অপারগ।’’

এমতাবস্থায় কর্পোরেটের সামনে দরজা উন্মুক্ত করাই সেরা উপায় বলে মনে করছে এমসিআই। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের যুগ্মসচিব অরুণ সিঙ্ঘলও বলেন, ‘‘মেডিক্যাল শিক্ষায় বিনিয়োগের বিপুল সম্ভাবনা। উপরন্তু ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানো জরুরি। সিদ্ধান্তটি যথাযথ।’’ মন্ত্রকের একাধিক সূত্রের পর্যবেক্ষণ— সর্বভারতীয় প্রবেশিকার (নিট) মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি সব মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রভর্তির নতুন যে নিয়ম, সিদ্ধান্তের নেপথ্যে তারই অন্যতম ভূমিকা। কী রকম?

এই মহলের বক্তব্য— এত দিন সমিতি বা ট্রাস্ট পরিচালিত কলেজগুলো নিজেদের কোটায় পড়ুয়া ভর্তি করে এসেছে, নিজস্ব প্রবেশিকা মারফত। অভিযোগ, পরীক্ষা ছিল নামকাওয়াস্তে। যাঁরা কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত টিউশন ফি’র চার-পাঁচ গুণ (অঙ্কটা হামেশা কোটি ছুঁত) ‘প্রণামী’ দিতেন, শিকে ছিঁড়ত তাঁদেরই কপালে। এ ভাবে বিপুল কালো টাকা লুটত সংস্থাগুলো। কিন্তু নিট-বিধির দৌলতে সেই বাড়তি রোজগার বন্ধ হওয়ায় বহু ট্রাস্ট মেডিক্যাল কলেজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। ‘‘দেখা হচ্ছে, তারা যাতে লাভের পথ খোলা রেখেই কলেজ চালাতে পারে।’’— মন্তব্য এক কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তার।

পাশাপাশি এমসিআইয়ের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পিছনে যে পাঁচশো–হাজারি নোট বাতিলেরও খানিক ভূমিকা আছে, তার ইঙ্গিত মিলেছে। কাউন্সিলের এক কর্তার কথায়, ‘‘আমরা বিষয়টা বেশ কিছু দিন ফেলে রেখেছিলাম। কিন্তু ডিমনিটাইজেশনের পরে বিভিন্ন বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের তরফে চাপ আসছে। নোট বাতিলের ধাক্কায় কিছু ট্রাস্ট বা সমিতির বিস্তর কালো টাকা নষ্ট হয়েছে। তারা এখন লাভজনক সংস্থা হিসেবে কলেজ চালাতে চায়। তাই সম্মতি দিয়েছি।’’ নীতিগত ভাবে এটা কি ঠিক হল?

জবাবে ব্যবসায়িক তাগিদের যুক্তি শোনা যাচ্ছে। ‘‘এ-ও তো ব্যবসা! আর মুনাফা ছাড়া কোনও কারবার টেকে না। মুনাফায় যদি স্বচ্ছতা থাকে, আপত্তি কোথায়? ডাক্তার তো বানাতে হবে!’’— বলছেন এমসিআইয়ের এক কর্তা।

বেসরকারি চিকিৎসাক্ষেত্রের নানা মহলও একে প্রাথমিক ভাবে স্বাগত জানাচ্ছে। যেমন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হসপিটালস অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’র সভাপতি তথা এক কর্পোরেট হাসপাতালের সিইও রূপালি বসুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে ভাল।’’ যদিও তাঁর উপলব্ধি, ‘‘টিউশন ফি’তে সরকারি নিয়ন্ত্রণ (ক্যাপিং) থাকলে অধিকাংশ কর্পোরেট আগ্রহ দেখাবে না। নিজেদের মতো ফি নিতে না-পারলে ব্যবসা লাভজনক হবে কী করে?’’ যাদবপুরের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ কেপিসি’র কর্ণধার কালীপ্রদীপ চৌধুরী আমেরিকা থেকে ফোনে বলেন, ‘‘অলাভজনক সংস্থার সঙ্গে লাভজনক কোম্পানিও মেডিক্যাল কলেজ চালাচ্ছে সারা বিশ্বে। সিদ্ধান্তটি ভাল।’’ তবে ওঁদের কলেজ আপাতত অলাভজনকই থাকবে বলে জানিয়েছেন কালীপ্রদীপবাবু।

অন্য দিকে সংশয়ও রয়েছে কিছু মহলে। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের একাংশের আশঙ্কা, অধিক সংখ্যায় মেডিক্যাল কলেজ হলেও পর্যাপ্ত চিকিৎসক-শিক্ষক পাওয়া কঠিন। তা ছাড়া বেশি মুনাফার লোভে কর্পোরেট মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসার খরচ লাগামছাড়া হতে পারে। এতে সুবিধা পাওয়ার বদলে সাধারণ মানুষ সর্বস্বান্ত হবেন। এটা কি সরকার ভেবে দেখেছে?

দিল্লির মাথারা অবশ্য এমন সম্ভাবনাকে আমল দিচ্ছেন না। মন্ত্রকের যুগ্মসচিব অরুণবাবুর দাবি, ‘‘সে ক্ষেত্রে ওখানে কেউ চিকিৎসা করাতে যাবে না। বেড ফাঁকা পড়ে থাকবে। যেটা এমসিআইয়ের নজরে পড়তে বাধ্য।’’ রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য সন্দিহান। ‘‘কেন্দ্র কী চাইছে, তাতে আদৌ কারও লাভ হবে কিনা, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।’’— বলেছেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন