‘বুড়ো’ হাড়ের ধাক্কা প্রবল! আডবাণীদের পাল্টা আক্রমণে মোদী ব্রিগেড

একটা সময় বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, দলে কংগ্রেসিকরণ শুরু হয়েছে। বাজপেয়ী জমানা থেকেই বিজেপির ‘পার্টি উইদ ডিফারেন্স’-এর ধারণা ক্লিশে হচ্ছে। এ বারে যেন বিজেপির সেই কংগ্রেসিকরণ হওয়ার বৃত্তটি সম্পূর্ণ হতে চলেছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৫ ২০:৫১
Share:

একটা সময় বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, দলে কংগ্রেসিকরণ শুরু হয়েছে। বাজপেয়ী জমানা থেকেই বিজেপির ‘পার্টি উইদ ডিফারেন্স’-এর ধারণা ক্লিশে হচ্ছে। এ বারে যেন বিজেপির সেই কংগ্রেসিকরণ হওয়ার বৃত্তটি সম্পূর্ণ হতে চলেছে।

Advertisement

দেওয়ালির আগের রাতে গতকাল বিহারের বিপর্যয়ের জন্য নাম না করেই নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। দলের চার প্রবীণ নেতা একযোগে বিবৃতি-বোমা ফাটিয়ে বিহারের বিপর্যয়ের জন্য কার্যত মোদী-শাহের একাধিপত্যকেই দায়ী করেছেন। তার জবাব দিতে মোদী-শাহ কাল রাতেই দলের তিন প্রাক্তন সভাপতিকে আসরে নামিয়ে বলেছেন, অটল-আডবাণী জমানাতেও দল হেরেছে। হার-জিতের সামগ্রিক দায়ের রেওয়াজ তাঁদের জমানাতেই শুরু। কিন্তু দলের এই বিক্ষুব্ধ সুরকে অঙ্কুরে বিনাশ করতে আজ রীতিমতো পাল্টা ‘বোম্ববার্ড’ শুরু হল মোদী-শাহের নেতৃত্বে।

আরএসএস থেকে বিজেপিতে আসা নেতা রামমাধব কার্যত আজবাণীদের মন্তব্য ‘দলবিরোধী’ অ্যাখ্যা দেন। তিনি আজ বলেন, ‘‘যাঁরা এ ধরণের মন্তব্য করছেন, তাঁরা কী দলের লাভ করছেন না ক্ষতি? সেটি কি তাঁরা ভেবে দেখবেন না? বিহারের হারের কারণ দল খতিয়ে দেখছে। দলের এই প্রবীণ নেতারা যা বলতে চান, সেটি বলার জন্যও উপযুক্ত মঞ্চও রয়েছে। সেখানে তাঁদের বলা উচিত।’’ আরও একধাপ এগিয়ে প্রাক্তন সভাপতি নিতিন গডকড়ী বলেন, ‘‘অটল বিহারী বাজপেয়ীর সময়ও দল হেরেছে। আমি সভাপতি অমিত শাহকে বলেছি, যাঁরা এ ধরণের মন্তব্য করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’’ যদিও তিনি সরাসরি আডবাণী, মুরলী মনোহর যোশীদের কথা বলেননি।

Advertisement

কিন্তু শুধু বড় নেতাই নন, বিজেপির সাংসদ ভোলা সিংহ ভরত সিংহ আরও চড়া সুরে বলেন, ‘‘লালকৃষ্ণ আডবাণী যদি তাঁর বিবৃতি প্রত্যাহার না করেন, তাহলে তাঁর বাড়ির সামনে বিজেপি সাংসদরা গিয়ে ধর্না দেবেন। নরেন্দ্র মোদীর দৌলতেই আজ বিজেপি এই জায়গায় এসেছে। দিল্লি ও বিহারে পরাজয় হলেও চারটি রাজ্যে দল জিতেছে। স্থানীয় নির্বাচনে জিতেছে। মোদীকে আজ বারাক ওবামা শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। গোটা বিশ্বে ভারতের নাম উজ্জ্বল হয়েছে। সেগুলি কী উপেক্ষা করতে পারেন এই প্রবীণ নেতারা। তাঁদের আমরা সম্মান করি। কিন্তু তাঁদের উচিত এই বিবৃতি প্রত্যাহার করা।’’ ভারত সিংহে দাবি, জনা পঞ্চাশ সাংসদের সঙ্গে তিনি ইতিমধ্যেই কথা বলে ফেলেছেন।

ঠিক এই সংস্কৃতিই দেখা যেত কংগ্রেসে। ইন্দিরা গাঁধী থেকে রাজীব গাঁধী- কংগ্রেসে যখনই কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের রাজনীতি তীব্র হয়েছে, যখনই কোনও বিপর্যয় হয়েছে, বিক্ষুব্ধ কন্ঠস্বর প্রকট হয়েছে, গাঁধী পরিবারের নেতৃত্বকে ছোবল মারার চেষ্টা হয়েছে, সেই সময়ও এ ভাবে পাল্টা বিবৃতি শুরু হত। দলের নেতা থেকে একেবারে ব্লক সভাপতি পর্যন্ত নেতারা এভাবে বিক্ষুব্ধ কন্ঠের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে বিবৃতি দিতেন। প্রণব মুখোপাধ্যায়কে বহিষ্কার করার পর সবথেকে প্রথমে বিবৃতি করেছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তাঁকে আগেভাগে বলে রাখা হয়েছিল।

ঠিক এ বারেও যখন মোদী ও অমিত শাহের বিরুদ্ধে ছোবল মারার চেষ্টা করছেন দলের বিক্ষুব্ধ নেতারা, তখনও তার পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য কাজে লাগানো হচ্ছে ছোট-বড় নেতাদের। এমনকী সেই নেতাদেরও, যাঁরা মানসিক ভাবে নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহের কাছের মানুষ নন। অনেকেই একসময় আডবাণীদের ভক্ত। কিন্তু এখন সেই নেতারাও এই সময়ে মোদী-শাহের সঙ্গ দিচ্ছেন, যেহেতু ক্ষমতার রাশ তাঁদের হাতে। ঠিক এভাবেই যেন এখন বিজেপির কংগ্রেসিকরণের বৃত্তটি এখন পূর্ণ হতে চলেছে মোদী-শাহ জমানায়।

কিন্তু এতেও কি বিতর্কের অবসান হবে?

দলের এক বিক্ষুব্ধ নেতার কথায়, ‘‘এ তো সবে আড়মোড়া ভাঙ্গা হয়েছে। আসল লড়াই তো এখনও বাকি। সবেমাত্র একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। তাতেই কেঁপে উঠেছেন নেতৃত্ব। পাথর যখন ফুটো হয়, তখন এভাবেই চুয়ে চুয়ে জল পড়ে। পুরোটা ভেঙ্গে ফেলতে সময় লাগে। কংগ্রেসের ধস নামতেও সময় নিয়েছিল।’’ বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর নেতাদের মতে, কাল যে বিবৃতি জারি করা হয়েছে, সেটি মুষ্টিমেয় কয়েকজন নেতার বক্তব্য নয়। দলের অনেক নেতা, কর্মীর মনের কথা। এমনকী তাঁদেরও মনের কথা, যাঁরা কাল রাতে বিজেপির পক্ষ থেকে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছেন। রাজনাথ সিংহের মতো নেতারা আডবাণীদের বিরোধিতা করে বিবৃতি করলেও আসলে তাঁরাও একই মনোভাব পোষণ করেন। সুষমা স্বরাজও কৌশলগতভাবে গোটা ঘটনায় নীরব রয়েছেন।

কিন্তু ঘনিষ্ঠ মহলে আডবাণীদের বক্তব্য, এই বিবৃতি শুধুমাত্র বিহার-কেন্দ্রিক নয়। কোনও একটি রাজ্যের হার-জিতের প্রশ্ন নয়। অটল বিহারী বাজপেয়ীর সময়েও বিজেপি হেরেছে। কিন্তু হারের পর বাজপেয়ী অন্তত ইস্তফা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এখন যাঁরা নেতৃত্বে রয়েছেন, তাঁদের সেই মনোভাব গোড়া থেকেই অমিল। এই যে হার হয়েছে, সেটি প্রত্যাশিতও ছিল। এইমূহূর্তে দলে কতিপয় নেতাদের দল চালানোর শৈলীর ফল এটি।

তবে এটিও ঠিক, অনেকদিন ধরে যে উষ্মা, অসন্তোষ দলে দানা বাধছিল, সেটি প্রকাশ করার জন্য আডবাণীরা একটি সুযোগ খুঁজছিলেন। বিজেপি নেতৃত্বের কাছেও এটি অপ্রত্যাশিত ছিল না। তাই গতকালও বিবৃতি প্রকাশের আগে এঁদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা হয়েছিল। আরএসএস নেতা কৃষ্ণগোপাল দেখা করেন দলের প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে। এমনকী সুষমার সঙ্গেও দেখা করেন। কিন্তু এখন বিবৃতি জারি করে এই বিক্ষুব্ধ নেতারা চুপ আছেন। জলটি মাপছেন। মোদী অন্তত আরও চার বছর ক্ষমতায় আছেন। ফলে আরও বড় বিক্ষোভ প্রদর্শনের ঢের সময় রয়েছে।

কিন্তু গোটা বিক্ষোভ পর্বে মোদী ও অমিত শাহরা অন্তত একটি বিষয় বুঝতে পারছেন, প্রবীণদের সংসদীয় বোর্ড থেকে বাদ দিয়ে, সম্পূর্ণ ব্রাত্য করে অসন্তোষের পাহাড় জমছে। যে কোনওদিন এঁরা এ ধরণের বিক্ষুব্ধদের একত্রিত করে দলকেই অস্বস্তিতে ফেলতে পারেন। ফলে এঁদের উপেক্ষা করাটিও সঠিক কৌশল নয়। বরং তাঁদের সঙ্গে নিয়ে চলাই ভালো। বিহার ফল প্রকাশের দিনই ছিল আডবাণীর জন্মদিন। নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ সেদিন সকালে আডবাণীর বাড়িতে গিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু পরোক্ষে এই বার্তাই দিতে চেয়েছিলেন, যেন বিহারে হেরে গেলেও বিক্ষুব্ধ না হন আডবাণীরা। কিন্তু এখন দলের নেতৃত্ব বুঝছেন, বিক্ষুব্ধদের আরও বুঝিয়ে সুঝিয়ে সঙ্গে নিতে হবে।

সে কারণে এখন দ্বিমুখী কৌশল নিচ্ছেন মোদী-শাহরা। একদিকে দলের নেতাদের দিয়ে ‘বোম্ববার্ড’ করা হচ্ছে, আর একদিকে বিক্ষুব্ধদের নিরস্ত্র করারও চেষ্টা করছেন। বিজেপির সংগঠনের নেতা রামলাল কথা বলছেন আডবাণীর সঙ্গে। বিজেপির এক শীর্ষ নেতার মতে, এই যে রাম জেঠমলানী, সুব্রহ্মণ্যম স্বামী, অরুণ শৌরি, গুরুমূর্তির মতো ‘গ্যাঙ্গ-ফোর’-এর নেতারা যাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে নানা সময়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, তাঁরা তো আর বিজেপি বিরোধী নন। যদি রাজনৈতিক ভাবে কট্টর বিরোধী হতেন, তাহলে তার রাজনৈতিক মোকাবিলা করা যায়। কিন্তু এঁরা তো বিজেপিরই বিরোধী নন। ফলে তাঁদের সঙ্গে রাখাই বাঞ্চনীয়। কৌশলগতভাবে তাঁদের বৃত্তের বাইরে রাখার থেকে সঙ্গে রাখাই ভালো রণনীতি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন