এনআরসি নিয়ে শিবির করবে সিপিএম

জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) নিয়ে মানুষের বিভ্রান্তি বাড়ছে। বাড়ছে অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা। কী কী নথি চাই, কোথায় সে সব মিলতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা দিচ্ছে। সামাজিক সংগঠনগুলিও স্পষ্ট ভাবে কিছু বলতে পারছে না। সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাই সমালোচনা করছেন। কিন্তু সরকারের উপর চাপ তৈরির জন্য কোনও কর্মসূচি করা হচ্ছে না।

Advertisement

উত্তম সাহা

শিলচর শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৯
Share:

জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) নিয়ে মানুষের বিভ্রান্তি বাড়ছে। বাড়ছে অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা।

Advertisement

কী কী নথি চাই, কোথায় সে সব মিলতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা দিচ্ছে। সামাজিক সংগঠনগুলিও স্পষ্ট ভাবে কিছু বলতে পারছে না। সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাই সমালোচনা করছেন। কিন্তু সরকারের উপর চাপ তৈরির জন্য কোনও কর্মসূচি করা হচ্ছে না।

সিপিএমের কাছাড় জেলা কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা এ নিয়ে ব্লক পর্যায়ে সচেতনতা সভা করবে। সাধারণ মানুষকে ডেকে এনআরসি-র বিষয়টি কী, কোথা থেকে নথি পেতে পারেন, সে সব বুঝিয়ে বলা হবে। জেলা সম্পাদক তপোজ্যোতি (তাপস) ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সরকার সচেতনতা সভা করতে গাফিলতি করছে। অফিসাররা অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না। এতে সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তা বাড়ছে।’’ একই সঙ্গে তিনি জানান, সরকার যে সব প্রমাণপত্রকে শর্ত হিসেবে ঠিক করেছে, সেগুলি সর্বদলীয় সভাতেই চূড়ান্ত হয়। তাঁরা অনেকে সেখানে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করেছিলেন। কিন্তু সভায় তা মানা হয়নি। কিন্তু সিপিএম সেই দাবি থেকে সরছে না। তাঁদের আর্জি, প্রতিবেশী পাঁচ জন কারও পক্ষে সাক্ষ্য দিলে ভারতীয় আইন মেনেই তা গ্রহণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রেও করা হোক। এ নিয়ে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন সমীরণ আচার্য, রেজামন্দ আলি, চূণীলাল ভট্টাচার্য, সুপ্রিয় ভট্টাচার্যের মত সিপিএম নেতারা।

Advertisement

নাগরিক পঞ্জী তৈরির কাজ সারা দেশে একই সঙ্গে শুরু হওয়ার কথা। প্রশাসন বাড়ি বাড়ি ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করবে— এমনই সিদ্ধান্ত ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের। কিন্তু অসমে নিয়ম আলাদা। অন্য কোনও রাজ্যে শুরু না-হলেও, এখানে এনআরসি তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাড়ি বাড়ি ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করা হবে না। ফর্ম পৌঁছে দেওয়া হবে ঠিকই, তথ্য জমা দিতে হবে নিজেদেরই।

বিভ্রান্তি দূর করতে সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সরকারি অফিসারদের। কিন্তু কাছাড়ে অফিসারদের অনেকেই রয়েছেন ধোঁয়াশায়। অভিযোগ, শালচাপড়ায় একটি শিবিরে জনতার প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি অফিসাররা। শুধু যে সব নথির ভিত্তিতে নাগরিক পঞ্জীতে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে জানানো হয়েছে, সে কথা জানানো ছাড়া তাঁরা কিছু বলতে পারেননি। মানুষ স্পষ্ট জবাব পাচ্ছেন না এনআরসি সেবাকেন্দ্রে গিয়েও। সেখানে কম্পিউটারে ১৯৬৬ ও ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকা রয়েছে। নাম-ঠিকানা বললে আদৌ ওই নামে কেউ তখন ভোট দিয়েছিলেন কি না, তা জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে মিলছে এ সংক্রান্ত শংসাপত্র। তাতেও কম জটিলতা নয়। কম্পিউটারে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে গিয়ে প্রচুর বানান ভুল করা হয়েছে। যুক্তাক্ষর ভেঙে গিয়েছে। বাংলা র-এর জায়গায় অসমিয়া ‘র’ লেখা হয়েছে অনেক জায়গায়। ফলে শুদ্ধ বানান লিখলে কম্পিউটারে জবাব মিলছে না। ভুল বানান যে কী ভাবে লেখা হয়েছে, তা তৃতীয় ব্যক্তির পক্ষে বলা মুশকিল হচ্ছে। ফলে শংসাপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে শুরুতেই আশঙ্কায় ভুগতে হয়।

১৯৭১ সালের আগের যে কোনও ভোটার তালিকায় নিজের বা পূর্বপুরুষের নাম থাকলেই নাগরিক পঞ্জীতে অন্তর্ভুক্ত হবেন— নানা শর্তের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম এটিই। কাছাড়ে শুধু ১৯৬৬ ও ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকারই সন্ধান মিলেছে। এমনকী ১৯৬৬ সালের ভোটার তালিকার অনেক পৃষ্ঠা খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেকগুলি লেখা পড়া যায় না। সেগুলি সরাসরি ছবি তুলে কম্পিউটারে রেখে দেওয়া হয়েছে। কোনও পৃষ্ঠার উপরের দিক নেই, কোনওটির অর্ধেক উধাও। কোথাও শুধু নামের জায়গাটা পোকা খেয়েছে। কিছুই বোঝা যায় না।

সে সব বিষয়ের সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না এনআরসি-র দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলাশাসক এস এন সিংহও। ১৯৬২ সালে কারও পূর্বপুরুষ ভোট দিয়েছিলেন, কেউ নিশ্চিত হলেও কী করে প্রমাণপত্র বের করবেন। ১৯৬৬ সালে যে পৃষ্ঠা খোয়া গিয়েছে, সেই পৃষ্ঠায় কারও ঠাকুর্দার নাম ছিল বলে দাবি করলে কী হবে। ১৯৫১-র নাগরিক পঞ্জীর কথাও শর্তে উল্লেখ রয়েছে। সেই নথিও কাছাড়ে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অতিরিক্ত জেলাশাসক জানান, এত বছর পুরনো নথি পোকামাকড় খেয়ে নেবে সেটাই তো স্বাভাবিক। কিছু হারিয়ে যাবে, কিছু পাওয়া যাবে। সেগুলি নিয়েই কাজ করতে হবে। যে সব নথি সরকারের কাছে নেই, সে-সবও প্রমাণপত্র হিসেবে গ্রহণে আপত্তি নেই।
১৯৬৬-র আগের কোনও ভোটার তালিকার নথি কেউ দেখাতে পারলে, তা গৃহীত হবে।

কিন্তু সরকার যে সব নথি পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও পঞ্চাশ বছর সংরক্ষণ করে রাখতে পারল না, সাধারণ মানুষ কী ভাবে সে সব নথি সুরক্ষিত রাখবে। উত্তর দেননি সিংহবাবু। তাঁর দাবি, সচেতনতা সভা হচ্ছে। সেখানে সমস্ত প্রশ্নের জবাব দেওয়া হচ্ছে।

কংগ্রেস-বিজেপি এই ইস্যুতে পারস্পরিক বিবাদে জড়িয়েছে। বিজেপির বরাক ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নেতাদের মধ্যে মতভেদ স্পষ্ট হচ্ছে। ১৯৫১-কে ভিত্তিবর্ষ ধরার জন্য বিধানসভায় চাপ সৃষ্টি করেন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার দুই বিধায়ক। স্থানীয় নেতৃত্ব পরে সেগুলি দুই বিধায়কের নিজস্ব অভিমত বললেও, এ পর্যন্ত প্রদেশ বিজেপি সভাপতি তেমন কোনও স্পষ্টীকরণ দেননি। কংগ্রেস সাংসদ সুস্মিতা দেব বলেন, ‘‘বিজেপি এ নিয়ে রাজনীতি করছে। তাদের কৌশলই স্পষ্ট নয়। বরাকে এককথা, ব্রহ্মপুত্রে অন্যকথা।’’ তিনি এনআরসি-র বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ জানান।

এ দিকে, বিজেপির বরাক উপত্যকা সমন্বয় রক্ষা কমিটি জানিয়েছে, নাগরিকত্ব নিয়ে বিজেপির অবস্থান স্পষ্ট। বাঙালি হিন্দু বা যাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়ে এ দেশে এসেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব দিতে হবে।

অখিল ভারতীয় অধিবক্তা পরিষদের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সাধারণ সম্পাদক শান্তনু নায়েক দাবি করেন, স্বজন ও বিমলাংশু রায় ফাউন্ডেশন নামে দু’টি সংস্থা বাংলাদেশ থেকে আসা সমস্ত নির্যাতিত হিন্দু বাঙালিদের নাগরিকত্ব চেয়ে আগেই সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিল। গত কাল সেই মামলায় কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতাজ জানিয়েছেন, চার সপ্তাহের মধ্যে সরকার তাদের অবস্থান আদালতে জানাবে। নাগরিকত্ব দিতে সরকারের আগ্রহই এতে প্রতিফলিত হয় বলে দাবি করেন শান্তনুবাবু।

সিপিএমের বক্তব্য, নেহরু-লিয়াকত চুক্তি অনুসারে নির্যাতিত হয়ে আসা ব্যক্তিরা শরণার্থীর স্বীকৃতি পেতেই পারেন, কিন্তু বিজেপি হিন্দু শব্দ ব্যবহার করে দুই সম্প্রদায়ে বিভাজন ঘটাতে চাইছে।

এনআরসি নিয়ে বাঙালিরা আশঙ্কায় ভুগলেও, বরাক উপত্যকার বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ তাঁদের পাশে রয়েছেন। বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের বহুভাষিক সমন্বয় সমিতির সভায় বিষ্ণুপ্রিয়া, মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া, নেপালি, মারোয়াড়ি, ডিমাসা জনগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দ জানিয়ে দিয়েছেন, এ নিয়ে বরাক বঙ্গের যে কোনও পদক্ষেপে তাঁরা সামিল হবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন