১৩-র গেরো আপনাদেরও! বিজেপির খোঁচায় বাম কেরল

লোকে বলে, ঈশ্বরের আপন দেশ। তাই বলে শাসকদের ঈশ্বরে বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই! ঈশ্বর বা আল্লার নামে শপথেরও কোনও বালাই নেই। অথচ সেই শাসকেরই কি না ১৩-র গেরোয় পা জড়িয়ে গেল! শুভ-অশুভের চিরকালীন দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিতে শেষ পর্যন্ত চিঠি লিখতে হল কমিউনিস্ট কেরল সরকারের অর্থমন্ত্রী টমাস আইজ্যাককে!

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৬ ০৪:৪৮
Share:

কেরলের অর্থমন্ত্রী টমাস আইজ্যাক।

লোকে বলে, ঈশ্বরের আপন দেশ। তাই বলে শাসকদের ঈশ্বরে বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই! ঈশ্বর বা আল্লার নামে শপথেরও কোনও বালাই নেই। অথচ সেই শাসকেরই কি না ১৩-র গেরোয় পা জড়িয়ে গেল! শুভ-অশুভের চিরকালীন দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিতে শেষ পর্যন্ত চিঠি লিখতে হল কমিউনিস্ট কেরল সরকারের অর্থমন্ত্রী টমাস আইজ্যাককে!

Advertisement

কমিউনিস্টদের বিরাট জয়ের বাজারে এ বার দক্ষিণী এই রাজ্যে তৃতীয় শক্তি হিসাবে উত্থান ঘটেছে বিজেপির। তারাই এমন প্রশ্ন তুলে বাজার গরম করতে শুরু করেছিল, বিড়ম্বনা বাড়ছিল নতুন মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের! অর্থমন্ত্রীই অনর্থের হাত থেকে তাঁর মুখ্যমন্ত্রী, সরকার ও দলকে রক্ষা করেছেন!

খুলে বলা যাক গল্পটা। বিজয়নের নেতৃত্বে গত বুধবার এলডিএফ মন্ত্রিসভা শপথ নেওয়ার পরেই প্রথা মেনে মন্ত্রীদের জন্য সরকারি গাড়ি বরাদ্দ করা হয়েছিল। কেরলে এই কাজের দায়িত্ব রাজ্য পর্যটন দফতরের। দু’দিন পরে দেখা যায়, মন্ত্রীদের জন্য বরাদ্দ সব গাড়িই যে যাঁর মতো নিয়ে নিয়েছেন। শুধু পড়ে রয়েছে সেই গাড়িটা, যার নম্বর শেষ হচ্ছে ‘১৩’ দিয়ে! কমিউনিস্ট সরকারের মন্ত্রিসভায় আবার ‘আনলাকি থার্টিন’ কী? এই প্রশ্নেই হইচই বাধায় বিজেপি।

Advertisement

সংখ্যা নিয়ে ছুৎমার্গের উদাহরণ এ দেশের রাজনীতি এবং প্রশাসনে অবশ্য ভূরি ভূরি। প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার পরে দিল্লির ৬, কৃষ্ণ মেনন মার্গের বাংলো বরাদ্দ হয়েছিল অটলবিহারী বাজপেয়ীর জন্য। কিন্তু বাজপেয়ীর ৬-এ আপত্তি! শেষ পর্যন্ত ওই রাস্তাতে নতুন এক প্রবেশপথ তৈরি করে ৬ নম্বর বাংলোকে বদলে দেওয়া হয়েছিল ৬এ-তে!

এটা তো তাও বাজপেয়ীর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার। ১৩ নিয়ে কুসংস্কার তো বিশ্বজনীন! এই কলকাতাতেই এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে আছে ১২-র পরে সাড়ে ১২ নম্বর কেবিন। ব্রিটিশদের ১৩-আতঙ্কের প্রতীক হয়ে! গোটা দেশেই রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে আছে এমন কত সংস্কারের চিহ্ন!

বিজেপি বা কংগ্রেস সংখ্যার সংস্কার মানবে, স্বাভাবিক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জ্যোতিষীর পরামর্শে পা ফেলবেন, স্বাভাবিক। তাঁর একগুচ্ছ মন্ত্রী প্রতি সপ্তাহে বারের সঙ্গে রং মিলিয়ে পাঞ্জাবি পরবেন, তা-ও স্বাভাবিক। কিন্তু কমিউনিস্টরা যে মার্গে বিশ্বাস করেন, সেখানে অশুভ ১৩-র প্রভাব নিয়ে ভাবার তো কোনও জায়গা নেই! ঠিক সেখানেই রাজনীতির হুল ফুটিয়েছিল বিজেপি। গেরুয়া শিবিরের নেতা কে সুরেন্দ্রন সটান প্রশ্ন তুলে বসেছিলেন, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ আর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলে বাম নেতারা রাজনীতি করেন। মন্ত্রগুপ্তির শপথ নেওয়ার সময়ে আর পাঁচ জনের মতো ঈশ্বরের নাম নেন না। তা হলে গাড়ির বেলায় রাজনৈতিক তত্ত্বের জায়গায় কি অন্ধ বিশ্বাস চলে এল? কেরলের বাম মন্ত্রীরা ১৩-কে অশুভ মনে করেন কি না, জানার অধিকার তো রাজ্যবাসীর রয়েছে! টুইট করে করে সুরেন্দ্রন দু’দিন ধরে এই আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় থেকেও মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন মুখ খোলেননি। আর সুরেন্দ্রন আরও মজা পেয়ে প্রকাশ কারাট এবং সীতারাম ইয়েচুরির জবাবদিহি পর্যন্ত দাবি করে বসেছেন!

নম্বর-বিধি নিয়ে এই তর্কটা হয়তো সিপিএমে নতুন। তবে ধর্ম নিয়ে অনেক বারই অনেক তর্ক বেধেছে। সে এক কালে দক্ষিণ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান শ্রীহীর ভট্টাচার্যর ষোড়শপচারে পুজো করাই হোক, তারাপীঠে সুভাষ চক্রবর্তীর পুজো দিতে যাওয়াই হোক বা রেজ্জাক মোল্লার হজে যাওয়া। কেরলে এ বার শেষ পর্যন্ত পার্টিকে মুখ খুলতেই হল।

মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন যখন পলিটব্যুরো বৈঠকে যোগ দিতে দিল্লিতে, সেই সময়েই পর্যটন দফতরে চিঠি লিখে ধোঁয়াশা কাটাতে উদ্যোগী হলেন অর্থমন্ত্রী আইজ্যাক। এলডিএফের আগের জমানাতেও আইজ্যাক অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, গত বার তাঁর গাড়ির নম্বরের শেষে

ছিল ২৩। এ বার ১০। সংখ্যা নিয়ে তাঁর কোনও বাছবিচার নেই। ওই পড়ে-থাকা ১৩ নম্বরের গাড়িটা তিনিই নিতে চান। তার বদলে এখনকার গাড়িটা ছেড়ে দেবেন। রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী ভি এস সুনীল কুমারও বিতর্কের মুখে একই দাবি করেছেন। তবে সরকারি সূত্রের খবর, আইজ্যাক লিখিত ভাবে বলায় তাঁর জন্যই বরাদ্দ হতে পারে বিতর্কিত ১৩! আইজ্যাক নিজে বলছেন, ‘‘এটা কোনও ব্যাপারই নয়! অহেতুক জলঘোলা করল কেউ কেউ!’’ বিজেপির সুরেন্দ্রন আবার দাবি করছেন, ‘‘চাপে পড়ে এখন ওঁরা আবার কমিউনিস্ট সাজছেন! প্রথমে তো অন্যদের মতোই শুভ-অশুভ বিচার করছিলেন।’’

কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ঠিক না ভুল, এ সব প্রশ্ন নিয়ে এমনিতেই এখন ব্যতিব্যস্ত সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক। তার মধ্যে তেরোর গেরো আবার তাঁর ঘাড়ে চাপতে বসেছিল। আইজ্যাকের উদ্যোগের কথা জেনে কেরলের এক সতীর্থকে ইয়েচুরি শুধু বলেছেন, ‘‘বাঁচা গেল!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন