অপেক্ষা: এটিএমের বাইরে টাকা তোলার লম্বা লাইন। ভুবনেশ্বরে সোমবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
এটিএমের সামনে লম্বা লাইন। লাইনে কয়েক জন মধ্যবয়সি যুবক দাঁড়িয়ে। তাঁদের মধ্যেই একজন বললেন, ‘‘কী রে, ফণী তো আবার নোটবন্দি করে দিল এখানে!’’
রসিকতা ঠিকই, কিন্তু ওই মন্তব্যের মধ্যেই ফুটে উঠল সোমবারের ভুবনেশ্বর। বছর আড়াই আগের নোটবন্দির স্মৃতি যেখানে ফিরে এসেছে দিনভর। সারা শহরজুড়ে এটিএম বন্ধ। হাতে গোনা যে’কটা এটিএম খোলা রয়েছে, সেখানে লম্বা লাইন। চড়া রোদে লাইনে দাঁড়ানো অনিতা মিশ্র বলছিলেন, ‘‘বাড়ির টাকা ফুরিয়ে আসছে। কবে সব কিছু ঠিক হবে, তা-ও তো কেউ বলতে পারছে না। তাই টাকা তুলে রাখছি।’’ কর্মসূত্রে পারাদ্বীপে যাওয়ার কথা জে ইয়াঙ্কার। গাড়ি ভাড়া করেছেন তিনি। কিন্তু পকেটের টাকা ফুরিয়ে এসেছে! উদ্বিগ্ন জে ইয়াঙ্কা বলছেন, ‘‘অ্যাকাউন্টে টাকা আছে। কিন্তু তাতে লাভ কী! পকেটেই তো টাকা নেই। রাস্তাঘাটে নগদ টাকার প্রয়োজন পড়লে কী হবে, সেটাই তো জানি না!’’
‘ল্যান্ডফল’-এর জন্য পুরীকে বেছে নিয়েছিল ফণী! তারপর থেকে যাত্রাপথে যা-যা কিছু পেয়েছে, ফণী তা গুঁড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। তাই পুরীর মতো ভুবনেশ্বরের রাস্তার দু’ধারে মুহুর্মুহু বিদ্যুতের খুঁটি, গাছ উপড়ে পড়ার একই দৃশ্য। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর তরফে মূল রাস্তা আগে পরিষ্কার করে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তার পরও যে পরিমাণ ধ্বংসচিহ্ন পড়ে থাকছে রাস্তার দু’ধারে, সেটা কবে পরিষ্কার হবে, কেউই জানেন না। যেমন জানেন না পুরীর বাসিন্দারাও। বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, পুরী নিয়ে এত কথা হচ্ছে, সেটা পর্যটনকেন্দ্র বলে। কিন্তু স্থায়ী বাসিন্দাদের বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা হচ্ছে না! অথচ ঝড়ে উপড়ে পড়া ‘পাওয়ার গ্রিড’ ঠিক করতে কত জন কর্মীকে ভিন রাজ্য থেকে আনা হয়েছে, কবে বিদ্যুতের সংযোগ আসবে, কবে জনজীবন স্বাভাবিক হবে, সেটাই এখন একমাত্র আলোচনার বিষয় রাস্তাঘাটে। যে চর্চায় মিশে যাচ্ছে ক্ষোভ, হতাশা, উদ্বেগ।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
ভুবনেশ্বরে অশোকনগরের বাসিন্দা রঘুপতি রাউত বলছিলেন, ‘‘সকলে পুরীর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করছে। ভুবনেশ্বরেও কিন্তু কম ক্ষতি হয়নি। বিদ্যুৎ নেই, এটিএম বন্ধ, পুরো শহরের বেহাল অবস্থা।’’ রঘুপতির পাশে দাঁড়ানো মাধব বেহড়া বললেন, ‘‘পানীয় জলও পাওয়া যাচ্ছে না! বড়-বড় হোটেলগুলো তবু পাম্প চালিয়ে জল তুলছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কী অবস্থা, প্রশাসন সেটা জানে! রাস্তার পাশের কলে দাঁড়িয়ে জল নিতে হচ্ছে। সেটা কত দিন সম্ভব!’’
পুরীর চারনালা, কাশীহরিপুর, কদলীবাড়িপটনা-সহ বিভিন্ন এলাকায় যা দেখা গিয়েছিল, বিপন্নতার সেই একই চিত্র ভুবনেশ্বরের স্বস্তিনগর-সহ একাধিক এলাকায়। স্বস্তিনগরে ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে গিয়েছে মাথার আশ্রয়। সমস্ত পরিবার উপড়ে যাওয়া এক বড় গাছের ছায়াতেই প্লাস্টিক ঘিরে মাথা গোঁজার আশ্রয় তৈরি করেছে। সেই পরিবারের একজন মুন্না বললেন, ‘‘ঝড়ে সব নিয়ে গিয়েছে
আমাদের। এলাকার পাকা বাড়িগুলো তবু বেঁচেছে কয়েকটা। কিন্তু আমাদের ঝুপড়ি কিচ্ছু নেই।’’ হোটেল কর্মী মুন্না সাঁই বলছিলেন, ‘‘অতবড় কলিঙ্গ স্টেডিয়ামই ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে। সেখানে ঝুপড়ি কী ভাবে টিঁকবে!’’
বিমানবন্দরে আসার পথে বিজু পট্টনায়ক পার্ক। বড়-বড় গাছ সমূলে উৎপাটিত। রাস্তার দু’ধারে পড়ে থাকা বড় গাছের ডালগুলো একত্র করে গার্ডরেল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এয়ারপোর্ট সংলগ্ন বাসিন্দা বছর বাইশের মিঠুন মুনি বলেন, ‘‘পুরীর অবস্থা দেখতে এক বন্ধুর সঙ্গে বাইকে চেপে শনিবার গিয়েছিলাম। এরকম পুরী কখনও দেখিনি। ভুবনেশ্বরেরও এরকম অবস্থা এই প্রথম দেখলাম!’’
স্বাভাবিক! ফণী-বিপর্যয় ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে প্রায় এক করে দিয়েছে সমুদ্র-শহর ও ওড়িশার রাজধানীকে!