Cyclone Fani

অনেক আগেই নিখুঁত পূর্বাভাস, সঙ্গে আগাম তৎপরতা, ফণী যে কারণে আয়লা হয়ে উঠতে পারল না

সব মিলিয়ে অন্তত সাত দিন আগে থেকে সতর্কবার্তা দিতে পেরেছে ভারতের কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক আবহাওয়া দফতরগুলি।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৯ ১৭:৩৪
Share:

ফণীর তাণ্ডবে লন্ডভন্ড পুরী। ছবি: পিটিআই

বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি। অনেক আগে আবহাওয়া দফতরের সতর্কবার্তা। সময় হাতে পাওয়ায় আটঘাট বেঁধে প্রস্তুতি। প্রযুক্তি আর মানুষের এই মেলবন্ধনেই এড়ানো গেল ফণীর ভয়াবহ বিপর্যয়।

Advertisement

১৯৯৯ সালে ওড়িশার সুপার সাইক্লোন কিংবা এ রাজ্যে ২০০৯-এর আয়লা যা করতে পেরেছিল, ধারে-ভারে তার চেয়ে কম না হয়েও ততটা দাঁত ফোটাতে পারল না ফণী। প্রাণহানি নামমাত্র। বাড়িঘরের ক্ষয়ক্ষতিও তুলনায় অনেক কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তার প্রধান কারণ আবহবিদ্যায় কার্যত বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

কী ভাবে সেই বিপ্লব ঘটেছে? সেটা জানালেন ভারতের কেন্দ্রীয় জলবায়ু বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্র। তিনি বলেন, ‘‘তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা দেওয়া এবং পরবর্তী পদক্ষেপ, সব ক্ষেত্রেই বহু যোজন এগিয়ে গিয়েছে প্রযুক্তি। সমন্বয় বেড়েছে সব দফতরের মধ্যে। আঞ্চলিক এবং কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরগুলি ডিজিটাইজড হয়েছে। আগে যেখানে মাত্র ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাস দেওয়া হত, এখন সেখানে ৫ দিনের পরে আবহাওয়া কেমন থাকবে তার পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব এবং সেই ভাবেই নিয়মিত আবহাওয়া দফতরের ওয়েবসাইটে দেওয়াও হয়।’’

Advertisement

১৯৯৯ সালের ২৯ অক্টোবর। ওড়িশার উপকূলে আছড়ে পড়েছিল সুপার সাইক্লোন। ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৬০ কিলোমিটার। তখনও দেশভিত্তিক সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়ার প্রচলনও শুরু হয়নি। ভয়াবহ সেই ঝড়ে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার মানুষের। উপকূলে প্রথম আছড়ে পড়েছিল ওড়িশার জগদীশপুরে। শুধুমাত্র জগদীশপুরেই মারা গিয়েছিলেন প্রায় ৮ হাজারজন। এছাড়া দেড় লক্ষেরও বেশি বাড়িঘর ভেঙে পড়েছিল। বিপুল এলাকার কৃষি জমির ফসল চলে গিয়েছিল জলের তলায়।

১৯৯৯-এর সুপার সাইক্লোনে বিধ্বস্ত এক পরিবার। —ফাইল ছবি

এর পর ২০০৯, আয়লা। ২০০৯-এর ২৫ মে প্রথম উপকূলে আঘাত হেনেছিল সাগর দ্বীপে। এ রাজ্যের দুই চব্বিশ পরগনা, কলকাতা এবং বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিবেগের ঘূর্ণিঝড় এবং তার সঙ্গে বিশাল জলোচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায়। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ১৫০ মানুষের। বাংলাদেশ মিলিয়ে মৃত্যু হয়েছিল ৩৩৯ জনের। প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিলেন। এছাড়া কয়েক লক্ষ বাড়িঘর চলে গিয়েছিল জলের তলায়।

আয়লায় ডুবে গিয়েছে বাড়িঘর। তার মধ্যেই আশ্রয়। —ফাইল ছবি

আরও পড়ুন: পুলিশের গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ, হাসপাতালে ভর্তি শান্তনু ঠাকুর, চক্রান্তের অভিযোগ বিজেপির

এই দুই সাইক্লোনের সঙ্গে তুলনা করলে ফণীর ক্ষয়ক্ষতি খুবই সামান্য। এখনও পর্যন্ত ১২ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে ওড়িশায়। পশ্চিমবঙ্গে প্রভাব পড়লেও প্রাণাহানি এখনও পর্যন্ত নেই। কয়েকটি বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। আর আংশিক ক্ষতি হয়েছে ৮০০-র মতো কাঁচা বাড়ির।

কিন্তু কীভাবে রুখে দেওয়া গেল ফণী-বিপর্যয়? মৃত্যুঞ্জয়বাবুর মতে, ‘‘সামগ্রিক সমন্বয় ব্যবস্থার মাধ্যমেই এই বিপর্যয় রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ১৯৯৯-এ মাত্র একটি স্যাটেলাইট ছিল। তার তথ্য বিশ্লেষণ করে ‘ম্যানুয়ালি’ ছবি এঁকে পূর্বাভাস দিতে হত। যা মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম ছিল। কিন্তু এখন কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে বহু সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে যে তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলি সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নির্ভুলের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া কোনও এলাকার আবহাওয়ার গতিবিধি পাঁচ দিন আগে থেকেই এখন জানা যায়। আগে যেটা ছিল মাত্র ২৪ ঘণ্টা। আর সাইক্লোনের ক্ষেত্রে তো দু’সপ্তাহ আগে থেকেই ক্রমাগত পূর্বাভাস দেওয়া হয়।’’

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
আরও পড়ুন: ফণী নিয়ে ভারতীয় আবহাওয়া দফতরের ভূমিকার প্রশংসায় রাষ্ট্রপুঞ্জ

সব মিলিয়ে অন্তত সাত দিন আগে থেকে সতর্কবার্তা দিতে পেরেছে ভারতের কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক আবহাওয়া দফতরগুলি। কিন্তু ১৯৯৯-এর সাইক্লোন ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছিল মাত্র এক দিন আগে। তখন স্মার্ট ফোনও আসেনি। ঘরে ঘরে এসে পৌঁছয়নি টিভি। ফলে আবহাওয়ার খবর জানতে ভরসা ছিল রেডিও এবং দূরদর্শন। কিন্তু সেই দুই মাধ্যমও এত পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে আবহাওয়ার গতিবিধির খবর দিতে পারত না। আয়লার সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল ৭২ ঘণ্টা অর্থাৎ তিন দিন আগে। যদিও তখনও সেই প্রযুক্তি সবে হাঁটি হাঁটি পা পা। কারণ ওই বছর থেকেই প্রথম তিন দিন আগের পূর্বাভাস দিতে শুরু করেছিল আবহাওয়া দফতর। তবে কিছুটা হলেও আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া গিয়েছিল। এই দুই সুপার সাইক্লোনের তুলনায় ফণীর গতিবিধি ছিল আবহবিদদের কার্যত নখদর্পনে। এমনকি, স্মার্ট ফোনের কল্যাণে সাধারণ মানুষেরও হাতের মুঠোয় ছিল তার অভিমুখ, নড়াচড়ার খবর। সাধারণ মানুষও পেয়েছেন প্রতি মুহূর্তের অগ্রগতির খবর, হাওয়ার গতিবেগ, অবস্থান।

আগে থেকে সতর্কবার্তা দেওয়ায় সবচেয়ে বড় সুবিধা হয়েছে উপকূল এলাকার মানুষজনকে সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে। প্রশাসনের সাহায্যে গ্রামের পর গ্রামে কার্যত খালি করে দেওয়া হয়েছে। আশ্রয় দেওয়া হয়েছে সাইক্লোন শেল্টারে বা এমন জায়গায় ঘূর্ণিঝড় এলেও যেখানে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। ওড়িশাতেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রায় ১১ লক্ষ মানুষকে। ফলে পরিকাঠামো এবং প্রাকৃতিক গাছপালা ছাড়া কার্যত কোনও ক্ষয়ক্ষতি করতে পারেনি ফণী। আবার হাতে চার-পাঁচ দিন সময় পাওয়ায় সমুদ্রেও বার্তা পাঠানো সহজ হয়েছে। গভীর সমূদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া মৎস্যজীবীরা উপকূলে ফিরে আসার সময় পেয়েছেন। গভীর সমুদ্রে টানা নজরদারি চালিয়েছে উপকূল রক্ষী বাহিনী। বার্তা উপেক্ষা করে কেউ থেকে গেলেও তাঁদের ফিরিয়ে এনেছেন। ফলে সমুদ্রবক্ষ ছিল কার্যত ফাঁকা। প্রাণহানি হয়নি।

ফণীতে ভেঙেছে বাড়ি ঘর। তার পাশে সন্তান কোলে অসহায় মা। ছবি: পিটিআই

আবহবিজ্ঞান বলছে, নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আছড়ে পড়ার পর যত বেশি স্থলভাগে প্রবেশ করে, তত তাড়াতাড়ি তার শক্তিক্ষয় হতে থাকে। অর্থাৎ স্থলভাগের শুষ্ক বাতাস যত বেশি পাবে, তত তার শক্তি কমতে থাকে। ফণী প্রথম উপকূলভাগে প্রবেশ করে পুরীতে। তার পর ভুবনেশ্বর, কটক, বালেশ্বর হয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে প্রবেশ করে পশ্চিমবঙ্গের খড়্গপুরে। তখন তার শক্তি অনেকটাই কমে আসে। ঝড়ের গতিবেগ ছিল ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার। ফলে ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি। এ ছাড়া হাতে সময় পাওয়ায় ওড়িশার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গও আটঘাট বেঁধে প্রস্তুত ছিল। প্রতি মুহূর্তের অবস্থান বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় পাওয়া গিয়েছে।

কিন্তু আয়লার ক্ষেত্রে বিপদ বাড়ে, কারণ প্রথম উপকূলে প্রবেশই করেছিল এ রাজ্যে। এবং তার প্রভাবও এ রাজ্যেই প্রথম পড়ে। যেটা ফণী এবং ১৯৯৯-এর সুপার সাইক্লোনে হয়েছিল ওড়িশার ক্ষেত্রে। তা ছাড়া আয়লার পরে এ রাজ্যে তৈরি হয়েছিল প্রচুর সাইক্লোন শেল্টার। এ বার ফণীর আশঙ্কায় বহু মানুষকে সেই সব শেল্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

সব মিলিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াইয়ে বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে ফণী-যুদ্ধে অন্তত জয় হয়েছে মানুষেরই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement