আপের চাপ, মোদী তবু সংস্কারেই

বিজলি হাফ! পানি মাফ! জনতাকে এই ‘মিক্সচার’ খাইয়ে নিজে তো মিষ্টিমুখ করে নিলেন অরবিন্দ কেজরীবাল। কিন্তু বেকায়দায় ফেলে দিলেন মোদী সরকারকে! হপ্তাখানেক বাদে সাধারণ বাজেট। কেজরী হাওয়ায় সংস্কারের ‘তেতো পুরিয়া’ এখন নেবে কি আম আদমি? চিন্তায় পড়েছেন বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এবং রাজনাথ-সুষমা-বেঙ্কাইয়ার মতো প্রবীণ বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের ডেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ এই নিয়ে লম্বা বৈঠক করেছেন। তাঁর সচিবালয় সূত্র বলছে, ঝুঁকি নিয়েও সংস্কারের পথে টিকে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ-ও বলেছেন, নানা ধরনের বিপরীত শক্তি বাধা সৃষ্টি করতে চাইবে। কৌশলে সে সব কাটিয়ে এগোতে হবে।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪৫
Share:

অভিনন্দন। রাষ্ট্রপতি ভবনে।—নিজস্ব চিত্র।

বিজলি হাফ! পানি মাফ!

Advertisement

জনতাকে এই ‘মিক্সচার’ খাইয়ে নিজে তো মিষ্টিমুখ করে নিলেন অরবিন্দ কেজরীবাল। কিন্তু বেকায়দায় ফেলে দিলেন মোদী সরকারকে!

হপ্তাখানেক বাদে সাধারণ বাজেট। কেজরী হাওয়ায় সংস্কারের ‘তেতো পুরিয়া’ এখন নেবে কি আম আদমি? চিন্তায় পড়েছেন বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব।

Advertisement

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এবং রাজনাথ-সুষমা-বেঙ্কাইয়ার মতো প্রবীণ বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের ডেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ এই নিয়ে লম্বা বৈঠক করেছেন। তাঁর সচিবালয় সূত্র বলছে, ঝুঁকি নিয়েও সংস্কারের পথে টিকে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ-ও বলেছেন, নানা ধরনের বিপরীত শক্তি বাধা সৃষ্টি করতে চাইবে। কৌশলে সে সব কাটিয়ে এগোতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই প্রত্যয়টাই আশা করছিল শিল্পমহল এবং শহুরে শিক্ষিত সমাজের একটা বড় অংশ। তাঁদের বরং ভয় কেজরীবালের মতো শক্তিকেই। তাই বুথ ফেরত সমীক্ষায় কেজরীবালের জয়ের সম্ভাবনা দেখেই শেয়ার বাজার চারশো পয়েন্ট পড়ে গিয়েছিল। শিল্পমহল চায়, আরও উদারীকরণের পথে হাঁটুক সরকার। শিল্পস্থাপন ও বিনিয়োগের পথ সহজ হোক। কেজরীর ভয়ে পিছিয়ে গেলে ভুল হবে বলেই শিল্পমহলের মত। তারা বলছে, মজবুত পদক্ষেপে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাওয়াই দিল্লির পরাজয় ঝেড়ে ফেলার উপযুক্ত হাতিয়ার।

এবং দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতিদের বড় অংশের দৃঢ় বিশ্বাস, মোদী সেই পথেই হাঁটবেন। যেমনটা তিনি করেছেন ক্ষমতায় আসার পরে গত ন’মাসে। বিরোধীদের বাধায় সংসদ অচল থাকলেও মোদীর সাহসী সিদ্ধান্তে সংস্কার থমকে থাকেনি। অর্ডিন্যান্স জারি করে বিমায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির পথ প্রসারিত করেছেন, কয়লা খনি নতুন করে বণ্টনের ব্যবস্থা করেছেন, শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের জট ছাড়াতে সংশ্লিষ্ট আইনে সংশোধন এনেছেন। ন’মাসে আট-আটটি অর্ডিন্যান্স জারি করার জন্য বিরোধীরা তাঁর সরকারকে ‘অর্ডিন্যান্স কারখানা’ বলে সমালোচনা করলেও মোদী ডরাননি।

মজার বিষয়, শিল্পমহল তবুও অসহিষ্ণু। তারা আরও চাপ বাড়াচ্ছে। বলছে, হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আরও করতে হবে। আবার দৈনন্দিন সমস্যার সুরাহার জন্য অসহিষ্ণু সাধারণ মানুষও। তারা চায়, কাল নয় আজই গৃহঋণে সুদ কমুক। খাদ্যশস্যের দাম কমুক। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা তেলের দাম কমার সুযোগে সরকার উৎপাদন শুল্ক বাড়িয়ে যে কিছুটা আর্থিক ঘাটতি কমিয়ে ফেলতে চায়, তাতেও তাদের অভিমান!

তা হলে কার কথা শুনবে সরকার? ভারসাম্য রাখাটা কিন্তু কঠিন।

কেজরীবাল যে অর্থনৈতিক দর্শনের কথা বলছেন, তা লোকসভা ভোটের সময়েই খারিজ করে দিয়েছিলেন অর্থনীতির অনেক পণ্ডিত। তাঁদের মত ছিল, সরকারের টাকা জনকল্যাণের জন্য ঠিকই। কিন্তু সেখানে অন্ধ খয়রাতির কোনও স্থান নেই। আইআইটি খড়্গপুরের মেধাবী ছাত্র কেজরীবাল তা বোঝেন না, এমন হয়তো নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব বিভাগের আমলা ছিলেন। কিন্তু এখন আম আদমি পার্টি যাতে রাতারাতি মোক্ষলাভ করতে পারে, তাই ভর্তুকির তত্ত্বকেই সামনে রেখেছেন তিনি।ছাপোষা মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরে বিদ্যুতের মাসুল অর্ধেক করে দেওয়া বা মাসে বিশ হাজার লিটার জল নিখরচায় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এগুলো কার্যকরী করতে হলে সরকারকে ভর্তুকির পথেই হাঁটতে হবে। তার জন্য রাজস্ব বাবদ আয় বাড়াতে হবে। অথচ দিল্লি এতটাই ছোট একটি এলাকা, যে সেখানে এক লাফে রাজস্ব বাড়ানোর সুযোগ সীমিত। ফলে কেন্দ্রের উপর নির্ভর করা বা অন্য উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে বরাদ্দ ছাঁটা ছাড়া উপায় নেই।

বিজেপি নেতারা বলছেন, রাজ্যস্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়ললিতা, অতীতে বামেরাও পপুলিজমের পথে হেঁটেছেন। বিশেষ করে পপুলিজমের প্রতিযোগিতা দক্ষিণের রাজনীতিতে এখন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে কেন্দ্রে ‘বড়দি’ হয়ে এর বৃক্ষরোপণটি করেছিলেন সনিয়া গাঁধী। ‘জাতীয় উন্নয়ন পর্ষদ’ নাম দিয়ে আদতে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। নেহরুর সমাজতন্ত্রের নামে, গ্রামের মানুষের দারিদ্র দূরীকরণের নামে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করেছিলেন বাজেটে। প্রণব মুখোপাধ্যায়-চিদম্বরমরা নিমরাজি হয়েও এই বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হন।

দিল্লিতে এ বার কংগ্রেসকে সাফ করে দিয়েছে আপ। কিন্তু সনিয়ার সেই মতাদর্শের অবলুপ্তি ঘটেনি। রিলে দৌড়ের সেই ব্যাটন এখন হাতে তুলে নিয়েছেন কেজরীবাল।

এই অবস্থায় বিজেপির কিছু নেতা মনে করছেন, বাজেটে কঠোর দাওয়াই দিতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। বিজেপি নেতা বিজয় গোয়েল যেমন মজা করে বলছেন, “কেজরীবালকে ঠেকাতে গেলে এখন দেখছি সব ফ্রি করে দিতে হবে। কে জানে হয়তো সেটাই বাঁচার পথ!” মোদী নিজে বা অর্থমন্ত্রী জেটলি অবশ্য এতটা মনে করেন না। যে কারণে, আজকের বৈঠকে মোদী সংস্কারের পথে এগোনোর দিকেই মত দিয়েছেন। তবে রাজনৈতিক বাস্তবতার কথা মাথায় রেখে জনমোহিনী নীতির সঙ্গে খানিকটা ভারসাম্য রাখার কথাও ভাবতে হচ্ছে বটে।

সমস্যা হল, গত বছর বাজেটেও অরুণ জেটলি আর্থিক বৃদ্ধির লক্ষ্যে যথেষ্ট দৃঢ় পদক্ষেপ করতে পারেননি। এ বার বাজেটের আগেও তিনি শিল্পপতি, শ্রমিক সংগঠন, ব্যাঙ্ক ও বিমা, কৃষক, ভূস্বামী প্রতিনিধিদলের আশা-আকাঙ্খার কথা শুনেছেন। বিশেষজ্ঞরা শুধু সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, অর্থমন্ত্রী সবাইকে খুশি করতে গিয়ে যেন হরির লুঠ শুরু না করেন! তাতে কিন্তু বৃদ্ধির ইঞ্জিন থমকে যাবে। জাতীয় অর্থনীতি ফের দিশাহীন হয়ে পড়বে। বরং ভর্তুকি আরও কমাতে হবে। স্বচ্ছল অংশের জন্য ভর্তুকি মূল্যে রান্নার গ্যাস সরবরাহ কমাতে হবে, সামাজিক প্রকল্পে এমন ভাবে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে, যা স্থায়ী সম্পদ তৈরি করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের চার বছরেরও বেশি মেয়াদ এখনও বাকি। প্রথম তিন বছরই কঠোর পদক্ষেপ করার সময়। দীর্ঘমেয়াদে তাতে আম আদমিরই সুরাহা হবে।

কিন্তু শুধু দল তো নয়, মোদী-জেটলির সামনে বড় ‘হার্ডল’ সঙ্ঘ পরিবারও। অতীতে বাজপেয়ী জমানায় অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা বিমা, টেলিকম ও ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ করতে গিয়ে সঙ্ঘের রোষে পড়েছিলেন। তখনকার স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের নেতা মুরলীধর রাও বর্তমানে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক। অটল জমানায় তিনি রোজ সাংবাদিক বৈঠক করে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। বিজেপি তখন কেন্দ্রে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না। বিরোধিতায় শরিকরাও সক্রিয় ছিলেন। এ বারে সে ঝামেলা নেই। জবরদস্ত প্রশাসক হয়ে মোদী সংস্কারের বাধা কাটাতে পারবেন কিনা, সেটাই প্রশ্ন! সূত্রের খবর, বিজেপির কিছু নেতা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, জমি অধিগ্রহণ নীতি বদলের কারণেই সম্ভবত বাহারি দিল্লিতে জাঠ-কৃষক এলাকায় দল খারাপ ফল করেছে। কিন্তু মোদী-জেটলি সেই যুক্তি মানতে চাননি।

বাজেটের আগে সরকার ও দলের মধ্যে এই মত চালাচালির উপরেই এখন নজর বণিক মহলের। তাঁদের কারও কারও ধারণা ছিল, মোদী সরকার হয়তো বা মার্কিন রিপাবলিকান দলের মতো সরাসরি দক্ষিণপন্থী সংস্কারের মোড় নেবে! সে প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী শুধু বলছেন, “ভিন দেশের কোনও একটি রাজনৈতিক দলের অনুকরণ করা আমাদের কাজ নয়। ভারতের মানুষের স্বার্থরক্ষা করেই ধাপে ধাপে এগোতে চাইছি। ভারসাম্য হারিয়ে যাবে না বলেই আশা করছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন