টাকার খোঁজে। বৌবাজারে একটি এটিএমের সামনে। শুক্রবার দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।
মাস পয়লা কেটেছে হাহাকারে। দ্বিতীয় দিনেও পরিস্থিতির বিশেষ রদবদল হলো না— কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর ঈষৎ সুর বদল ছাড়া। অরুণ জেটলি গত কাল বলেছিলেন, নোট বাতিলের জেরে ভোগান্তি সইতে হবে তিন থেকে ছ’মাস। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, তা হলে খোদ প্রধানমন্ত্রী যে বলেছিলেন এই কষ্ট ৫০ দিনের জন্য। তিনি তো দেশবাসীর কাছ থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়ে নিয়েছিলেন! যেন প্রধানমন্ত্রীর মান রাখতেই জেটলি আজ বললেন, ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন নোটের জোগান অনেকটাই বেড়ে যাবে বাজারে। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর সতর্কবাণী, ৮ নভেম্বর বাজারে যে পরিমাণ নগদ ছিল, সেই অঙ্ক কিন্তু ছোঁয়া যাবে না চলতি মাসের শেষে। ফারাক থাকবেই। এবং সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, সেটা অনেকটাই।
এ তো গেল অর্থনীতির কথা। নোট নাকচকে হাতিয়ার করে রাজনীতির ফসল কুড়োতে যারা মাঠে নেমেছে, সেই বিজেপি-ও এখন আর বুক ঠুকে বলতে পারছে না— ‘আল ইজ ওয়েল’। খোদ বিজেপি সভাপতি, তথা নরেন্দ্র মোদীর বিশ্বস্ততম সেনাপতি অমিত শাহও আজ পরোক্ষে কবুল করলেন যে, নোট বাতিলের ধাক্কা আরও বেশ কয়েক মাস পোহাতে হবে। এমনকী, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ আর্থিক বৃদ্ধি কমে যাওয়ার যে আশঙ্কা করেছেন, সেটাও উড়িয়ে দেননি অমিত শাহ।
বাজারের দিকে তাকালে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার কোনও উপায়ও নেই। গত প্রায় এক মাসের মতো আজও দেশের সর্বত্র ব্যাঙ্ক এবং এটিএমের সামনে হা-পিত্যেশ অপেক্ষা। বস্তুত, টাকার আশায় লাইনে দাঁড়ানো এখন ভারতবাসীর নিত্যকর্মে পরিণত হয়েছে। রুটিন হয়ে গিয়েছে হতাশ হয়ে ফিরে আসাও। কলকাতা-সহ রাজ্যের বহু জায়গায় এ দিন ঝাঁপ নামানো ছিল এটিএমের। ব্যাঙ্কে হত্যে দিয়েও বিশেষ লাভ হয়নি। এক সপ্তাহে টাকা তোলার সর্বোচ্চ যে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, ততটা নগদ প্রায় কোনও ব্যাঙ্কই দিতে পারেনি। তার উপর ৫০০ ও ১০০ টাকার নোট প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে দু’হাজার টাকার নোট হাতে পেয়েও দুশ্চিন্তা মেটেনি আমজনতার। এত বড় নোট ভাঙিয়ে দেবে কে!
তবু যাঁরা হাতে টাকা পেয়েছেন, তাঁরা নিজেদের ভাগ্যবান বলেই ভাবতে পারেন। কেননা, তিন-চার ঘণ্টা ব্যাঙ্কে লাইন দিয়েও বিফলমনোরথ হয়ে ফিরতে হয়েছে অনেককে। টাকা শেষ। টাকার জোগান কবে স্বাভাবিক হবে তা স্পষ্ট করে জানাতে পারছেন না অর্থ মন্ত্রকের কর্তারাও। আর্থিক বিষয়ক সচিব শক্তিকান্ত দাসের অবশ্য দাবি, বাজারে নগদের জোগান আগের থেকে অনেক বেশি। নতুন ৫০০ টাকার নোট বাজারে আসতে শুরু করেছে। ফলে পরিস্থিতি খুব শীঘ্রই শোধরাবে।
কিন্তু নগদের এই অভাবের ফলে অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তা আজ ফের মেনে নিয়েছেন জেটলি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বদলের সময় একটা তছনছ অবস্থা তৈরি হয়। কিন্তু এই অবস্থা বেশি দিন থাকবে বলে আমি মনে করি না। তিন মাসের মধ্যেই বদলটা বোঝা যাবে। কিন্তু গত সাত দশক ধরে কালো টাকাই স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নোট বাতিলের ফলে কালো টাকার মোকাবিলাই এখন নতুন নিয়ম হবে।’’
যদিও এই তছনছ অবস্থার শেষে কালো টাকা শায়েস্তা হবে, এমনটা মনে করছেন না নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান। আজ দিল্লিতে তিনি বলেন, ‘‘লক্ষ্যটা আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু তা পূরণের চেষ্টাটা খুবই অস্থিরতায় মোড়া। এবং শেষ পর্যন্ত তাতে কোনও কাজ হবে বলেও মনে করি না। যাঁদের কালো টাকা আছে, তাঁরা সেটা রক্ষা করার ব্যাপারে আরও সাবধানী হবেন।’’
সতীর্থদের সুর যতই অন্য হোক বা সমালোচকদের সুর কড়া—প্রধানমন্ত্রী কিন্তু দাবি করছেন, তাঁর দাওয়াইয়ে কাজ হবেই এবং সে জন্য যাবতীয় অসুবিধা মানুষ খুশি মনেই মেনে নিচ্ছেন। একটি সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে তিনি লিখেছেন, ‘‘নোট বাতিলের কথা ঘোষণা করার সময় আমি জানতাম, কিছু অসুবিধা হবে। দীর্ঘমেয়াদি লাভের জন্য এই স্বল্প সময়ের অসুবিধা মেনে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। আমি খুশি যে দেশবাসী তা মেনে নিয়েছেন।’’
বস্তুত, অচ্ছে দিনের আশা দেখিয়েই নোট নাকচ ঘিরে আমজনতার বিরূপ মনোভাব জয় করতে চাইছে বিজেপি। এ দিন এবিপি নিউজের এক অনুষ্ঠানে জিডিপি কমার আশঙ্কা প্রসঙ্গে প্রশ্নের উত্তরে অমিত শাহ বলেন, তিনি মনমোহন সিংহের মতো ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নন। তবে আর্থিক বৃদ্ধি যদি কিছুটা কমেও যায়, পরে সেটি বাড়িয়ে নেবে মোদী সরকার।