প্রত্যেক বছরই এমন হয়।
কাছে-দূরের গ্রাম ও শহরগুলো যখন আলোয় আলোয় ঝলমল করতে থাকে, প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসে ঢাকের আওয়াজ আর নবরাত্রির গান, নতুন জামা-জুতোয় শহুরে মানুষগুলো যখন উৎসবে মাতে— তখন ঝাড়খণ্ডের ঘাগরা, চৈনপুর, বিষণপুর গ্রাম ডুব দেয় শ্মশানের নৈঃশব্দে।
ঘরে ঘরে জানলা-দরজা বন্ধ থাকে পুজোর চার দিন। যাতে আলোর রোশনাই তো দূর, ঢাকের আওয়াজটাও ভুল করে ঢুকে না পড়ে!
এগুলো অসুরদের গ্রাম। অসুর সম্প্রদায়ের গ্রাম।
গ্রামবাসীদের পদবিও ‘অসুর’। বিমল অসুর, সুমন অসুর, সুকৃতি অসুর। যাঁরা বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা না করে বাঙালি সাংবাদিককে জানিয়ে দেন, দুর্গাপুজো তাঁদের কাছে পুজো নয়— হত্যাকাণ্ড। তাঁদের ‘পূর্বপুরুষ’ মহিষাসুরের হত্যা ঘিরে উৎসবে কেন সামিল হবেন তাঁরা?
বিমল-সুমল-সুকৃতিরা তাই ঢাক শুনলে কানে হাত দেন। চৈনপুর গ্রামের বিমল বললেন, ‘‘আগে তো নবরাত্রি উৎসবের ন’দিন টানা আমাদের গ্রামে শোকগাথা পাঠ করা হতো। আমরা সাদা থান পরে থাকতাম। মেয়েরা সাদা শাড়ি পরত। এখন সময় পাল্টেছে। সাদা কাপড় পরা বা শোকগাথা পাঠ হয় না। তবে দুর্গাপুজোর সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই।’’ আর এক গ্রামবাসী সুমতি অসুরের কথায়, ‘‘এই উৎসব আমাদের পূর্বপুরুষকে অপমান করার সামিল। মানুষকে হত্যা করা কোনও উৎসব হতে পারে না।’’
রাঁচি থেকে মোটামুটি ৯০ কিলোমিটার এগোলে গুমলা শহর। তারই কিছু দূরে পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা তিন গ্রাম। ঘাগরা, চৈনপুর, বিষণপুরের মতো ঝাড়খণ্ডের লোহারডাগা ও পলামু জেলার কিছু গ্রামেও অসুর সম্প্রদায়ের বাস। শুধু মহিষাসুর বধ নয়, পুজোর পরে দশেরায় রাবন বধও মেনে নিতে পারেন না ওঁরা। গুমলার ঘাগরা গ্রামের বিনয় অসুরের কথায়, ‘‘আমরা এখনও দশেরাতে শোক পালন করি। দুর্গাকে বহিরাগত বলে মনে করি আমরা। বরং মহিষাসুর বা রাবণ আমাদের কাছে অনেক কাছের মানুষ।’’ মনে করিয়ে দেওয়া যাক, ২০০৮-এ এক রামলীলা উৎসবে গিয়ে রাবণের মূর্তি জ্বালানোর বিরোধিতা করেছিলেন খোদ শিবু সোরেন। ঝাড়খণ্ডের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, রাবণকে ‘কুলগুরু’ ও বীরত্বের প্রতীক বলে মনে করেন তিনি।
কথা হচ্ছিল ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী গবেষণা কেন্দ্রের অধিকর্তা এইচ এস গুপ্তর সঙ্গে। প্রসঙ্গ উঠতে বললেন, ‘‘এই অসুর জাতি কিন্তু ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী নয়। এঁরা মূলত এসেছেন মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ় থেকে। বহু প্রাচীন কাল থেকেই ওঁদের পেশা হল লোহার নানা জিনিস তৈরি করা।’’ অসুরদের গ্রামে গিয়ে তাঁদের জীবনযাত্রা চাক্ষুস দেখার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন গুপ্ত। যার মধ্যে অবধারিত ভাবেই ঢুকে পড়ল তাঁদের দুর্গাপুজো ‘গণ-বয়কট’ করার কথাও।
এখন অবশ্য সেই জীবনযাত্রায় অনেক বদল এসেছে। লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। পূর্বপুরুষদের ধারা বজায় রেখে কেউ কেউ এখনও লোহার কাজ করেন ঠিকই, কিন্তু ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠাতেও ভোলেন না।
প্রাচীন জনজাতি নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত হয়েছেন এই সম্প্রদায়ের অনেকে। তেমনই এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী সুষমা অসুর জানালেন, ‘অসুর নিধনের উৎসব’-এর বিরোধিতা করে তাঁরা একটি মঞ্চ তৈরি করেছেন। তৈরি হয়েছে ফেসবুক পেজ। সেখানে তাঁরা সমস্বরে জানাচ্ছেন,
‘‘আমরা অসুর সম্প্রদায় আমাদের পূর্বপুরুষের এই হত্যার উৎসবের বিরোধিতা করছি।’’
ইতিহাস ঘেঁটে পণ্ডিতেরা খুঁজে চলেন অসুর-গ্রামের ক্ষোভের নেপথ্যে ‘আর্য-অনার্যে’র জটিল তত্ত্ব। ফেসবুক পেজের বয়স বাড়ে।
আর আশ্বিনের শারদপ্রাতে বিষাদ নামে ইতিউতি গ্রাম জুড়ে!