ছিটকে গেল রাজধানী, মৃত চার যাত্রী

নয়াদিল্লি-ডিব্রুগড় রাজধানী এক্সপ্রেস তখন ছপরা স্টেশনে দাঁড়িয়ে। ঘড়ির কাঁটায় রাত দু’টো বাজতে দশ। গভীর ঘুমে অধিকাংশ যাত্রীই। ঘুমভাঙা দু’এক জন নিতান্ত কৌতূহলে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখছেন কোন স্টেশন এল। ছপরায় তো দাঁড়ানোর কথা নয়! তবে? রেলের কর্মীদের কাছেই গুয়াহাটির প্রমোদ শর্মা শুনলেন, এখান থেকে ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরে অন্য এক লাইনে বিস্ফোরণের ফলে একটা মালগাড়ি বেলাইন হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

ছপরা ও গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৪ ০২:৫১
Share:

ছপরার কাছে লাইনচ্যুত রাজধানী। চলছে উদ্ধারকাজ। বুধবার। ছবি: পিটিআই।

নয়াদিল্লি-ডিব্রুগড় রাজধানী এক্সপ্রেস তখন ছপরা স্টেশনে দাঁড়িয়ে। ঘড়ির কাঁটায় রাত দু’টো বাজতে দশ। গভীর ঘুমে অধিকাংশ যাত্রীই। ঘুমভাঙা দু’এক জন নিতান্ত কৌতূহলে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখছেন কোন স্টেশন এল। ছপরায় তো দাঁড়ানোর কথা নয়! তবে?

Advertisement

রেলের কর্মীদের কাছেই গুয়াহাটির প্রমোদ শর্মা শুনলেন, এখান থেকে ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরে অন্য এক লাইনে বিস্ফোরণের ফলে একটা মালগাড়ি বেলাইন হয়ে গিয়েছে। এই এলাকায় নাকি মাওবাদীদের বন্ধ চলছে। সুতরাং বাকি রাত ট্রেন ছপরায় দাঁড়িয়েও থাকতে পারে। দিল্লিতে ছেলের বাড়ি থেকে সস্ত্রীক প্রমোদবাবু ফিরছিলেন গুয়াহাটির শিলপুখুরিতে নিজের বাড়িতে। ফোনে জানালেন, “এর পর দেখলাম, ট্রেন ছেড়ে দিল। গতিও বেশি ছিল না। মিনিট পনেরো পরেই শুনি বিরাট জোরে আওয়াজ। কামরার মধ্যে যেন ভূমিকম্প শুরু হল। এ ওর ঘাড়ে, ওর ব্যাগ এর মাথায়।”

নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে ট্রেনটাই তখন ছিটকে পড়ছে লাইন থেকে।

Advertisement

মঙ্গলবার রাতে ছপরার অদূরে কাছারি ও গোল্ডেন নগর স্টেশনের মাঝখানে এই দুর্ঘটনায় নয়াদিল্লি-ডিব্রুগড় রাজধানীর ৪ যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। রেল জানিয়েছে, নয়ানজুলিতে উল্টে যাওয়া কামরা থেকে তিন জন যাত্রীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর মৃত্যু হয় উত্তরপ্রদেশের পিলিভিটের বাঙালি কলোনির বাসিন্দা শেফালি দে-র (৬৫)। জখম অন্তত ২৩। তাঁদের মধ্যে পটনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ১৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

প্রাথমিক ভাবে রেলমন্ত্রী সদানন্দ গৌড়া থেকে শুরু করে কেন্দ্রের যাবতীয় প্রতিনিধি এই দুর্ঘটনার জন্য মাওবাদী নাশকতাকে দায়ী করলেও পরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেন, “কেন দুর্ঘটনা ঘটল তার কারণ সম্পর্কে এখনই কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত রেলের অফিসারদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছি। তদন্ত রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি।” এমনকী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও এত তড়িঘড়ি মাওবাদীদের দায়ী করার পক্ষপাতী নন বলে রাজনাথ জানান। অন্য দিকে, সংশ্লিষ্ট জেলা, সারণের জেলাশাসক থেকে শুরু করে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী জিতনরাম মাঁজি-ও বলেছেন, এই ঘটনার পিছনে নাশকতা নেই বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছেন তাঁরা।

দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য চাপানউতোর চললেও উদ্ধারকাজে কিন্তু রেল ও জেলা প্রশাসন হাতে হাত মিলিয়েই কাজ করেছে। মৃতদেহ উদ্ধার করা, জখমদের হাসপাতালে পাঠানো থেকে শুরু করে বহু যাত্রীকে পটনায় নিয়ে এসে সেখান থেকে গন্তব্যে রওনা করিয়ে দেওয়া, সবই হয়েছে খুব দ্রুত। সারণের জেলাশাসক কুন্দন কুমার, শোনপুরের ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার দাঁড়িয়ে থেকে উদ্ধারকাজ তদারক করেন। আশপাশের গ্রামের বহু মানুষও হাত লাগান। ভোর চারটে নাগাদ ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে যান সারণের সদ্য বিজয়ী সাংসদ তথা বিজেপি নেতা রাজীবপ্রতাপ রুডি। উদ্ধারকাজে নেমে পড়েন স্থানীয় বিজেপি কর্মী এবং আরএসএসের সদস্যরাও। কার্যত সকাল ৬টার মধ্যে উদ্ধারকাজ প্রায় শেষ হয়ে যায়।

দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনটির প্যান্ট্রি কারের কর্মী শিবম সিংহ বলেন, “কামরাটা জোরে জোরে দুলছিল। সমস্ত জিনিস, বাসনকোসন ছিটকে পড়ল। চাকার সঙ্গে লাইনের পাথরের ঘষটানির আওয়াজ পাচ্ছিলাম। আলোও নিভে গেল।” কিছুক্ষণ মাটিতে ঘষটে চলে কামরাটা থামার পর জানলা দিয়ে উঁকি দেন শিবম। ঘষা কাচের জানালা দিয়ে অন্ধকারে দৃষ্টি চলছিল না। তখন সাহস করে দরজা খুলে দেখেন, আশপাশ ধুলোয় ভরে গিয়েছে।

ঘটনাস্থলের খুব কাছেই বিষণপুরা গ্রাম। সেখানকার বাসিন্দা শ্যাম কুমারের কথায়, “প্রচণ্ড একটা শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙে। আলো নিয়ে রেল লাইনের দিকে ছুটে আসি। যাত্রীদের সকলেই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। ওঁদের এক এক করে লাইনের পাশে নিয়ে গিয়ে বসানো হয়।” দিনের আলো ফুটতে দেখা যায়, লাইনের কাছে-দূরে অনেকটা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ভারতের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনের ইঞ্জিন, প্যান্ট্রি কার এবং ১২টা কামরা। তার মধ্যে চারটে কামরা উল্টে গিয়েছে নয়ানজুলিতে। সেগুলোরই একটায় উঠে দেখা গেল, চারপাশে পড়ে রয়েছে বালিশ-কম্বল। কামরায় আরও কেউ আটকে রয়েছেন কি না, তখনও খুঁজে দেখছিল উদ্ধারকারী দল।

রেল জানিয়েছে, দুর্ঘটনায় মৃতদের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপুরণ দেওয়া হবে। গুরুতর আহতরা পাবেন ১ লক্ষ। সামান্য আহত যাত্রীদেরও ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো যাত্রীদের পরিবারের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করেছে বিহার সরকার। মুখ্যমন্ত্রী জিতনরাম বলেন, “সাধারণ ভাবে রেল দুর্ঘটনায় মৃতের পরিজনকে ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।

এ নিয়ে রেলমন্ত্রীর সঙ্গে কথাও বলেছি।” কেন্দ্রের কাছে একই অনুরোধ করেছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ-ও।

পূর্ব-মধ্য রেলের জেনারেল ম্যানেজার মধুরেশ কুমার জানান, শুক্রবার থেকে রেলের সুরক্ষা কমিশনার পি কে বাজপেয়ী ঘটনার তদন্ত শুরু করবেন। তিনিসুকিয়ার অতিরিক্ত ডিভিশনাল ম্যানেজার সীতু সিংহ হাজং জানান, আটকে পড়া অসমের যাত্রীদের আনার জন্য একটি বিশেষ ট্রেন পটনা থেকে রওনা হয়েছে। আগামী কাল সেটি ডিব্রুগড়ে পৌঁছবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন