কতবার গাইলে তবে গান হয় গান

শহর শিলচরের গানের ভাবনায় বিরাট পরিবর্তন এনেছে ‘দলছুট’। পুরনো ভাবনাচিন্তার জায়গাটাকে পুরো উল্টেপাল্টে দিয়েছে ওরা। এবং সে কারণেই তাদের অনুষ্ঠানগুলি হয়ে ওঠে চিন্তার ফসল। আর সেই সূত্রে একটা সঙ্গীত-সচেতনতাও গড়ে উঠছে। শহর শিলচর আগে এমনটা দেখেনি।

Advertisement

বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

শিলচর শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৬ ০৩:১১
Share:

‘দলছুট’-এর সদস্যরা। — নিজস্ব চিত্র।

শহর শিলচরের গানের ভাবনায় বিরাট পরিবর্তন এনেছে ‘দলছুট’। পুরনো ভাবনাচিন্তার জায়গাটাকে পুরো উল্টেপাল্টে দিয়েছে ওরা। এবং সে কারণেই তাদের অনুষ্ঠানগুলি হয়ে ওঠে চিন্তার ফসল। আর সেই সূত্রে একটা সঙ্গীত-সচেতনতাও গড়ে উঠছে। শহর শিলচর আগে এমনটা দেখেনি।

Advertisement

অনেকদিন হল মানুষের কাছে পৌঁছনোর মত গান আমরা খুঁজে পাচ্ছিলাম না! ‘দলছুট’ সেই অভাব পূরণে তৎপর হয়েছে। সে জন্যই এরা অনুষ্ঠানে গাইতে থাকা গান মাঝখানে থামিয়ে দিলেও আমাদের খারাপ লাগে না। বিশ্ব সঙ্গীত দিবস উপলক্ষে তিনদিনের কর্মসূচিতে রবিবার ছিল দলছুটের নিজস্ব অনুষ্ঠান—‘এক সন্ধ্যায় শুধু দলছুট’। শুরু থেকে ভালই চলছিল। আচমকা একটি গান মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া হল। এর পরও আমাদের ভাল লেগেছে, কারণ সায়ন বিশ্বাস সততার সঙ্গে অকপটে নিজেদের ত্রুটি স্বীকার করেছেন।

তাঁদের যে গানের ভাবনা, কাজের তাগিদ, সেখান থেকে দেখলে এই ধরনের ত্রুটি ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। কত ধরনের গান যে তারা লেখেন! এই যে রবিবারের অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হল বেলুনওয়ালার গল্প— ‘তোমার বানানো নীলপাখির ডানায়’। ছোটবেলা থেকেই এই বেলুনওয়ালার সঙ্গে পরিচয় ছিল আমাদের। সেই ‘তাঁকে’ নিয়ে গান শুনতে শুনতে শৈশবে ফিরে যাচ্ছিলাম। কত কথা যে তখন স্মৃতিতে ভিড় করছিল! গানটি আমাদের অন্য অনুভূতি এনে দিচ্ছিল। এ ছাড়াও ছিল উনিশের গান, ছিল এই শহরের গান। অনবদ্য পরিবেশনা।

Advertisement

দলছুটের সকলের সঙ্গে আমার পরিচয় রয়েছে। তাই বর্তমান সামাজিক ডামাডোল, সম্পর্কের টানাপোড়েন ইত্যাদি নিয়ে তাঁরা যে গানে-গানে কথা বলবেন, এটা আমার মনে গেঁথে গিয়েছে। তাঁরা কথা রাখেও। প্রশংসনীয় তাঁদের গানের ভাবনা। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তিনদিনের অনু্ষ্ঠানের আয়োজন করেছেন তাঁরা। সময় দিয়ে, অর্থের ব্যবস্থা করে, ভাল ভাল গান শুনিয়েছেন আমাদের। যেহেতু তাঁরাই আয়োজক, তাই তাঁদের শুধু নিজেদের গানের কথা ভাবলে হয় না। তিনদিনের অনুষ্ঠানের পুরো ব্যবস্থাপনা যে হাতেগোনা ক’জন কিশোরের কাঁধে (বয়সে এরা সবাই তরুণ। তবু আমার কেন যেন মনে হয়, ওঁরা এখনও কিশোর)! তবু এত সুন্দর অনুষ্ঠানমালা! অন্য শিল্পীদের গানও প্রশংসার দাবি রাখে। ২১ জুন বিশ্ব সঙ্গীত দিবসে গোলদীঘি মলে হল ‘গান ফেস টু ফেস’। একঝাঁক ছেলেমেয়ের কী উচ্ছল পরিবেশনা! সত্যি প্রাণবন্ত! আমাদের অত্যন্ত কাছের মানুষ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের উপস্থাপনাও ছিল অতি সুন্দর।

দ্বিতীয় দিনে যে কোলাজ তৈরি করা হল, তাও বেশ ভাল লাগল। ‘গানে গানে ভালবাসার সেলাম’ শীর্ষকে নবীন শিল্পীরা গাইলেন অসাধারণ! কে বলবে তাঁরা অভিজ্ঞ নন। অনেকে হয়তো সেদিনই প্রথম মঞ্চে উঠেছেন। তবু তা বোঝার উপায় ছিল না। আমরা এমন অনুষ্ঠানই চাই বিশ্বরাজ ভট্টাচার্য, সায়ন বিশ্বাস ও সায়ন চক্রবর্তীদের কাছে। টিম ‘দলছুট’-এর কাছে। ‘গান নয়, অন্য গান পর্বে’ তবলায় সঞ্জয়প্রকাশ দাস ও সেতারে রাজর্ষি ভট্টাচার্য অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখেন।

এত সবের পরও ক’টি অপ্রিয় কথা বলতেই হয়। জানি, তিনদিনের অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধতা কম নয়। বিশেষ করে, সময় বড় প্রতিবন্ধক। একটা পূর্ণাঙ্গ অনুষ্ঠানের জন্য যতটা সময় প্রয়োজন, তা আর মেলে কোথায়! সেখান থেকেই হয়তো এই সমস্যাগুলি তৈরি। বিশেষ করে, ‘ব্যান্ডের গান, কীতর্নের টান’ নামে দ্বিতীয় দিন যে অনুষ্ঠান করা হল, সে দিকে অনেকের আগ্রহ ছিল। মনে হচ্ছিল, দু’টিকে মিলিয়ে-মিশিয়ে অভিনব কিছু করতে চলেছেন এরা। কিন্তু অনুষ্ঠানের পর বলতেই হচ্ছে, তেমন চিন্তাভাবনার ফসল কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা গেল না। একবার একজন কীর্তন গাইলেন, পরে ব্যান্ডের একটা গান। কোনও যোগসূত্রই তৈরি হল না। এ ভাবেই চলল। মন ভরল না। আলাদা করে কারও গান নিয়ে কোনও কথা নয়, প্রশ্ন হল ভাবনার। একেকটি গানের কথা বললে, কীর্তন কি ব্যান্ডের গান—সব ক’টি ভাল হয়েছে। শিল্পীদের প্রত্যেকে ভাল। অপরাজিতা ভট্টাচার্য, এদিব ইমন সব সময় গান নিয়েই থাকেন। কম বয়স, কিন্তু দেখলেই মনে হয়, এরা নিজেরাই একেকটি গান।
অনুসূয়া মজুমদার প্রতিষ্ঠিত। কীর্তনে কী অসাধারণ দক্ষতা তাঁর! শহর শিলচরে যাঁদের কীর্তন-গান শুনি, তিনি তাঁদের ছাড়িয়ে। অনসূয়া সেদিন নতুন ভাবে ধরা পড়লেন আমার কাছে। সত্যিই প্রশংসনীয়! সব কিছুর পরও দলছুট-কে একথা বলতেই হয়, ভবিষ্যতে এ ধরনের অনুষ্ঠান করতে হলে শীর্ষক তৈরির সময় চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন।

রবিবারের ‘এক সন্ধ্যায় শুধু দলছুট’ একেবারে টানটান অনুষ্ঠান। দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি মনে করিয়ে দিল কলেজ জীবনে সিনেমা দেখার কথা। হল থেকে বেরিয়ে যে আনন্দ হতো আমাদের, সেদিন শ্রোতারা যখন বেরিয়ে আসছিলেন, সেই তৃপ্তির ছোঁয়াই দেখলাম সকলের চোখেমুখে।

এত বড় কর্মকাণ্ডে দোষত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। সে সব মনে রেখেও এ কথাই বলতে ইচ্ছে করছে, ১৫-টির বেশি গান গাইল শুধু দলছুট! গান শুধু শোনা নয়, দেখছিলামও। দেখছিলাম একঝাঁক উজ্জ্বল কিশোরকে। উজ্জ্বল উপস্থিতির সার্থক প্রয়োগ দেখলাম বিশ্ব সঙ্গীত দিবসের মঞ্চে। এত গান নিয়ে হলভর্তি দর্শকের সামনে দাঁড়ানো কম কথা নয়। আসলে তাঁরা জানতেন, দর্শকরা বসে থাকবেন। সে অধিকার তাঁরা গত কয়েক বছরে অর্জন করে নিয়েছেন। পাশাপাশি যন্ত্রসঙ্গীতের অসাধারণ ভূমিকাকে কোনও মতেই আলোচনা থেকে বাদ দেওয়া চলে না। কানাইলাল দাস অতি দক্ষ, আবারও প্রমাণ মিলল। আর শুধু কানাইলাল কেন, প্রত্যেকে নিজের সবচেয়ে ভালটা তুলে ধরেছেন সেই সন্ধ্যায়। এত আন্তরিকতা! মনে হচ্ছিল, তাঁরাও দলছুট-এরই সদস্য।

এত কিছুর পাশাপাশি এ বারও তাঁরা প্রকাশ করলেন মুখপত্র, ‘তৌর্যত্রিক’। ভাবনাচিন্তায় যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তমাল চক্রবর্তী, বিশ্বরাজ ভট্টাচার্য সম্পাদনায় কোনও ত্রুটি রাখেননি। বহুভাষিক এই সংকলনটি তাঁদের মেধা ও মননে এই অনুষ্ঠানের বিশেষ সংযোজন।

উপসংহারেও একবার বেলুনওয়ালার গানটার কথা না বলে পারছি না। কী অসাধারণ সংযোজন! ‘গান কবিতায় কথায় ভালবাসায়’—উনিশের গানটাও যথেষ্ট ভাল। ভবিষ্যতে এমন গান আরও শুনব।

আরও ভাল অনুষ্ঠান দেখার তাগিদ থেকে বলছি, শিশুদের গানও গাইতে হবে দলছুটকে। রবিবারের সন্ধ্যা-রাতে দর্শকদের আসনে বহু শিশুও ছিল। কিন্তু তারা তাদের গান খুঁজে পায়নি। ছড়ার গান হতেই পারত। শিশুমহলের নানা প্রতিক্রিয়ার কথা তাঁদের গানে আসতেই পারত। তাঁরা নিজেরা যেহেতু গান লেখেন, সুর বাঁধেন, তাই তাদের কাছে এই প্রত্যাশাও বাড়াবাড়ি নয়।

আরেকটা বিষয়, তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ২০০৯ থেকে বললে, প্রথম দিকে তাঁদের গানে কিন্তু এ বছরের মত ত্রুটি ছিল না। এ কি শুধু ব্যস্ততার দরুন? হতেও পারে। কিন্তু মঞ্চে উঠে দর্শককুলকে প্রতারিত করা ঠিক নয়। সব সময় মনে রাখতে হবে, দর্শক একটা প্রত্যাশা নিয়ে উপস্থিত হয়। পিছনে যত যুক্তিই থাক না কেন, মহড়া ছাড়া মঞ্চে ওঠা কোনও ভাবে সমর্থন করা যায় না। সাধারণত তাতে আন্তরিকতার ঘাটতি ধরা পড়ে। যদিও আমি জানি, দিব্যেন্দু-পাপলু-বিশ্বরাজ-সায়ন-সন্দীপ-রূপরাজদের আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত। বিশ্বাস করি, আগামি দিনে তাঁরা এই জায়গায় আপস করবেন না। নতুন চিন্তায় নতুন গান, তাঁদের কাছে দাবি আমাদের। যেহেতু তাঁরা গানের দল হিসেবে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করেছেন, প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও এখন সবাইকে তালিম নিতেই হবে। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের চেয়ে তা ধরে রাখাটাই কঠিন ব্যাপার। দলছুট সেখানে সফল হবে, আমি জোর দিয়ে তা বলতে পারি। সমস্যায় জর্জরিত মানুষ তাঁদের গানে বুকে অক্সিজেন ভরার মত পরিবেশ পাবেন।

কবীর সুমনের গানের কথাটাকে সামান্য বদলে শেষ করি, ‘কতটুকু মহড়ায় মঞ্চে গান গাওয়া যায়/কতবার গাইলে তবে গান হয় গান/ প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরও তো জানা।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন